বসতঘরের পেছনে ৩ জন শায়িত, কবরের সামনে দাঁড়িয়ে নির্বাক ভাই-বোন
ময়মনসিংহের ত্রিশালে ট্রাকচাপায় একই পরিবারের তিনজন (স্বামী, অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী ও মেয়ে) নিহতের ঘটনায় শোকে স্তব্ধ পরিবার, স্বজন ও এলাকাবাসী। শনিবার (১৬ জুলাই) রাতে জানাজা শেষে উপজেলার রায়মণি এলাকার নিজ বাড়িতে তাদের দাফন করা হয়।
রোববার সকালে রায়মণি ফকির বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বসতঘরের পেছনে একসঙ্গে নতুন তিনটি কবর। যেখানে শায়িত আছেন দিনমজুর জাহাঙ্গীর আলম, তার স্ত্রী রত্না ও মেয়ে সানজিদা। একসঙ্গে তিনজনকে হারিয়ে তাদের কবরের পাশে বসে অনবরত বিলাপ করছিলেন মা সুফিয়া আক্তার। আর বাকরুদ্ধ হয়ে কবরের পাশে দাঁড়িয়ে বাবা-মা-বোনকে খুঁজছিলেন জাহাঙ্গীর-রত্না দম্পতির ১০ বছর বয়সী মেয়ে জান্নাত ও সাত বছর বয়সী ছেলে এবাদত।
বিজ্ঞাপন
অথচ নতুন অতিথির আগমনে বাড়িতে থাকার কথা ছিল আনন্দ-উচ্ছ্বাস। একটি দুর্ঘটনা কেড়ে নিয়েছে সবকিছু, আনন্দকে পরিণত করেছে বিষাদে। এ ঘটনায় শোকে স্তব্ধ শুধু রায়মণি গ্রামই নয়, শোকের ছায়া নেমেছে পুরো ত্রিশালে।
নিহত জাহাঙ্গীরের বাবা মোস্তাফিজুর রহমান বাবলু ও মা সুফিয়া আক্তার দুইজনই শারীরিক প্রতিবন্ধী। তারা জানান, জায়গা না থাকায় বসতঘরের পেছনে বানিয়েছেন কবর। থাকার ঘরটিও ভাঙা টিন আর মাটির তৈরি। দরিদ্র পরিবারে জাহাঙ্গীরই ছিল উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তাকেসহ তিনজনকে একসঙ্গে হারিয়ে আরও অসহায় হয়ে পড়েছেন তারা। এখন নবজাতকসহ তিন সন্তানের ভবিষ্যতও অনেকটা অনিশ্চয়তার মুখে।
এদিকে শোকস্তব্ধ বাড়িতে আলোচনায় এখন অলৌকিকভাবে বেঁচে যাওয়া নবজাতক। মৃত মায়ের পেট থেকে জন্ম নেওয়া শিশুকন্যাকে এক নজর দেখতে ব্যাকুল সবাই।
নবজাতকের বড় বোন জান্নাত আক্তার (১০) বলে, মোবাইলে আমার বোনের ছবি দেখেছি। আমরা তার জন্য অপেক্ষা করছি। সে বাড়িতে আসলে আমি তাকে খুব আদর করব। দাদা-দাদি ও আমি মিলে তাকে লালন পালন করব। কথা বলতে বলতেই তার চোখ বেয়ে পানি পড়ছিল।
প্রসঙ্গত, শনিবার বিকেল পৌনে ৩টার দিকে ত্রিশালের কোর্টভবন এলাকায় রাস্তা পার হওয়ার সময় ট্রাকচাপায় প্রাণ হারান অন্তঃসত্ত্বা রত্না বেগম (৩২), তার স্বামী জাহাঙ্গীর আলম (৪০) এবং তাদের ছয় বছরের মেয়ে সানজিদা। এ সময় অলৌকিকভাবে মায়ের গর্ভ ফেটে ভূমিষ্ঠ হয় ফুটফুটে এক নবজাতক। ভূমিষ্ঠ হয়ে রাস্তায় পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ছুটে যায় পুলিশ ও আশপাশের লোকজন। পরে নবজাতকটিকে উদ্ধার করে নেওয়া হয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। সেখানে নেওয়ার পরই জানা যায়, জীবিত আছে নবজাতকটি।
সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে তারা পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও উন্নত চিকিৎসার জন্য নবজাতকটিকে ময়মনসিংহ সদরের সিবিএমসি হাসপাতালে ভর্তি করেন। সেখানে এক্সরে রিপোর্টে জানা যায়, তার ডান হাতের দুটি হাড় ভেঙে গেছে। বর্তমানে শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. কামরুজ্জামানের তত্ত্বাবধানে নগরীর লাবীব হাসপাতালে শিশুটি চিকিৎসাধীন রয়েছে।
শিশুটি বিপদমুক্ত রয়েছে জানিয়ে ডা. মোহাম্মদ কামরুজ্জামান বলেন, শিশুটির সামগ্রিক অবস্থা আমরা পর্যবেক্ষণ করেছি। সে ভালো আছে এবং শঙ্কামুক্ত। যেহেতু তার মা নেই, তাই তাকে ফর্মুলা দুধ খাওয়ানো হচ্ছে। আশা করছি, তার কোনো ধরনের সমস্যা হবে না।
এদিকে শিশুটির চিকিৎসা খরচ ও ভরণপোষণসহ সব দায়িত্ব পালনের কথা জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ত্রিশালের এক ব্যক্তি। এছাড়া তার পাশে থাকার কথা বলেছেন ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ এনামুল হক।
উবায়দুল হক/এসপি