দরিদ্র পরিবারে বেড়ে ওঠা মানুষ বাদশা মিয়া। সবার কাছে পরিচিত সাইকেল বাদশা নামে। আড়াই কাঠা জমির ওপর ছোট্ট একটি জরাজীর্ণ ঘরে তিন সন্তান আর স্ত্রীকে নিয়ে বসবাস করেন। খুব কষ্টে দিনাতিপাত করেন বাদশা। তারপরও নিজেকে সুখী ও ভাগ্যবান মনে করেন তিনি। কারণ, তিনি গ্রামের সবার উপকারে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। শস্যের বীজ বিতরণ করেন সবাইকে।

উল্লেখ্য, বাদশা মিয়াকে নিয়ে দেশের বিভিন্ন মিডিয়াসহ জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’তে সচিত্র প্রতিবেদন প্রচার হয়েছিল। সে অনুষ্ঠানে তিনি এক লাখ টাকা পুরস্কার পেয়েছেন। সেই টাকা তিনি ব্যাংকে রেখে দিয়েছেন। তিনি জানান, এই টাকার লভ্যাংশ তিনি গরিব মানুষের মেয়ের বিয়ের জন্য ব্যয় করবেন।

দোচালা ঘরের বারান্দায় দুটি ছোট্ট তাঁত রয়েছে বাদশার। এই তাঁতের চাকা ঘুরলেই ঘোরে সংসারের চাকা, চলে সন্তানদের পড়ালেখার খরচ। সপ্তাহের প্রতি মঙ্গলবার নিজের কাজ বন্ধ রেখে উপজেলার পথে-প্রান্তরে ঘুরে ঘুরে ভাঙাচোরা সাইকেলে চড়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিনামূল্যে শাকসবজির বীজ বিতরণ করেন তিনি। সপ্তাহের মঙ্গলবার ছাড়াও দুটি তাঁত যেদিন নষ্ট দেখাবে বা সমস্যা দেখাবে, সেদিনও বীজ বিতরণের কাজে বের হন। সব মিলিয়ে সপ্তাহের সাত দিনই ব্যস্ততায় অতিবাহিত করেন তিনি।

বাদশা প্রায় ২০ ধরনের সবজি বীজ, ৫ ধরনের ফলের গাছ, ৬ ধরনের ছায়াদান গাছ বিতরণ ও রোপণ করে থাকেন। এগুলোর মধ্যে পেঁপে, চালকুমড়া, মিষ্টিকুমড়া, পুঁইশাক, ঢ্যাঁড়স, জিঙ্গা, ডাঁটাশাক, করলা, ধুন্দল, সিম, লাউ, উশি, কাটারি আনাজ, কলমিশাক, মুলা, টমেটো, বটবটি, পালংশাক ইত্যাদি। ছায়া ও কাঠ গাছের মধ্যে রয়েছে বটগাছ, পাকরগাছ, তালগাছ, কৃষচূড়া, কাঁঠালগাছ। মাঝেমধ্যে তিনি নিজেই এসব গাছের পরিচর্যা করতে যান।

এক নারীকে বীজ দিচ্ছেন বাদশা মিয়া

সরেজমিন দেখা যায়, বেড়া উপজেলার বাড়িতে বাড়িতে তার দেওয়া বীজের সবজি জংলায় জংলায় ধরে আছে। তার দেওয়া বীজের ফল-ফসল কেউ বেচতে নিচ্ছে। কেউ বাড়িতে খেতে নিচ্ছে। এতে তরকারির বা ফলমূলের চাহিদা পূরণ হচ্ছে।

পাবনা জেলার বেড়া উপজেলার হাটুরিয়া-নাকালিয়া ইউনিয়নের জগন্নাথপুর গ্রামের বাসিন্দা বাদশা মোল্লা (৪০)। সাঁথিয়া উপজেলার করমজা ইউনিয়নের তলট গ্রামের মো. লুৎফর মোল্লার মেয়ে মিনারা খাতুনের সঙ্গে ২০০৪ সালে পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়।

