ফরিদপুরে ভালো নেই কৃষিশ্রমিকরা
‘আর পাইরা উঠি না বাবা, সবকিছুর যে দাম’
‘আমাগো দেখার আসলে কেউ নাই। ওপরে ওপরে অনেকেই দরদ দেখায়। আসলে কেউ মনে রাখে না। এই বয়সে আইসাও নিজের কষ্ট করা লাগে। আর ভালো লাগে না। চার ছেলে ও তিন মেয়ের মধ্যে পাঁচজনকে বিয়ে দিয়েছি। দুই মেয়ে এখনো অবিবাহিত। তাদের খরচ কোনো ছেলেরা দেয় না। ছেলেদের সবার আলাদা সংসার। এই বয়সে আর পাইরা উঠি না বাবা, সবকিছুর যে দাম।’
কথাগুলো বলছিলেন ফরিদপুরের জনের হাটে শ্রম বিক্রি করতে আসা কৃষিশ্রমিক জমির শেখ (৬০)। দীর্ঘ ৩৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে কৃষিশ্রমিক হিসেবে কাজের ফলে তার অভিজ্ঞতার ভাণ্ডারও অফুরন্ত।
বিজ্ঞাপন
জমির শেখ বলেন, এই জনের হাটে দিনে ২৫ টাকা দামে বিক্রি হয়েছি। তখন আমাদের যেমন দাম ছিল তার চেয়ে এখন যদি দশগুণ বাড়ে, একশগুণ বেড়েছে পণ্যর দাম। তেল, চাল, ডাল, মরিচ, লবন, ডিম কোন জিনিসটার দাম বাড়ে নাই? কিন্তু এই কথা কারে কবো? কথা কওয়া যায় না। বিপদ।
নিজের কষ্ট এই জন্যে কাউরে কই না। ভালো থাকি, মন্দ থাকি নিজেই থাকি।’
কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের কৃষিশ্রমিক মিলন সাই (৫৭)। তিনি জানান, তিন ছেলে ও এক মেয়ের বাবা তিনি। মেয়ের বিয়ে হয়েছে। ছেলেরাও বিয়ে করে আলাদা সংসার পেতেছেন। পৈতৃকসূত্রে তিনি ২৬ শতাংশ জায়গা পেয়েছিলেন। যার ওপর তার বর্তমান বসতঘর রয়েছে। ঘরে স্ত্রী আছেন। তিনি আগে অন্যদের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করতেন। বয়স বাড়ায় বছর পাঁচেক ধরে তাও করছেন না। স্ত্রীকে নিয়ে তার সংসার। মেয়ে একটি কন্যা ও একটি পুত্র সন্তানের মা। মাঝে মাঝে মেয়ে তার দুই সন্তান নিয়ে বাবার বাড়িতে বেড়াতে আসত। কিন্তু বৃদ্ধ বাবার অভাবের সংসারে মেয়েও তার সন্তানদের নিয়ে আসতে চায় না। আগে মাঝে মাঝে মেয়ে বাবা-মায়ের পক্ষ নিয়ে ভাইদের সঙ্গে ঝগড়া করত কেন বাবাকে এই বয়সে খাটুনির কাজ করতে হবে, তারা কেন বাবা মাকে খাওয়াবে না- এসব নিয়ে। কাজ না হওয়ায় অভিমান করে মেয়েও বাবার বাড়িতে আসে না প্রায় তিন বছর হলো।
মিলন সাই বলেন, ‘যে ঈদ দুইডা গেল তাও বাড়ি যাই নাই। রোজার ঈদ করছি এক চেনা গৃহস্তের বাড়িতে। কোরবানির ঈদে বাদাম তোলার কাজ করছি শিবচরে। ঈদে স্ত্রীর জন্য মন মতো টাকাও পাঠাইতে পারি নাই। বয়স হওয়ায় কাজ কম পারি বলে অন্যান্য শ্রমিকের চেয়ে ১০০-১৫০ টাকা কমে বিক্রি হতে হয়। আবার অনেক সময় গৃহস্তের বাড়িতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকি। এভাবেই কোনো রকমে বেঁচে আছি।’
অন্যান্য হালকা কোনো কাজ করার চেষ্টা করেছেন কিনা- জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাড়িতে অনেক আগে নসিমন (পণ্যবাহী থি-হুইলার) চালানোর চেষ্টা করেছিলাম। তখন নসিমন চালানোর চেয়ে এইকাজই সহজ লাগত। কারণ নসিমন চালালে অনেক ভারী জিনিস টানতে হত। কৃষিকাজের কষ্টকে কিছু মনেই হতো না। এখন বয়স হওয়ায় আর পেরে উঠি না।
আরেক কৃষিশ্রমিক শাহজাহান বলেন, এখন পেট চালানোর জন্যই দেহ চালাই, দেহ না চালাইলে পেটটা চলে না বাবা।
নাটোরের বড়াইগ্রাম এলাকার কৃষিশ্রমিক সাইফুল ইসলাম (৪২) জানান, তিনিসহ একই এলাকার আশরাফুল ইসলাম (৩৮) কয়েক দিন আগে মাদারীপুরের শিবচরে বাদাম তোলার কাজ করে এসেছেন দুদিন। কিন্তু মালিক তাদের ৬৫০ টাকা করে দুইজনের দুদিনের দুই হাজার ৬০০ টাকা পাওনা পরিশোধ করেননি।
তিনি বলেন, বাবার সঙ্গে ছোটবেলা থেকেই এই হাটে এসে পাশের নগরকান্দা, সালথা, মুকসুদপুর ও তালমা এলাকায় কাজ করেছি। কিন্তু কেউ টাকা মেরে খায়নি। শিবচরে দুদিনের টাকা না পেয়ে আবার এসে হাটে উঠেছি। এবার পাটের কাজে যাব।
