রুপালি ইলিশের বাড়ি বলে খ্যাত চাঁদপুরে ইলিশ নেই। পদ্মা-মেঘনা নদীতে ভোর থেকে শুরু করে মধ্যরাত পর্যন্ত ইলিশের আশায় জাল ফেলেও দেখা মিলছে না কাঙ্ক্ষিত ইলিশের। ইলিশ না পেয়ে হতাশ হয়ে তীরে ফিরছেন জেলেরা। আর যে ইলিশ ধরা পড়ছে তা বিক্রি করে ট্রলারের তেলের খরচই উঠছে না। তবে মৎস্য কর্মকর্তারা বলছেন, বৃষ্টি বাড়লেই ধরা পড়বে ইলিশ।

জানা গেছে, চাঁদপুরে পদ্মা-মেঘনার উপকূলীয় এলাকায় ৪৪ হাজার ৩৫ জন কার্ডধারী ও নিবন্ধিত জেলে পরিবার রয়েছে। বছরের বেশির ভাগ সময় নদী থেকে মাছ আহরণ করে তারা জীবিকা নির্বাহ করেন।

সরেজমিনে চাঁদপুর সদর ও হাইমচর উপজেলার জেলেপাড়াগুলোতে দেখা গেছে, অধিকাংশ জেলে অলস সময় পার করছেন। কেউ নৌকা মেরামত করছেন, কেউ আবার জাল মেরামত করছেন। নিষেধাজ্ঞা না থাকলেও মাছ আহরণ না করে জেলেরা সময় কাটাচ্ছেন চা দোকানে আড্ডা দিয়ে।

সদর উপজেলার পুরান বাজারের রনাগোয়াল, লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের স্লুইসগেট, বহরিয়া বাজার, হরিণা ফেরিঘাট, তরপুরচন্ডী ইউনিয়নের আনন্দ বাজার, বাংলাবাজার, রালদিয়া ও বিষ্ণুপুর ইউনিয়ন, হাইমচরের চরভৈরবী এবং নীল কমল এলাকায় জেলেদের সঙ্গে আলাপকালে এসব কথা জানা যায়।

লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের স্লুইসগেট এলাকায় ফারহাদ জাল মেরামত করছিলেন। তিনি বলেন, গতকাল আমরা গাঙে গেছিলাম। একটা মাছ পাইছি। আমাদের ৩-৪ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। এতে আমাদের পোষায় না। তারপরও যাই মাছ পাওয়ার আশায়। যে পরিমাণ মাছ পাওয়ার কথা, তা পাচ্ছি না। সরকার অভিযান দিয়েছে আমাদের উপকারের জন্য। কিন্তু এই অভিযান আরও ১৫ দিন বাড়ালে ভালো হবে। এতে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে।

হরিণাঘাটে মাছ নিয়ে আসা এক জেলে বলেন, ৪ ঘণ্টা নদীতে জাল ফেলে একটা ইলিশ পেয়েছি।

কাঙ্ক্ষিত ইলিশ না থাকায় হরিণাঘাটে কক্সবাজার থেকে আসা মনিরুল ইসলাম বলেন, ইলিশ চাঁদপুরের ব্র্যান্ডিং পণ্য।তাই এখানে ইলিশ কেনার জন্য আসলাম। কিন্তু ইলিশের যে দাম, তা আমাদের মতো মধ্যবিত্তদের কেনা কঠিন হয়ে পড়েছে।

ঢাকা থেকে আসা শিখা ইসলাম বলেন, ঈদ উপলক্ষে আমি ঢাকা থেকে এসেছি চাঁদপুরের ইলিশের স্বাদ নেওয়ার জন্য। কিন্তু এখানে এসে দেখি, ইলিশ কম থাকায় দাম অনেক বেশি।

হারিণা ফেরিঘাটের আড়তদার সুজন বলেন, নদীতে জেলেরা ইলিশ পাচ্ছে না। যার কারণে অনেক জেলে নদীতে ঠিকমতো যাচ্ছেও না। জেলেরা নদীতে ভালো মাছ না পাওয়ায় আমরা আড়তদাররা মাছ ক্রয়-বিক্রয় করতে পারছি না। সারাদিন ঘাটে বসে অল্প মাছ কিনতে পেরেছি। যে কারণে মাছের দাম বেশি।

