‘তিস্তাপাড়ের ২ কোটি মানুষের জীবনে মহাদুর্যোগ নেমে এসেছে’
আন্তঃদেশীয় ব্যবস্থাপনায় তিস্তা অববাহিকার দুই দেশ ভারত-বাংলাদেশ মিলে নদী ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে না পারা ও দেশীয় ব্যবস্থাপনায় নদী খনন, ভাঙন রোধে কার্যকর পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন করতে না পারায় তিস্তা নদীর বাংলাদেশ অংশের ১১৫ কিলোমিটারে বসবাসরত ২ কোটি মানুষের জীবনে মহাদুর্যোগ নেমে এসেছে বলে অভিযোগ করেছেন তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের নেতারা।
তাদের অভিযোগ, তিস্তা অববাহিকার রংপুর জনপদে খরা, বন্যা ও নদী ভাঙনে ঘরে ঘরে আহাজারি চলছে। নদী ভাঙনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় বর্তমানে কোথাও কোথাও তিস্তা নদীর প্রস্থ হয়েছে ১০-১২ কিলোমিটার। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় পরিস্থিতি ক্রমাগত বেসামাল হয়ে উঠছে তিস্তাপাড়ের জনজীবন। এ পরিস্থিতিতে তিস্তা চুক্তি সই এবং নিজস্ব অর্থায়নে বিজ্ঞানসম্মতভাবে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের বিকল্প নেই বলেও মনে করছেন নদী আন্দোলনে সম্পৃক্ত নেতারা।
বিজ্ঞাপন
সোমবার (৫ সেপ্টেম্বর) দুপুরে রংপুর প্রেসক্লাবের সামনে আয়োজিত মানববন্ধন সমাবেশ থেকে এসব অভিযোগ তুলে অবিলম্বে ভারতের সঙ্গে তিস্তা চুক্তি সই ও তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছে তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদ। মানববন্ধনে রংপুর অঞ্চলের পাঁচ জেলার সহস্রাধিক মানুষ অংশ নেন।
সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি নজরুল ইসলাম হক্কানীর সভাপতিত্বে মানববন্ধনে বক্তব্য দেন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক শফিয়ার রহমান, স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা গেরিলা লিডার শফিকুল ইসলাম কানু, ড. তুহিন ওয়াদুদ, সাদেকুল ইসলাম, অধ্যক্ষ মুহাম্মদ আলী, বখতিয়ার হোসেন শিশির, কেন্দ্রীয় নেতা সাজু সরকার, মোস্তাফিজার রহমান, আশিকুর রহমান ও বাবুল আকতার প্রমুখ।
সংহতি জানিয়ে রংপুর মহানগর আওয়ামী লীগ, জাসদ, কমিউনিস্ট পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশ জাসদ, বাংলার চোখসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতারা বক্তব্য দেন।
মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, এ বছর ভারত থেকে ধেয়ে আসা অসময়ের উজানের ঢলে রংপুর অঞ্চলের তিস্তা অববাহিকায় সপ্তমবারের মতো বন্যা হয়েছে। বন্যা ও নদী ভাঙনের ভয়াবহতায় এই অঞ্চলের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি হুমকির মুখে। খরাকালে গজলডোবায় বাঁধ দিয়ে শুকনো মৌসুমে পানি আটকে রাখে ভারত। আবার একটু পানি বেশি হলেই বাংলাদেশকে কিছু না জানিয়ে গজলডোবার গজব ভাসাচ্ছে এই অঞ্চলের মানুষদের। এতে প্রতিবছর ব্যাপক ফসলহানি ঘটেছে। হুমকিতে পড়েছে খাদ্য নিরাপত্তা। নদী ভাঙনে বাড়ছে উদ্বাস্তু মানুষের সংখ্যা, বাড়ছে রংপুর বিভাগে গড় দারিদ্রের হার।
সংগঠকদের অভিযোগ, ২৩৫ বছর বয়সী নদী তিস্তার জন্মলগ্ন থেকে আজ অবধি কোনো পরিচর্যাই করা হয়নি। তিস্তার নাব্যতা নেই। নেই সামান্য গভীরতা। নদী শাসন ও বন্যা রোধে পানি উন্নয়ন বোর্ড বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ তৈরি করেছিল। তিস্তার ডান তীরে নড়বড়ে ওই বাঁধ থাকলেও তিস্তার বাম তীর সম্পূর্ণ অরক্ষিত ও কোনো বাঁধ নেই। এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় জলবায়ু পরিবর্তনের অভিযোজন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তিস্তা নদী খনন, বাঁধ নির্মাণসহ সরকার প্রতিশ্রুত ‘তিস্তা মহাপরিকল্পনা’ বিজ্ঞানসম্মতভাবে বাস্তবায়ন অতীব জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এক্ষেত্রে অন্যদেশ থেকে অর্থ গ্রহণে কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকলে পদ্মা সেতুর মতো নিজস্ব র্অথায়নে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের নেতারা।
তারা বলেন, পাঁচ বছর মেয়াদি ‘তিস্তা কর্তৃপক্ষ গঠন’ করে তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সাড়ে আট হাজার কোটি টাকা খুব একটা বড় অংক নয়। এজন্য অর্থ সংগ্রহে তিস্তাপাড়ের মানুষ নিজেরাই যথেষ্ট। সরকার ও সরকার প্রধান আহ্বান জানালে দেশবাসী এ কাজে উদার মনে এগিয়ে আসবে। জলবায়ু পরির্বতনের অভিযোজন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে তিস্তা মহাপরিকল্পনার কাজ দ্রুত সম্পন্ন করা গেলে দেশের সব নদী সুরক্ষায় তিস্তা অনুকরণীয় পথ দেখাবে।
মানববন্ধনে তিস্তা নদীর দুই পাড়ের জেলা নীলফামারী, লালমনিরহাট, রংপুর, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধার বিভিন্ন উপজেলা থেকে লোকজন রংপুরে আসেন। তারা তিস্তা চুক্তি সই ও তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে বিভিন্ন দাবি সম্বলিত প্লাকার্ড বুকে ঝুলিয়ে স্লোগান দেন। মানববন্ধনটি রংপুর প্রেসক্লাব চত্বর থেকে জাহাজ কোম্পানি মোড় পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। তিস্তাপাড়ের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের সঙ্গে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার সাধারণ মানুষও এতে অংশ নেন।
ফরহাদুজ্জামান ফারুক/আরএআর