নওগাঁর আত্রাইল এলাকার মোফাজ্জল (৫০) বলেন, ‘অনেক মালিক আইসা ১০ টাকা কমে নেওয়ার জন্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘোরে, রোদে পোড়ে, আমাগোও পোড়ায়। কিন্তু ১০ টাকা বেশি দামে নিতে চায় না।’
ঝিনাইদহের হরিনাকুন্ডু থানার জিন্নাহ বিশ্বাস (৪৬) বলেন, বর্তমানে ৬৫০ থেকে ৭৫০ টাকা পর্যন্ত আমাদের দাম উঠছে। এখন পাটের কাজ করতে আমাদের নেওয়া হচ্ছে। ধান কাটার সময়ও দাম ভালো থাকে। তবে ধানের চেয়ে পাটের কাজে খাটুনি বেশি।
জানা গেছে, ফরিদপুরের এ জনের হাটে প্রতিদিন অন্তত সহস্রাধিক লোক বিক্রি হওয়ার জন্য হাজির থাকে। বেশির ভাগ মানুষ উত্তরের রংপুর, নওগাঁ, জয়পুরহাট, লালমনিরহাট, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জের। এছাড়া ঝিনাইদাহ, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুরের লোকও আসেন। জনের হাটে দিনমজুররা আসেন কাজের সন্ধানে। পেঁয়াজ লাগানো, তোলা, পাট বপন, টানা, বাছা, সার ও ওষুধ দেওয়া ইত্যাদি কাজে। এছাড়াও ধান কাটা, বাদাম তোলা, মসুরি, খেসারি, কালাইসহ বিভিন্ন প্রকার ফসলের মাঠে কাজ করেন এসব লোক।
উত্তরের জেলাগুলোর শ্রমিকরা জানান, তাদের এলাকায় দিনমজুরের দাম কম। একদিন খাবার দেওয়ার পর পারিশ্রমিক দেয় দুই থেকে আড়াইশ টাকা। কিন্তু দক্ষিণের জেলাগুলোতে দিনমজুরের দাম বেশি। বিশেষ করে পাট বপন, কাটা, পেঁয়াজ লাগানো ও উঠানো এবং ধান কাটার সময় চাহিদা অত্যধিক থাকায় দাম তখন থাকে আকাশচুম্বী। এ সময় দিনে তিন বেলা খাবার, থাকার জায়গা বাদেই পারিশ্রমিক হিসেবে দেওয়া হয় ৬০০-৭৫০ টাকা।
ফরিদপুরের জনের হাটটি জমজমাট। এ হাট থেকে ফরিদপুর ছাড়াও মাদারীপুর, শরীয়তপুর, গোপালগঞ্জ, বাগেরহাট এমনকি বরিশালেও শ্রমিক কিনে নিয়ে যান কৃষিজমির মালিকরা।
আগে হাটটি ফরিদপুর শহরের গোয়ালচামট মহল্লার ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের উত্তর পাশে পৌরসভার পানি শোধনাগারের পূর্বদিকে ছিল। মাস খানেক আগে হাটটি সরিয়ে পাশেই শিশুপার্ক সংলগ্ন এলাকার জিলু কমিশনারের বাড়ির পাশে নেওয়া হয়েছে। সেখানে প্রতিদিন সহস্রাধিক মানুষের আনাগোনা হয়। এছাড়াও সেখানে পাঁচটি কাস্তের দোকান, তিনটি খাবার হোটেল ও হ্যান্ডব্যাগ, ক্যাপ ও কম দামি পোশাকের দুইটি দোকান রয়েছে। এসব দোকানের ক্রেতাও শ্রমিকরা।
জনের হাটের একটি হোটেলের মালিক মো. শামসুল আলম বলেন, সকাল ৬টায় আমরা হোটেলগুলো খুলি এবং রাত ৮টায় হোটেল বন্ধ করি। আমাদের খদ্দের মূলত এসব শ্রমিক। শ্রমিকদের যখন মালিকরা কিনে নেন তখন তাদেরকে ভাত খাইয়ে নিয়ে যান। অনেকে আবার খাওয়ান না। আমরাও গরিব এসব শ্রমিকের কথা চিন্তা করে অন্যান্য জায়গার চেয়ে কম মূল্যে খাদ্য পরিবেশন করে থাকি।
তিনি বলেন, আমাদের এখানে মুরগির মাংস প্রতি পিস ৫০ টাকা, সিলভার কার্প মাছ ও পাঙাশ মাছ ৩০ টাকা এবং ডিম ৩০ টাকা। বাইরের চেয়ে কম দামে খাবার দেওয়ায় তারা আমাদের এখান থেকেই খায়।
জনের হাটে আকার ও কাঁচামালের পার্থক্যে ১৮ প্রকার কাস্তে বিক্রি করছেন বিক্রেতা মোহাম্মদ সেলিম বয়াতি (৫০)। তিনি জানান, ব্লেড ও রডের তৈরি ৬০ টাকা থেকে শুরু করে করে ৪৫০ টাকা পর্যন্ত বিভিন্ন প্রকার কাস্তে বিক্রি করেন। বর্তমানে পাট কাটায় বড় কাস্তে প্রয়োজন হওয়ায় এসব কাস্তের চাহিদা বেশি রয়েছে। কমবেশি এখানে সারা বছরই কাস্তে বিক্রি হয়। তবে গম, পাট ও ধান কাটার মৌসুমে বিক্রি হয় সবচেয়ে বেশি।
জহির হোসেন/আরএআর