হরিণাঘাটে আসা লক্ষ্মীপুর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য হাবিবুর রহমান টিটু বলেন, জেলেরা কাঙ্ক্ষিত ইলিশ না পাওয়ায় হতাশা দেখা দিয়েছে। তাদের ইউনিয়ন পরিষদ থেকে যতটুকু সহযোগিতা প্রয়োজন আমরা ব্যবস্থা করব।

জেলে আব্দুল রহমান হাওলাদারসহ কয়েকজন বলেন, আমরা বর্ষার শুরুতে নদীতে মাছ ধরতে এসেছি। এখান থেকেই দাদন নিয়েছি। মাছের যে অবস্থা দাদন কীভাবে শোধ করব তা নিয়েই চিন্তায় আছি। সাগর থেকে পদ্মা-মেঘনা নদীতে ইলিশ আসার পথে বিভিন্ন বাধার সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন স্থানে চর জেগে ওঠা ও পানি দূষণের কারণে আমার আগের মতো রুপালি ইলিশ পাচ্ছি না। এ কারণে অনেক জেলে এখন বেকার রয়েছেন।

এদিকে চাঁদপুর মাছ ঘাটে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ইলিশ আসা শুরু হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার থেকে শনিবার পর্যন্ত ৫-৭শ মণ ইলিশ এসেছে। রোববার সকাল থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত ১০ হাজার থেকে ১২ হাজার মণ ইলিশ সরবরাহ করা হয়। তবে সরবরাহ হলে দাম এখনো ত্রেতাদের নাগালের বাইরে রয়েছে। 

চাঁদপুর মাছ ঘাটে চট্টগ্রাম থেকে আসা এক ক্রেতা বলেন, আমি চট্টগ্রাম থেকে এসেছি চাঁদপুরে ইলিশ মাছ কেনার জন্য। কিন্তু এখানে মাছের দাম অনেক বেশি।

চাঁদপুর মাছ ঘাটে ব্যবসায়ী হাজী শবেবরাত সরকার বলেন, চাঁদপুরে দেশের বিভিন অঞ্চল থেকে আসা ইলিশের সরবরাহ বেড়েছে। নোয়াখালী, হাতিয়া, সন্দ্বীপ, রামগতি থেকে চাঁদপুর ঘাটে ১০-১২ হাজার মণ মাছ এসেছে। তবে  দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা মাছের আকার তেমন বড় নয়।

চাঁদপুর মৎস্যজীবী বণিক সমিতির সভাপতি আব্দুল বারি মানিক মজুমদার বলেন, দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে চাঁদপুরে ইলিশ আসা শুরু করেছে। আমরা আশা করছি, আগামী কয়েক দিনের মধ্যে চাঁদপুরের ইলিশ পাওয়া যাবে। তবে চাঁদপুর মাছ ঘাটে তুলনামূলকভাবে চাঁদপুরের ইলিশ কম আছে। 

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা গোলাম মেহেদী হাসান বলেন, চাঁদপুরে আমরা মা ইলিশ রক্ষা ও জাটকা রক্ষা অভিযানগুলো সুন্দরভাবে পরিচালনা করেছি। বৃষ্টিপাত কম হওয়ার চাঁদপুরে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে না। শুধু চাঁদপুর নয়, জেলার আশপাশের জেলাগুলোতে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে না। আমরা আশা করি, বৃষ্টি হলে আমাদের জেলেরা নদীতে মাছ ধরতে পারবে। 

মৎস্য বিজ্ঞানী ইলিশ গবেষক ড. আনিসুর রহমান মুঠোফোনে বলেন, মে-জুন-জুলাইয়ে অল্প-স্বল্প ইলিশ পাওয়া যায়। তবে হতাশা হওয়ার কারণ নেই। আমরা আশা করছি, বৃষ্টি হলে ইলিশ পাওয়া যাবে। অনেক সময় নদী ও মোহনায় তীব্র নাব্যতা সংকটে ইলিশ আসছে না। 

এসপি