যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দরের আন্তর্জাতিক প্যাসেঞ্জার টার্মিনাল দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ৫ থেকে ৭ হাজার যাত্রী বাংলাদেশ-ভারত যাতায়াত করেন। এর মধ্যে অনেকে ভারতে যান চিকিৎসার উদ্দেশ্যে আবার কেউ যান আত্মীয়-স্বজনদের কাছে। বর্তমানে বেনাপোল কাস্টমস কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে বেনাপোল ইমিগ্রেশনে পাসপোর্ট যাত্রীদের নির্বিঘ্নে যাতায়াতের ব্যবস্থা করা হলেও পেট্রাপোল বন্দর দিয়ে ভারতফেরত যাত্রীদের বাংলাদেশে প্রবেশের আগে চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। 

সরেজমিনে বেনাপোল বন্দরে দেখা যায়, বৃহস্পতিবার (২১ জুলাই) বাংলাদেশ থেকে ভারতে যান প্রায় আড়াই হাজার যাত্রী। ভারত থেকে দেশে ফেরেন প্রায় তিন হাজার যাত্রী। নোমান্সল্যান্ডে প্রবেশের অনুমতি চেয়ে প্রায় তিন ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর  প্রবেশের অনুমতি পেলে ভারতের নোমান্সল্যান্ডে প্রবেশ করে দেখা যায় ভারতফেরত যাত্রীদের দুর্বিষহ ভোগান্তি। খোলা আকাশের নিচে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে রোদে পুড়ছে আবার কখনো বৃষ্টিতে ভিজছেন যাত্রীরা। কেউ কেউ দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে থাকায় অসুস্থ হয়ে পড়ছেন।

ভারতফেরত যাত্রীদের অভিযোগ, ভারতীয় ইমিগ্রেশনে ১২টি বুথে মাত্র ২-৩ জন স্টাফ সার্ভিস দেওয়ায় এবং ইমিগ্রেশনের মধ্যে ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়ায় ধীরগতির কারণে যাত্রীদের দীর্ঘ-লাইনের সৃষ্টি হয়। ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশের আগ মুহূর্তে পেট্রাপোল বন্দরের নোমান্সল্যান্ডে চেকিং এবং ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য দীর্ঘ লাইন দিয়ে বাহিরে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ যাত্রীদের। এতে তীব্র রোদ আর গরমে যাত্রীরা অসুস্থ হয়ে পড়েন। 

আবার কখনো ইমিগ্রেশনের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র হাতে নিয়েই বাইরে লাইনে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে হয়। তবে মেডিকেল ভিসায় ভ্রমণকারী যাত্রীদের এসব ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার থাকায় তাদের দুর্ভোগ কম। 

এদিকে পেট্রাপোল বন্দরে কুলি ও দালালদের বিরুদ্ধে জনপ্রতি যাত্রীদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে সিরিয়াল ভঙ্গ করে আগে আগে ইমিগ্রেশন পার করে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। শুধু তাই নয়, এ বন্দরে বিএসএফের দুর্ব্যবহারের শিকার হতে হয় বলে অভিযোগ যাত্রীদের। 

ভারতে চিকিৎসা নিয়ে দেশে ফেরা যাত্রী চট্টগ্রামের ফারজানা জাবির ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা বৃহস্পতিবার সকাল ৯টায় পেট্রাপোলে এসে পৌঁছাই। সেখানে সোহাগ পরিবহনে করে আসি। তারাও আমাদের কাঙ্ক্ষিত সেবাটা দেয়নি। নোমান্সল্যান্ডে আমাদের দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। সোহাগ পরিবহনের ওপাশের দায়িত্বে থাকা স্টাফ এবং কুলিরা আগে আগে ইমিগ্রেশন পার করে দেওয়ার কথা বলে আমাদের কাছ থেকে ৫০০ টাকা করে নিয়েছেন। তবুও তারা কিছুই করেননি, শুধু মাত্র আমাদের মালামালটা বহন করে দিয়েছেন। অন্যদিকে বিএসএফ সদস্যদের দুর্ব্যাবহারের শিকার হতে হয়েছে।

ভারতের নবদীপ দর্শন শেষে দেশে ফেরা রাঙামাটির শংকর ঢালী ঢাকা পোস্টকে বলেন, সকাল ৮টা থেকে আমি ইন্ডিয়ান ইমিগ্রেশনে লাইনে দাঁড়িয়ে বিকেল ৩টায় বাংলাদেশে প্রবেশ করলাম। পেট্রাপোল ইমিগ্রেশনে ১২টি বুথে মাত্র ২ থেকে ৩ জন কাজ করছে। তাদের জনবল কম এবং কাজে ধীরগতির কারণে যাত্রীরা লাইনে দাঁড়িয়ে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করাসহ নানা ভোগান্তির শিকার হচ্ছে।