বাদশা পড়াশোনা করেছেন হাটুরিয়া জগন্নাথপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে, পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত। তিনি তিন সন্তানের জনক। বড় ছেলে মিরাজুল ইসলাম গ্রামের উচ্চবিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। মেজ ছেলে হাফিজুল ইসলাম পড়ে তৃতীয় শ্রেণিতে। ছোট মেয়ের বয়স মাত্র এক বছর সাত মাস।

শুরুতে নিজের কাজকর্ম ফেলে রেখে বীজ বিতরণ করায় গ্রামের লোকেরা তাকে নিয়ে হাসাহাসি করত। কেউ তাকে পাগলও বলত। এখন নিজ পরিবার ও এলাকাবাসী তাকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেন, তার জন্য মনেপ্রাণে দোয়া করেন। সবাই বলেন, বাদশা অনেক বড় হবেন। তার মতো পরোপকারী মানুষ সব এলাকায় থাকলে দেশ আরও উন্নত হতো।

যার বাড়িতেই পরিত্যক্ত বা পতিত জমি দেখতে পান, তাদের বাড়িতে গিয়ে বিনামূল্যে বীজ দেওয়ার পর সেটি বপন ও পরিচর্যার পথও বাতলে দেন সাইকেল বাদশা। এভাবেই দুই লক্ষাধিক পরিবারের মাঝে সবুজের আলো জ্বেলেছেন সাদামাটা এ মানুষটি। পাবনা শহরে গিয়ে ওসি, এসপি, ডিসি ও কর্মকর্তাদেরও শাকসবজির বীজ দিয়েছেন বলে জানান বাদশা। এখন কোনো কাজে পাবনা শহরে এলে সবাই তার সঙ্গে সেলফি তোলার জন্য ব্যাকুল হয়ে যান।

শুধু তা-ই নয়, জঙ্গি, সন্ত্রাস, মাদক, জুয়া, বাল্যবিবাহ, সুদের কারবারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার কথা বলেন তিনি। যৌতুকের মতো সামাজিক সমস্যাগুলো নিয়েও মানুষদের ডেকে আলোচনা করেন। সময় পেলেই এসব কাজের বিরুদ্ধে লিফলেট তৈরি করে বিভিন্ন এলাকায় বিতরণ করেন। সম্প্রতি মহামারি করোনাভাইরাসের প্রতিরোধে বিনামূল্যে মাস্ক ও সাবান বিতরণ করেছেন কয়েক দফায়। স্বাস্থ্যসুরক্ষা থেকে মানুষকে সচেতন করতে সচেতনতামূলক লিফলেট বিতরণ কনে তিনি।

বাবা আবদুল বাতেন মোল্লা ও মা মনোয়ারা খাতুনের চতুর্থ এই সন্তানের নাম এখন নিজের উপজেলার গণ্ডি পেরিয়ে দেশজুড়ে বয়ে বেড়াচ্ছে। সবাই এখন তাকে ডাকেন ‘সাইকেল বাদশা’ নামে। বীজ বিতরণে বের হলে গ্রামের যুবকরা তার সঙ্গে সেলফি তুলে রাখেন। তাকে নিয়ে ছোট ছোট ভিডিও তৈরি করে ইউটিউব চ্যানেলসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেন এলাকার তারা।

পুরুষদের মাঝেও বীজ দেন বাদশা

হাটুরিয়া জগন্নাথপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ঢাকা পোস্টকে জানান, বাদশা খুবই নম্রভদ্র একজন মানুষ। সে ছাত্রজীবনে মেধাবী ছাত্র ছিলেন। তখন থেকেই সে সমাজের বিভিন্ন সেবামূলক কাজ করত। বর্তমান তার বীজ বিতরণ করা একটি অতি মহৎ কাজ বলে আমি মনে করি।

বাদশা মিয়া তাঁতশ্রমিকের কাজ করে প্রতিদিন আয় করেন ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। তার স্ত্রী মিনারা খাতুনও সংসারের কাজের ফাঁকে তাঁতের কাজ করেন। তাদের দুজনের আয়ে চলে সংসার। তার স্ত্রীও প্রতিদিন শতাধিক মানুষের মাঝে শাকসবজির বীজ বিতরণ করে থাকেন।

