মেয়েদের কষ্ট দেখে মরে যেতে ইচ্ছে করে মায়ের
আনোয়ার হাওলাদার। বয়স ৫৫ বছর। সবাই তাকে আনোয়ার ফিটার নামেই চেনেন। তিনি শারীরিক ও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী তিন মেয়েকে নিয়ে দুঃখ-দুর্দশায় জীবনযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। ট্রলারের ইঞ্জিন মেরামতের সামান্য আয় দিয়ে তিন ছেলের লেখাপড়ার খরচ ও প্রতিবন্ধী তিন মেয়ের ভরণপোষণ চালাচ্ছেন।
এর মধ্যে বসতভিটার জমি নিয়ে মামলা চালাতে গিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। ফলে তিনি প্রতিবন্ধী মেয়েদের উন্নত চিকিৎসা করাতে পারছেন না। চিকিৎসার অভাবে চোখের আলো ফিরছে না দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী দুই মেয়ে সুরাইয়া ও সুমাইয়ার। ঘরে বসে ধুকে ধুকে মরছে বড় মেয়ে মিনারা।
বিজ্ঞাপন
আনোয়ার হাওলাদার পটুয়াখালীরর মহিপুর থানার লতাচাপলী ইউনিয়নের খানাবাদ গ্রামে বাসিন্দা। তিনি ট্রলারের পুরোনো ইঞ্জিন মেরামত করেন। এ পেশায় বেশ সুনাম রয়েছে তার। চার ছেলে ও চার মেয়ের জনক তিনি। এর মধ্যে এক মেয়ে শারীরিক প্রতিবন্ধী আর দুই মেয়ে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী
আনোয়ার ফিটারের আট সন্তানের মধ্যে সবার বড় মিনারা বেগম (২৮)। বাগেরহাটের ফুলহাতা গ্রামের মহিদুল ইসলামের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল তার। বিয়ের দুই বছরের মাথায় একটি সন্তান জন্ম দিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। চিকিৎসা করাতে গিয়ে প্যারালাইসিস হয়ে শরীরের ডান অংশ অবস হয়ে যায় তারা। ২১ দিনের দিন তার নবজাতক শিশুটি মারা যায়। দেড় মাস পর স্বামী মহিদুল ইসলাম স্ত্রী মিনারা বেগমকে ফেলে চলে যান। গত ১০ বছর যাবৎ বাবা আনোয়ার ফিটারের কাছে থাকছেন মিনারা। মাঝে মধ্যে দুই পায়ে ব্যথা হলে হাঁটতে পারেন না। সামান্য চিকিৎসা করিয়েছেন বাবা। গত ১০ বছর যাবৎ বাবা-মায়ের সঙ্গে বসবাস করছেন শারীরিক প্রতিবন্ধী মিনারা বেগম।
মিনারা বলেন, বাবার ঘরে থাকতে নিজেরও খারাপ লাগে। বাবার কষ্ট দেখে পায়ের ব্যথা ভুলে যাই। বাবা-মাকে ব্যথার কথা বলি না।
আনোয়ার ফিটারের দ্বিতীয় সন্তান শাহনাজ বেগম (২৬)। বড় মেয়ে মিনারা বেগম ঘরে ফিরে আসার বছরে শাহনাজ বেগমের বিয়ে হয় বারেকগঞ্জের বেহারীপুর গ্রামের মামুনের সঙ্গে। শাহনাজের স্বামী মামুন ঢাকায় বালুর জাহাজে কাজ করেন। দুই সন্তান নিয়ে তাদের সংসার মোটামুটি ভালোই চলছে।
তৃতীয় সন্তান মো. শাহআলম (২৪) বাবার মতো একই পেশায় যুক্ত। বিয়ে করে বরগুনার তালতলী উপজেলার সওদাগরপাড়া গ্রামে বসবাস করছেন। তার একটি ছেলে সন্তান রয়েছে। নিজের সংসার চলাতে কষ্ট হয় তাই বাবার সংসারে খরচ দিতে পারেন না।
চতুর্থ সন্তান মো. মিরাজ পটুয়াখালী সরকারি কলেজের ইতিহাস বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। পঞ্চম সন্তান মো. রিয়াজ ঢাকার বাংলা কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে চতুর্থ বর্ষে লেখাপড়া করছে। ষষ্ঠ সন্তান মো. শাহিন পটুয়াখালী সরকারি কলেজের ইতিহাস বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র।
এরপর আনোয়ার হাওলাদার দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী জমজ মেয়ের বাবা হন। তাদের নাম রাখেন সুরাইয়া আক্তার ও সুমাইয়া আক্তার। তাদের বয়স এখন ১৩ বছর। ঢাকার ইসলামী চক্ষু হাসপাতালে চোখের চিকিৎসা করতে গিয়ে সুরাইয়ার ডান চোখে ক্যান্সারের জীবাণু ধরা পড়ে। চোখ তুলে ফেলেন চিকিৎসক। বাম চোখটি তুলে নতুন চোখ স্থাপন করলেও আলো ফেরেনি। সুরাইয়া দুই চোখে কিছু দেখতে পায় না। ছোট বোন সুমাইয়ার দুই চোখ নষ্ট জন্ম থেকে। চিকিৎসক লেন্স স্থাপন করেছেন। ডান চোখে আলো ফেরেনি। বাম চোখে সামান্য দেখতে পায় সে। এক চোখ দিয়ে লেখাপড়া করছে সুমাইয়া। সে আমজেদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে।