ভারতে থেকে ঈদের ছুটি কাটিয়ে দেশে আসা চট্টগ্রামের ইসতিয়াক আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, বেনাপোল বন্দরে আগে যেমন ভোগান্তি ছিল, তেমন ভোগান্তি এখন আর নেই। এ বন্দরে যথেষ্ট জনবল নিয়োগ করা হয়েছে। তবে পেট্রাপোলের ভারতীয় ইমিগ্রেশনে কর্মচারীদের কাজে ধীরগতির কারণে আমাদের দীর্ঘ ৬ থেকে ৭ ঘণ্টা লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। এর আগে দুইবার গিয়েছি, একই সমস্যায় পড়েছি।

মেডিকেল ভিসায় ভারতফেরত যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মেডিকেল ভিসায় যাতায়াত করা রোগীদের খুব বেশি চেকিং করা হয় না। বন্দরের দুই পাশের ইমিগ্রেশনেই তাদের অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে।

গোপালগঞ্জের মালতি বিশ্বাস বলেন, আমি মেয়েকে নিয়ে ভারতে চিকিৎসার উদ্দেশ্যে গিয়েছিলাম। দুই মাস পর ফিরছি। ক্যানসারের রোগী বলে আমাদের আগে আগে চেকিং করে ছেড়ে দিয়েছে। তবে ওপারে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা অন্যান্য ভিসার যাত্রীদের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।

এদিকে বেনাপোল বন্দরের আন্তর্জাতিক প্যাসেঞ্জার টার্মিনালের সামনের অংশের বহিঃবিভাগ থেকে শুরু করে ইমিগ্রেশনের ভেতরে সাংবাদিকদের ছবি তুলতে অনুমতি নিতে হচ্ছে। এছাড়াও সাংবাদিকদের সংবাদ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ইমিগ্রেশনের ভেতরে প্রবেশের জন্য এবং নোমান্সল্যান্ডে প্রবেশের জন্য আলাদা আলাদাভাবে ইমিগ্রেশন ওসি, কাস্টম কতৃপক্ষ এবং বিজিবি ব্যাটালিয়ন প্রধানের অনুমতি সাপেক্ষে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়। 

এই প্রতিবেদক সংবাদ সংগ্রহের জন্য ইমিগ্রেশন ও নোমান্সল্যান্ডে প্রবেশের অনুমতি চাইলে প্রায় তিন ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর বিজিবি ব্যাটালিয়ন কর্মকর্তার কাছ থেকে অনুমতি মেলে। তবে ইমিগ্রেশনের ভেতরে ছবি বা ভিডিও ধারণের অনুমতি পাওয়া যায়নি। বেনাপোল ইমিগ্রেশনের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রাজু আহমেদের কাছে অনুমতি চাইলে তিনি রাজস্ব কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে অনুমতি নিতে বলেন। রাজস্ব কর্মকর্তার অনুমতি চাইতে গেলে তাকেও অফিস কক্ষে পাওয়া যায় না। ফলে বেনাপোল ইমিগ্রেশনে যাত্রীদের দুর্ভোগ না থাকলেও সাংবাদিকদের সংবাদ সংগ্রহের ক্ষেত্রে বেশ ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।

বেনাপোল কাস্টম সূত্রে জানা যায়, গত ঈদুল আজহার আগে এবং পরে বেনাপোল বন্দর দিয়ে প্রতিদিন প্রায় সাত-আট হাজার যাত্রী ভারতে যান। ভোগান্তির কথা চিন্তা করে বেনাপোল ইমিগ্রেশনে জনবল বৃদ্ধি করা হয়েছে। ফলে এ সময় যাত্রীদের কোনো প্রকার ভোগান্তি হয়নি। ঈদের আগে বেনাপোল বন্দরকে দালাল ও সিন্ডিকেটমুক্ত করেছে কাস্টম কর্তৃপক্ষ। 

ভারতের পেট্রাপোলে ভারতফেরত যাত্রীদের দুর্ভোগের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বেনাপোল কাস্টমসের কমিশনার আজিজুর রহমান ঢাকা পোস্টকে জানান,পেট্রাপোল বন্দরে যাত্রীদের ভোগান্তির বিষয়টি সম্পূর্ণ ওপাশের ব্যাপার। তবে আমাদের বেনাপোল বন্দরে যাত্রীরা স্বাচ্ছন্দ্যে চলাচল করছে। নোমান্সল্যান্ডে যাত্রীদের ভোগান্তির বিষয়টি নিয়ে এর আগেও তাদের সমাধানের জন্য বলা হয়েছে। তারা বলছে যে যাত্রীদের জন্য বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ বিষয়ে তিনি এই প্রতিবেদককে ভারতীয় দূতাবাসের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।

আরএআর