শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজে অভিযান
দুদক মামলা করলে কর্মবিরতির হুঁশিয়ারি চিকিৎসকদের
সরকারি দায়িত্ব পালনে অনীহা, ব্যক্তিগত চেম্বারে রোগী দেখতে ব্যস্ত থাকার অভিযোগে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজে (শেবামেক) দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অভিযানকে সাধুবাদ জানিয়েছেন বিশিষ্টজনরা। কবি, রাজনীতিবিদ, সংগঠক, উন্নয়নকর্মী, শিক্ষাবিদসহ বরিশালের উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিরা এই অভিযান অব্যাহত রাখার দাবি জানিয়েছেন। একই দাবি জানিয়েছেন হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগী ও তাদের স্বজনরা।
যদিও শেবামেক অধ্যক্ষের কার্যালয়ে দুদকের অভিযানের নিন্দা জানিয়ে বিক্ষোভ করেছেন চিকিৎসক ও শিক্ষার্থীরা। এ ঘটনায় আভিযান চালানো দলের প্রধানের বহিষ্কার চেয়ে তারা বিভাগীয় কমিশনারের মাধ্যমে সরকারে উচ্চপর্যায়ে স্মারকলিপি প্রদান কর্মসূচি নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন কলেজ অধ্যক্ষ ডা. মনিরুজ্জামান শাহিন।
বিজ্ঞাপন
লোক সংস্কৃতি গবেষক ও বরিশাল সাংস্কৃতিক সংগঠন সমন্বয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক দেবাশীষ চক্রবর্তী বলেন, শুধু চিকিৎসা সেবা নয়, সকল দুর্নীতির বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের এমন অভিযান অব্যাহত থাকা উচিত। সেই সঙ্গে সরকারি দপ্তরে যারা জনসেবায় রয়েছেন তাদের উচিত সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করা। এটা মনে রাখা উচিত মাস শেষে যে বেতন তারা পাচ্ছেন, তা কিন্তু জনগণের ট্যাক্সের টাকা। সুতরাং জনগণের অধিকার রয়েছে তার কাছ থেকে সঠিকভাবে সেবা পাওয়ার।
সচেতন নাগরিক কমিটি বরিশাল জেলা শাখার সভাপতি অধ্যাপক শাহ সাজেদা বলেন, দুদকের অভিযানকে অবশ্যই স্বাগত জানাই। যেসব দপ্তরে মানুষ হয়রানির শিকার হয়, সেইসব জায়গায় এই অভিযান ধারাবাহিকভাবে চালানো উচিত।
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, মাঝে মাঝে আমরা বিভ্রান্ত হই। দুর্নীতির বিরুদ্ধে ধারাবাহিক অভিযান না হলে আসলে কোনো ফলাফল আসে না। আমরা প্রায়ই দেখি হঠাৎ হঠাৎ অভিযান হয় এবং অভিযানের পর কে দোষী আর কে নির্দোষ তা জনগণকে জানানো উচিত। কিন্তু তা দেখি না। তবে আমার প্রত্যাশা থাকবে দুর্নীতি দমন কমিশন বরিশালে তাদের অভিযান অব্যাহত রাখবে।
আরও পড়ুন : দুদক আসার খবরে ছুটে এলেন চিকিৎসকরা
বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল বরিশালের আহ্বায়ক প্রকৌশলী ইমরান হাবিব রুমন বলেন, বাংলাদেশের অধিকাংশ সরকারি প্রতিষ্ঠান দুর্নীতিগ্রস্ত। এসব প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি কমিয়ে আনতে নিয়মিত দুর্নীতি দমন কমিশনের অভিযান অব্যাহত রাখা উচিত। এমনকি সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের এই অভিযানকে স্বাগত জানানো উচিত। কারণ এতেই প্রমাণ হবে তার প্রতিষ্ঠান দুর্নীতিমুক্ত। কিন্তু যারা বাধাগ্রস্ত করতে চায় বুঝতে হবে সে বা তার প্রতিষ্ঠান দুর্নীতিগ্রস্ত।
জাতীয় পার্টির বরিশাল মহানগরের আহ্বায়ক অধ্যাপক মহসিন উল ইসলাম হাবুল বলেন, শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে কোনো চিকিৎসা নেই। সব যন্ত্র বিকল করে রেখেছে। এখানে গেলেই চিকিৎসকরা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষার জন্য পাঠান। রোগী তাদের ব্যক্তিগত চেম্বারে পাঠান। দুর্নীতি দমন কমিশন অভিযান চালিয়েছে আমি খুশি। কিন্তু দুদক কি তাদের রুখতে পারবে? এই হাসপাতালের ডাক্তারদের এক এক জনের বাড়ি লন্ডন, আমেরিকায়, ভারতে। এতো ওপেন সিক্রেট। এগুলো কি তারা বেতনের টাকায় করেছেন? সরকার এই দুর্নীতি করার সুযোগ দিচ্ছে। কারণ এসব দপ্তরের পরিচালকদের কোনো জবাবদিহি করতে হচ্ছে না। সরকারও জনগণের কাছে জবাবদিহি করে না। তাদের আমলারাও করে না। আমি মনে করি দুদক একা এই দুর্নীতিবাজদের প্রতিরোধ করতে পারবে না।
