কুল চাষে কলেজছাত্র এখন লাখপতি
বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে কম্পিউটার ডিপ্লোমা পাস করেন কামরুল হাসান (২৪)। এক বছর বিরতি দিয়ে বিএসসিতে ভর্তি হয়েছিলেন। প্রথম বর্ষে থাকা অবস্থায় প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস সংক্রমণের পরিস্থিতিতে বন্ধ হয়ে যায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সবার মতো তাকেও বাসায় বন্দী হতে হয়। তখন সঙ্গী ছিল একমাত্র ইউটিউব। দেখতে দেখতে হঠাৎ পেলেন বলসুন্দরী বরই চাষে সফলতা নিয়ে একটি প্রতিবেদন। আর এতেই আগ্রহ বাড়ে কামরুলের।
সেই থেকে শুরু হয় ইউটিউবে বলসুন্দরী চাষের বিভিন্ন নিয়ম, পরিচর্যাসহ যাবতীয় সবকিছুর ভিডিও দেখা। এসব ভিডিও দেখেই উদ্বুদ্ধ হয়ে একদিন নিজেই উদ্যোগী হন। বড় ভাইয়ের সহযোগিতা ও পরামর্শ নিয়ে আত্মীয়স্বজনের জমি ইজারা নিয়ে আট মাস আগে শুরু করেন বলসুন্দরী বরই চাষ।
বিজ্ঞাপন
চাঁপাইনবাবগঞ্জের সদর উপজেলার বালিয়াডাঙ্গা ইউনিয়নের রামজীবনপুর গ্রামের একরামুল হকের ছেলে কামরুল হাসান সদর উপজেলার ঝিলিম ইউনিয়ন জামতলা-তিন পুকুর এলাকায় ১২ বিঘা জমিতে চাষাবাদ করেছেন সুমিষ্ট বলসুন্দরী চাষ। আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশীর কাছ থেকে ৩২ বিঘা জমি ইজারা নেন। এখানে গড়ে তুলেছেন বিশাল মিশ্র কৃষি বাগান।
কামরুলের বাগানে রয়েছে পেয়ারা, আম, আখ, লেবু, টমেটোসহ বিভিন্ন ফলের উন্নত জাত। প্রতি বিঘায় বছরে ইজারা বাবদ কামরুলকে গুনতে হয় সাত হাজার টাকা।
জানান কামরুল হাসান, গত আট মাসে বলসুন্দরীর ফলন পেতে সব মিলিয়ে খরচ করতে হয়েছে দুই লাখ টাকা। তিনি বরই বাগান থেকে প্রায় সাত লাখ টাকার বেশি লাভের আশা করছেন। তিনি আরও বলেন, গত বছরের মার্চে অনির্দিষ্টকালের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেলে বাসায় এসে অলস সময় কাটাতে থাকি। এ সময় ইউটিউব দেখে বলসুন্দরী চাষে আগ্রহী হয়ে উঠি এবং বড় ভাইয়ের সহযোগিতা, পরামর্শ ও অনুপ্রেরণায় চাষাবাদ শুরু করি।
কৃষি বিভাগ বলছে, জেলায় গত বছর থেকে সুমিষ্ট বলসুন্দরী কুল চাষাবাদ শুরু হলে সবার মধ্যে বেশি সফলতা পেয়েছেন কামরুল হাসান। তার বরই বাগানের ফলন যেমন বাম্পার, তেমনি নেই কোনো রোগবালাই।
এই সফলতার কারণ জানতে চাইলে তরুণ কৃষি উদ্যোক্তা কামরুল হাসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, অন্য চাষিরা কম দামে বিভিন্ন প্রাইভেট নার্সারি থেকে চারা নিয়েছেন। কিন্তু আমি সব চারা (১২০০) চাঁপাইনবাবগঞ্জ হর্টিকালচার সেন্টার থেকে নিয়েছিলাম। এতে অন্যদের বাগানে বলসুন্দরীর সঙ্গে মিশ্র চাষাবাদ হলেও আমার বাগানে শুধুই বলসুন্দরী কুলের চাষাবাদ হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও হর্টিকালচার সেন্টারের সহযোগিতা ও পরামর্শ সফলতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। আর তাৎক্ষণিক যেকোনো সমস্যার সমাধান খুঁজতে ঢুঁ মারি ইউটিউবে।