চিকিৎকরা বলেছেন- দেশের বাহিরে উন্নত চিকিৎসা করতে পারলে ভালো হওয়ার সম্ভবনা আছে। কিন্তু অর্থাভাবে মেয়েদের চিকিৎসা করাতে পারছেন না বাবা আনোয়ার ফিটার। ফলে সুরাইয়া ও সুমাইয়াকে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হিসেবে বেঁচে থাকতে হচ্ছে আমৃত্যু। চোখের আলো ফিরে পেয়ে লেখাপড়া করে মানুষের মতো মানুষ হতে চায় সুরাইয়া ও সুমাইয়া।
সুরাইয়া বলে, আমার পৃথিবীটা দেখতে খুব ইচ্ছা করে। ভালো চিকিৎসা করলে হয়তো দেখতে পেতাম।
সুমাইয়া বলে, মাঝে মধ্যে আমার চোখে ব্যথা করে, খুব কষ্ট হয় আমার। আব্বা টাকার অভাবে চিকিৎসা করতে পারেন না।
আনোয়ার ফিটারের স্ত্রী মোসা. রোকেয়া বেগম বলেন, আমার এখন বয়স হয়েছে। নিজের শারীরিক অবস্থা ভালো না। সংসারে কাজের শেষ নেই। কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ি। তারপরও প্রতিবন্ধী তিন মেয়ের সেবা-যত্ন করতে হয়। আর পারছি না। ওদের কষ্ট দেখলে মরে যেতে ইচ্ছা করে। ভালো চিকিৎসা করাতে পারলে আমার মেয়েরা স্বাভাবিক জীবন ফিরে পেতো।
এদিকে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে ৪৮নং পোল্ডারের বেড়িবাঁধ উন্নয়নের কাজ চলমান রয়েছে। আনোয়ার ফিটারের বাড়ি এই বেড়িবাঁধ লাগোয়া। বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে গেছে দিয়ারআমখোলা খাল। এই খালের মুখে নির্মাণ করা হচ্ছে জলকপাট। খাল পুনর্খনন ও জলকপাট নির্মাণের জন্য আনোয়ার হাওলাদারের বাড়ির অর্ধেক জমি অধিগ্রহণ করছে সরকার। ঘর অপসারণ ও গাছপালার ক্ষতিপূরণের টাকাও উত্তোলন করতে পারছেন না তিনি। তার বাড়ির জমি নিয়ে কুয়াকাটা খানাবাদ ডিগ্রি কলেজের প্রতিষ্ঠাতা আলহাজ জহিরুল ইসলাম খান মামলা করেছেন। এতে জমি অধিগ্রহণ ও ক্ষতিপূরণের টাকা উত্তোলন করা সম্ভব হচ্ছে না।
এ প্রসঙ্গে আনোয়ার ফিটার বলেন, জমি অধিগ্রহণের টাকা পেলে মেয়েদের উন্নত চিকিৎসা করাতে পারতাম। মেয়েদের কষ্ট বাবা হয়ে সহ্য করতে পারছি না। যারা আমাকে জমি রেখে দিয়েছেন তারাই আবার মালিকানা দাবি করে মামলা করছেন। কার কাছে বিচার চাইবো ঠিক বুঝতে পারছি না।
আনোয়ারের প্রতিবেশী মো. মজিবুর রহমান, আবুল কালাম ও রিপন বেপারীর সঙ্গে কথা হয়। তারা বলেন, ‘প্রতিবন্ধী তিনটি মেয়ে নিয়ে আনোয়ার ফিটার খুবই কষ্টে আছেন। টাকার অভাবে মেয়েদের চিকিৎসা করতে পারছেন না। বসতভিটার জমি অধিগ্রহণের টাকা উত্তোলন করতে পারলে চিকিৎসা করা সম্ভব হতো।
লতাচাপলী ইউনিয়ন পরিষদের ৪ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য সদস্য মো. জাফর উদ্দিন কুতুব বলেন, আমরা ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে সাধ্য অনুযায়ী আনোয়ার হাওলাদারের পাশে আছি। ইতোমধ্যে তার এক মেয়েকে প্রতিবন্ধী ভাতার আওতায় এনেছি। পরবর্তীতে বাকি দুই মেয়েকে প্রতিবন্ধী ভাতার আওতায় আনা হবে।
এ ব্যাপারে লতাচাপলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আনছার উদ্দিন মোল্লা বলেন, আনোয়ারের পরিবারের দিকে আমাদের সজাগ দৃষ্টি আছে। ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে তাদের পাশে আছি। তাদের বসতভিটার জমি অধিগ্রহণের টাকা দ্রুত দেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে অনুরোধ করছি।
কাজী সাঈদ/আরএআর