অন্যদিকে শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, অন্যান্য দিনের চেয়ে সক্রিয়ভাবে বহির্বিভাগে চিকিৎসা সেবা পাচ্ছেন রোগীরা। মেডিসিন বহির্বিভাগে লাইনে দাঁড়ানো রোগী শরিফুল ইসলাম সৈকত বলেন, গত সপ্তাহে ডাক্তার দেখিয়ে গেছি। তখন অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। আজ শুনেছি দুদক অভিযান চালিয়েছে। এখন সব রুমে ডাক্তার এসেছেন। ফলে অল্প সময়ে চিকিৎসা পাচ্ছি।
আরেক রোগী ইমরান বলেন, দুদক অভিযান চালিয়েছে শুনে অত্যন্ত আনন্দ লাগছে। আর না হোক অন্তত এক মাস গরিব-অসহায় মানুষগুলো একটু সহজে চিকিৎসা সেবা পাবে। আমি চাই দুদকের বুথ করা হোক এই হাসপাতালে। কারণ এই হাসপাতালের সকল কক্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত।
নাক কান গলা বিভাগের সামনে কথা হয় রোগী মেহেরুন্নেছার সঙ্গে। তিনি বলেন, আগে ডাক্তার দেখাতে আসলে ওষুধ প্রতিনিধিদের জ্বালায় ডাক্তার দেখাতে পারতাম না। আজ সেই জ্বালা নেই।
আরেক রোগী হারুন আর রশিদ বলেন, এতদিন যেসব কর্মচারী-ডাক্তার হাসপাতালে আসেনি তারাও আজ খবর পেয়ে হাসপাতালে এসে কাজ করছেন। তাতে মন্দের ভালো সেবা পাচ্ছি।
দুদক মামলা করলে কর্মবিরতিতে যাওয়ার হুঁশিয়ারি
এদিকে শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষের কক্ষে দুদকের অভিযানের প্রতিবাদে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। বিকেল ৩টায় কলেজের কনফারেন্স রুমে হাসপাতালের ডাক্তার এবং ছাত্র-ছাত্রীরা জরুরি বৈঠক শেষে কলেজ ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। এ সময় অভিযানের নেতৃত্বে থাকা দুদকের সহকারী পরিচালক রাজ কুমারের ‘অসদাচরণের’ কারণে তার বহিষ্কার দাবি করা হয়।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের বরিশাল বিভাগীয় সভাপতি ডা. ইসতিয়াক হোসেন বলেন, বিষয়টি পরিষ্কার, আমরা দুদকের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছি না। আমাদের আন্দোলন অভিযানে থাকা রাজ কুমারের বিরুদ্ধে। তিনি অধ্যক্ষের সঙ্গে যে আচরণ করেছেন তা অত্যন্ত জঘন্য। ৯ম গ্রেডের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী একজন ২য় গ্রেডের কর্মকর্তার সঙ্গে এভাবে অসদাচরণ করতে পারে না। অনিয়ম অন্যায় থাকলে দুদক তাদের কাজ করবে, কিন্তু তারা যে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেছে আমরা তার বিচার চাই।
তিনি বলেন, আমরা বৈঠক করে আজ সিদ্ধান্ত নিয়েছি বুধবার (৭ সেপ্টেম্বর) বিভাগীয় কমিশনার, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও দুদক সচিব বরাবর স্মারকলিপি দেওয়া হবে।
শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. মনিরুজ্জামান শাহিন বলেন, আজকে বৈঠক ও বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে। রোগীদের কথা চিন্তা করে বড় কোনো আন্দোলনে যাইনি। তবে যদি তারা (দুদক) কোনো মামলা করে, তাহলে আমরা কর্মবিরতিতে যাব।
প্রসঙ্গত, মঙ্গলবার (৬ সেপ্টেম্বর) সকাল সোয়া ৯টা থেকে সোয়া ১০টা পর্যন্ত শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ মনিরুজ্জামান শাহিনের কার্যালয়ে অভিযান চালায় দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয়। রোগীর চিকিৎসা না দেওয়া, সরকার নির্ধারিত সময়ে কার্যালয়ে না আসা, ব্যক্তিগত চেম্বারে রোগী দেখা নিয়ে ব্যস্ত থাকাসহ বেশ কয়েকটি লিখিত অভিযোগের প্রেক্ষিতে অভিযান চালায় দুদক। অভিযোগে ডা. আনোয়ার হোসেন বাবলু ও অমিতাভ সরকারের নাম উল্লেখসহ হাসপাতালের অন্যান্য চিকিৎসকের বিরুদ্ধে একই অভিযোগ দেওয়া হয়। অভিযানে অভিযোগের সত্যতা পায় দুদক।
সৈয়দ মেহেদী হাসান/আরএআর