সপ্তাহের প্রতি মঙ্গলবার তার তাঁত বোনা বন্ধ থাকে। সপ্তাহের এ দিনটিতেই বাদশা তার ভাঙা সাইকেলটি নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। সাইকেলের সামনে ও পেছনে মানুষকে সচেতন করার জন্য লেখা থাকে সমাজ সচেতনতামূলক বিভিন্ন স্লোগান। সাইকেলের হ্যান্ডেলে ও তার নিজের গলায় ঝোলানো থাকে বিভিন্ন সবজির বীজভর্তি বোতল। ঘুরে বেড়ান গ্রামের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত। চলার পথে কোনো বাড়ির পাশে পতিত জমি দেখলেই মালিককে ডেকে তাদের সবজি চাষে উদ্বুদ্ধ করেন এবং সঙ্গে রাখা বিভিন্ন সবজির বীজ বিনামূল্যে বিতরণ করেন। বিতরণকালে বীজ বপন ও যত্ন করার পদ্ধতিও বলে দেন।

ছোটবেলা থেকেই গ্রামের কেউ বিপদে পড়লে ছুটে যেতেন বাদশা। কাউকে হাসপাতালে নেওয়া, ওষুধ আনা কিংবা ছোট-বড় যে কাজই হোক, বিপদাপন্ন মানুষের পাশে থাকতেন বাদশা। গ্রামবাসীও তাকে দেখে স্নেহের চোখে। ধীরে ধীরে বাদশা হয়ে ওঠেন সবার প্রিয় পাত্র।

জগন্নাথপুর গ্রামের মোছা. সালমা খাতুন বলেন, আগে আমার বাড়ির আঙিনা ফেলে রাখতাম, একদিন বাদশা এসে আমাকে কয়েকটা বীজ দিয়ে গেলেন। আমি সেগুলো লাগিয়ে দিই। এখন আমি নিয়মিত সবজিবীজ লাগিয়ে থাকি। সেই সবজি পরিবারসহ সারা বছর খাই।

সালেহা বেগম নামের আরেক বৃদ্ধা জানান, বাদশা আমাদের বীজ দেয়। তাই আমরা বাড়ির আশপাশে সবজি চাষ করি। খুবই ভালো কাজ করে আমাদের বাদশা। আমাকে সিজনাল বীজ দেয়। লাউয়ের সময় লাউয়ের বীজ আবার পুঁইশাক, জিঙা ইত্যাদির বীজ দেয়।

বাদশা মিয়ার বড় ভাই শাহ আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রথমে যখন বীজ বিতরণ করত কাজকর্ম ফেলে রেখে, অনেক গালাগালি করতাম, কিন্তু যখন দেখতাম এটি সমাজের মহৎকাজ, তখন থেকে উৎসাহ দিতাম। এখন তার সুনাম বেড়া উপজেলাসহ দেশ-বিদেশে বয়ে বেড়াচ্ছে।

কোনো এনজিও, ব্যাংক কিংবা সরকারি তহবিলের সহায়তায় বাদশা এসব করেন না। যাদের তিনি বীজ দিয়ে আসেন, তারাই আবার ফসল থেকে বীজ তৈরি করে দেন তাকে। সেটা আবার গ্রামে গ্রামে গিয়ে বিতরণ করেন বাদশা। ফলে কখনো বীজের সংকট হয় না তার।

নিজের তাঁত মেশিনে তাঁত বোনেন বাদশা

গ্রাম উন্নয়ন সমিতি (গাক) বেড়ার জগন্নাথপুর শাখার ম্যানেজার আবদুল করিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি এই এলাকায় আজ ২০ বছর ধরে বসবাস করি এবং অত্র অঞ্চলে ব্যাংকের লোন দিয়ে থাকি। বাদশা মিয়ার এই বীজ বিতরণ করা দেখলে ব্যাংক থেকে লোন দেওয়ার কথা বলি, কিন্তু বাদশা তাতে রাজি হন না। তার সুনাম এলাকার মানুষের মুখে মুখে। তিনি একজন অত্যন্ত ভালো মানুষ এবং তার উদ্যোগগুলো অত্যন্ত সৎ।

বাদশা আলমের স্ত্রী মিনারা খাতুন বলেন, বিয়ে হওয়ার পর প্রথম দিকে বাদশার এই কাজকে অসহ্য মনে হতো। প্রথম প্রথম এই কাজ করতে বাধা দিতাম। এখন আর দিই না। এখন আর খারাপও লাগে না।

