মানিকগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী হাট ঘিওর হাট। সপ্তাহের প্রতি বুধবার বসে এই হাট। হাটের অন্যতম আকর্ষণ হলো বড় আকারের থাপড়ানো রুটি। আশপাশের বিভিন্ন জেলার লোকজন হাট শেষে বাড়ি ফেরার পথে যান থাপড়ানো রুটির দোকানে। কেউ রুটির দোকানে বসে রুটি খান, আবার কেউ পরিবারের জন্য কিনেও নিয়ে যান।

জানা গেছে, ঘিওর হাটের পুরোনো এই থাপড়ানো রুটির ঐতিহ্য ধরে রাখতে ব্যবসা ধরে রেখেছেন ১০-১২ দোকান মালিক। আগে ২৫টি দোকানে তৈরি হতো এই রুটি। তবে কালের বিবর্তনে দোকানের সংখ্যা কমলেও থাপড়ানো রুটি চাহিদা আর সুনাম একটুও কমেনি। বাপ-দাদার আমল থেকে চলে আসা এই রুটির ব্যবসাকে ধরে রেখেছেন তারা। নিত্য পণ্যের দাম বাড়ার কারণে থাপড়ানো রুটি বিক্রি করে আগের মতো লাভ না হলেও বাপ-দাদার শত বছরের ব্যবসাকে ধরে রেখেছেন ঘিওর হাটের এসব দোকান মালিক।

সরেজমিনে দেখা যায়, হাটের দিন সকাল থেকেই শুরু হয় ঐতিহ্যবাহী এই থাপড়ানো রুটি তৈরির বিশাল এক কর্মযজ্ঞ। রুটি তৈরির কারিগররা ব্যস্ত সময় পার করছেন আর দোকানের কর্মচারীরা ক্রেতাদের চাহিদামতো রুটি দিচ্ছেন। কেউ দোকানে বসেই রুটি-মিষ্টি খাচ্ছেন আবার কেউ কেউ পরিবারের সদস্যদের জন্য কেজি দরে রুটি কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। দোকানের কারিগররা রুটির সঙ্গে সঙ্গে জিলাপিও তৈরি করছেন। সাপ্তাহিক এই হাটের দিনে থাপড়ানো রুটির চাহিদা বেশি থাকে। এ দিন প্রতিটি দোকান মালিক ১০০-১৫০ কেজি থাপড়ানো রুটি বিক্রি করে থাকেন। আবার কোন দোকানদার ২০০ কেজি রুটিও বিক্রি করেন। তবে সপ্তাহের বাকি দিনগুলোতে থাপড়ানো রুটি কিছুটা কম বিক্রি হয় বলে জানান ব্যবসায়ীরা।

জেলার দৌলতপুর উপজেলার জিয়নপুর ইউনিয়নের ছোট লাউতারা গ্রামের কৃষক আতাউর রহমান। ঘিওর হাটে আড়াই মণ পাট বিক্রি করে থাপড়ানো রুটি কিনতে এসেছেন। আলাপকালে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রতি বুধবার ঘিওরের হাটে পাট না হয়, অন্য কোনো ফসল বিক্রি করতে আসি। হাটে বেচাকেনা শেষে বাড়ি ফেরার পথে থাপড়ানো রুটি খাই এবং বাড়িতে বউ-পোলাপানের জন্য নিয়া যাই। এই রুটি খাইতে ভালো লাগে, স্ত্রী থাপড়ানো রুটি পছন্দ করে। এজন্য ৯০ টাকা দরে দুই কেজি থাপড়ানো রুটি কিনলাম।

চিত্তদাস নামে এক দোকানদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার বাবায় এই ব্যবসা করছে। আমিও করতাছি প্রায় ২০ বছর ধরে। থাপড়ানো রুটির ভালোই চাহিদা আছে। হাটের দিন ৪০ কেজির মতো আমি রুটি বিক্রি করি। লাভ কেমন হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, আগের মতো থাপড়ানো রুটি বেইচা লাভ হয় না। এহন সব কিছুর দাম বাইড়ে গেছে। কম লাভ হলেও ব্যবসাটা ধরে রাখছি। কারণ এই কাজ ছাড়া তো অন্য কোনো কাজ করতে পারি না। আর বাবার কাছ থ্যাইকা এই ব্যবসা শিখছি।