প্রথম দফা বরই বাজারজাতকরণ শেষে এখন চলছে দ্বিতীয় দফায় বরই উত্তোলন। কামরুলের বাগানের বরই যাচ্ছে রাজধানী ঢাকায়, যা বিক্রি হচ্ছে কেজি প্রতি ১০০ টাকা দরে। এই বাগানের পাশাপাশি কামরুল এখন বাণিজ্যিকভাবে শুরু করেন নিজের বাগান থেকে শায়ন নিয়ে চারা উৎপাদন ও বিপণন। এতে ব্যাপক সাড়াও মিলছে। সরকার-নির্ধারিত চারার দাম ৫০ টাকা হলেও কামরুল বিক্রি করছেন ৩০ থেকে ৩৫ টাকায়।
কম্পিউটার নিয়ে পড়েছেন, ভবিষ্যতে কী করবেন, এমন প্রশ্নে কামরুলের সোজা উত্তর, কম্পিউটার নিয়ে ডিপ্লোমা, বিএসসি পড়লেও এখন আর এসব নিয়ে চিন্তাও করি না। এই ফল বাগানকেই আরও বাড়াতে চাই। আশা করি, আগামী বছর আমার বলসুন্দরী কুলের বাগান দেশের সবচেয়ে বড় ও অন্যতম সেরা হিসেবে পরিণত হবে।
কামরুলের বলসুন্দরী বাগানের নিয়মিত শ্রমিক ও জোগানদার রমজান আলী বলেন, নতুন এই ফল চাষাবাদে ভালো লাভ হচ্ছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে ও সঠিক সময়ে সঠিক পরামর্শ নিলে অনেক লাভ করা সম্ভব। কামরুলের কুল বাগানের সফলতার কথা শুনে প্রতিদিনই বিভিন্ন জায়গা থেকে বাগান দেখতে ও চারা কিনতে আসছে অনেকেই।
তরুণ কৃষি উদ্যোক্তা কামরুলের বড় ভাই ইউসুফ আলী জানান, সস্তায় চারা না কিনে অধিক দামে ভালো চারা কেনায় বাগানে একই জাতের চাষাবাদ হয়েছে। বর্তমানে টেলিভিশন, ইউটিউব, ইন্টারনেটে বিদেশি ফল চাষের ব্যাপারে আগ্রহী করা হচ্ছে। যেগুলো সম্পর্কে আমাদের তেমন কোনো ধারণা নেই। এমনকি বাজারজাতকরণেও রয়েছে নানা সমস্যা। সে থেকেই বলসুন্দরী কুল চাষে ছোট ভাইকে আগ্রহী করেছি। কারণ সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত ও জাত নির্বাচন সঠিক হলে দেশি ফল চাষেও সফল হওয়া সম্ভব এবং নতুন কৃষি উদ্যোক্তারা এভাবে টিকে থাকতে পারে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ হর্টিকালচার সেন্টারের উপপরিচালক কৃষিবিদ মোজদার হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, এই ফল চাষে অনেক তরুণ উদ্যোক্তা আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। তাদের মধ্যে কামরুলের কুল বাগানের ফলন অনেক অধিক। এমনকি তার বাগানের কুল অনেক সুমিষ্ট ও বড় আকারের। হর্টিকালচার সেন্টারের পক্ষ থেকে বলসুন্দরী কুল চাষে কামরুল হাসানকে বিভিন্ন সময়ে নানা পরামর্শ ও সহযোগিতা দেওয়া হয়েছে। তরুণ বেকার যুবকদের জন্য কামরুল হাসান উদাহরণ হতে পারে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
এনএ