তিনি আরও বলেন, তিনি হাট থেকে ৯০০ টাকা দিয়ে একটি পুরোনো সাইকেল কিনে বীজ বিতরণ শুরু করেন। যদিও এখন তার এক শিক্ষক ৩ হাজার ৫০০ টাকা দিয়ে একটি সাইকেল কিনে দিয়েছেন। আমিও তার কাজকর্মে সহযোগিতা করি।’বাড়িতে প্রতিদিন অনেক মানুষ আসে বীজ নিতে, আমি সেটা বিলি করে থাকি। তিনি জানান, প্রতিদিন বাড়ি থেকে ৫০-১০০ জনের মতো মানুষের মাঝে বীজ বিতরণ করি। কিন্তু নিজেদের সংসারে অভাব থাকলেও কাউকে বুঝতে দিই না।

এ ব্যাপারে বাদশা আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ছোটবেলায় দেখতাম, মা বাড়ির পাশে ফেলে রাখা আঙিনা বা জমিতে বিভিন্ন শাকসবজি লাগাতেন। সবজির বীজ হলে সেগুলো যত্ন করে রাখতেন এবং পাড়া-প্রতিবেশী বাড়িতে এলে তাদের বীজ দিতেন। আমি মাকে জিজ্ঞাসা করতাম বীজ অন্য মানুষকে দাও কেন? মা বলতেন, প্রতিবেশীদের বীজ দেওয়া ভালো। এতে মহান আল্লাহ খুশি হন। প্রতিবেশীদের প্রতি মায়ের এই ভালোবাসা আমাকে উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত করেছে। সেই অনুপ্রেরণা থেকেই বেড়া উপজেলার দুই লক্ষাধিক পরিবারের মাঝে বিভিন্ন সবজির বীজ বিতরণ করেছি। আমার এ কাজ চলমান থাকবে।

দেশের জন্য মানুষের জন্য গর্বিত আমি। কারও উপকার করতে না পারলেও কেউ যেন বলতে না পারে ওমুকের দ্বারা ক্ষতি হয়েছে। সমাজের ভালো কাজ করতে পারলে আমি আনন্দ পাই। কারও কষ্ট পাওয়া মানে আমি কষ্ট পাই। মানুষকে খুশি করাই আমার তৃপ্তি।

বাদশা মিয়া

তিনি বলেন, আমি এখন পর্যন্ত কারও থেকে কিছু চাইনি। সরকারের অনুদান গরিব মানুষকে বিলিয়ে দেওয়াই আমি চাই। আমি তো কোনোমতে চলতে পারি। অনেকে আছে তারা দুই বেলা পেট ভরে খেতে পারে না। তাদের জন্য আমি কাজ করে যাব। সমাজের মানুষ সুখে থাক, সেটাই আমি চাই। আমি চাই আমার উপজেলার কোনো বাড়ির আঙিনা যেন খালি পড়ে না থাকে। সবুজের আলোয় আলোকিত হোক প্রতিটি বাড়ির আঙিনা।

হাটুরিয়া-নাকালিয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বাদশা দীর্ঘদিন ধরে প্রতিটি বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে শাকসবজির বীজ বিতরণ করে আসছেন। তিনি রাস্তার ধারে খালি জায়গায় বিভিন্ন ধরনের ছায়াদান গাছও বিতরণ করেন। শুধু এটাই নয়, মাদক, বাল্যবিবাহ, ইভটিজিং, সুদের ব্যবসা সম্পর্কে তিনি সমাজের প্রতিটি বাড়িতে সচেতনতা তৈরি করে বেড়াচ্ছেন।

চেয়ারম্যান আরও বলেন, আমি জানি তিনি একজন অতিদরিদ্র মানুষ। কোনোমতে দিন চলে। ভাঙাচোরা টিনের ঘরে ছেলেমেয়ে নিয়ে কষ্টের মধ্যে দিন পার করেন। আমি তার জন্য একটি সরকারের আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর বরাদ্দ দেব এবং সরকারের বিভিন্ন সময়ের উপহারসামগ্রী দিয়ে তাকে সহযোগিতা করব, ইনশা আল্লাহ।

এনএ