হাটের বিজয় মিষ্টান্ন ভান্ডারের মালিক জিতেন দাস। তিনিও থাপড়ানো রুটি বিক্রি করে আসছেন দীর্ঘ দিন ধরে। থাপড়ানো রুটির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রায় ৭০-৮০ বছর ধরে এই রুটির ব্যবসা চলতাছে। বাপে করছে, এখন আমি করছি। দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন ধান, সরিষা, পাটসহ বিভিন্ন ফসল বিক্রি করতে এই হাটে আসে। হাটের দিন থাপড়ানো রুটি-মিষ্টি খাওয়ার জন্য তারা সঙ্গে দু-একজন পোলাপানও নিয়ে আসেন।

হাটে আসলে এই রুটি খাবেই তারা। প্রায় ২০০ বছরের ঐতিহ্য থাপড়ানো রুটির। খাইতে অনেক সুস্বাদু আর কেজি দরে বিক্রিও করি। থাপড়ানো রুটির আকার অনুযায়ী ৮০ টাকা থেকে ১২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। প্রতি হাটে আমি ২০০-২৫০ কেজি রুটি বিক্রি করি। তাতে হাটের দিন ২০-৩০ হাজার টাকার রুটি বিক্রি হয়।

ঐতিহ্যবাহী থাপড়ানো রুটি তৈরির কারিগর রিপন মিয়ার বাড়ি ঘিওর ইউনিয়নের কুস্তা গ্রামে। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, থাপড়ানো রুটি ঘিওর বাজারের ঐতিহ্য। থাপড়ানো রুটি খাইতে যেমন স্বাদ, তেমন মানেও ভালো। এজন্য এই রুটির চাহিদাও অনেক। অনেক দূরে থ্যাইকা লোকজন এখানে আসে, রুটি খায় আবার কেজি দরে কিনে নিয়েও যায়। তয় এহন সব জিনিসপত্রে দাম বেশির কারণে বেচা-কেনা কম হইতাছে।

কত বছর ধরে থাপড়ানো রুটির কারিগর হিসেবে কাজ করছেন জানতে চাইলে রিপন বলেন, প্রায় ৩৫ বছর ধরে থাপড়ানো রুটি বানাই। এখানে আমি রোজ হিসেবে কাজ করি। এই কাজের টাকা দিয়াই আমি সংসার চালাই। আমার দুইটা মেয়ে, এই থাপড়ানো রুটি বানানোর কাজ কাইরা বড় মেয়েকে কলেজে পড়াইতাছি, আর ছোট মেয়েটা সামনে হাইস্কুলে যাইব। আগে এই কাম কইরা ৩০০ টাকা রোজ পাইতাম, অহন পাই ৬০০ টাাক। অন্য কাজ শিখি নাই, তাই এই কাজ কইরাই কোনো মতে কষ্টে সংসার চালাই।

ঘিওর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. অহিদুর ইসলাম টুটুল ঢাকা পোস্টকে বলেন, শত বছরের পুরোনো ঐতিহ্যবাহী ঘিওর হাট। সারা দেশে এই হাটের সুনাম রয়েছে। আমরা এক সময় এই হাটকে নিয়া গর্ব করতাম। তার অন্যতম উপসঙ্গ ছিল গরুর হাট, থাপড়ানো রুটি এবং সোনালি ফসল পাট। তবে গরুর হাটটি বিলীনের পথে থাকলেও থাপড়ানো রুটির ঐতিহ্য এখনো রয়ে গেছে। দূর থেকে লোকজন এই হাটে থাপড়ানো রুটি আর মিষ্টি খেতে আসেন।
 
এসপি