লোডশেডিংয়ে অতিষ্ঠ উত্তরের জনজীবন, উৎপাদন ব্যাহত
হঠাৎ করে কোনো ঘোষণা ছাড়াই শুরু হয়েছে ঘন ঘন লোডশেডিং। তাও আবার এক-দুদিন নয়, টানা পাঁচদিন ধরে এ অবস্থা চলছে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ছয় থেকে সাত ঘণ্টা বিদ্যুৎ মিলছে। বাকি সময়টা লোডশেডিংয়ে হাঁপিয়ে উঠছে জনজীবন। রংপুরসহ বিভাগের পুরো আট জেলার নগর-বন্দর, হাট-বাজার ও গ্রামে বিদ্যুৎ নিয়ে ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন গ্রাহকরা।
অসহনীয় এই লোডশেডিংয়ের কবল থেকে পরিস্থিতি কবে নাগাদ স্বাভাবিক হবে- তার কোনো সদুত্তরও নেই বিদ্যুৎ বিভাগের কাছে। তবে গ্যাস ও ডিজেল সংকটের কারণে দেশের অন্যান্য জায়গার মতো রংপুর বিভাগেও ঘন ঘন লোডশেডিং হচ্ছে বলে দাবি করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিজ্ঞাপন
সাধারণ মানুষসহ সচেতন মহল বলছে, চলমান পরিস্থিতিতে সারা দেশের মধ্যে রংপুর বিভাগে সবচেয়ে বেশি লোডশেডিং দেওয়া হচ্ছে। যা একেবারে অসহনীয় পর্যায়ে ঠেকেছে। শুধু জীবনই অতিষ্ঠ নয়, এর প্রভাব ছোট-বড় কলকারখানা ও ব্যবসায় পড়তে শুরু করেছে।
এদিকে লোডশেডিংয়ের সঙ্গে যোগ হওয়া প্রচণ্ড গরমে হাপিতাস করছে পুরো বিভাগ। স্থবির হয়ে পড়েছে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ ছোট বড় শত শত কলকারখানা। ব্যঘাত ঘটছে উৎপাদন কার্যক্রমে। লোডশেডিংয়ের প্রভাব পড়েছে ঈদের বাজারে। বিলাস বহুল শপিংমল, বিপণী বিতানসহ ছোট-বড় মার্কেটগুলোতে বেচাকেনায় মন্দাভাব দেখা গেছে। ঈদের মৌসুমেও ক্রেতার দেখা মিলছে না।
অভিযোগ রয়েছে, লোডশেডিং হয়ে তা কখনো কখনো তিন থেকে চার ঘণ্টা পর্যন্ত স্থায়ী হচ্ছে। অব্যাহত লোডশেডিংয়ের কারণে বাড়ছে হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনাও। গেল পাঁচ দিনে রংপুর মেডিকেল কলেজ (রমেক) হাসপাতালে ২০ জনসহ বিভাগের বিভিন্ন জেলায় অন্তত অর্ধশত জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
চিকিৎসকরা বলছেন, প্রচণ্ড গরম ও লোডশেডিংয়ের কারণে হিট স্ট্রোকে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। রমেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগে কর্তব্যরত ডা. জাবেদ জানান, প্রচণ্ড গরমে হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত অন্তত ২০ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এদের মধ্যে বয়ষ্ক রোগীর সংখ্যাই বেশি।
এদিকে লোডশেডিংয়ে নাকাল রংপুর নগরবাসী। চাহিদার তুলনায় বিদ্যুৎ সরবরাহ অকল্পনীয়ভাবে কমে আসায় অনেক শপিং মল, ছোট-বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও কলকারখানা বন্ধ রাখা হয়েছে। একই অবস্থা নীলফামারীর সৈয়দপুরে। শুধু লোডশেডিংয়ের কারণে বিসিক শিল্প এলাকাসহ বাণিজ্যিক এ শহরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে উৎপাদন কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। শুধু ব্যবসা ক্ষেত্রেই নয়, জনজীবনও বিপর্যস্ত বিদ্যুতের এমন বিপর্যয়ে।
নীলফামারী পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির জেনারেল ম্যানেজার সুলতান নাছিমুল হক জানান, জেলায় পল্লী বিদ্যুতের চাহিদা ৭০ মেগাওয়াট। বর্তমানে ৩০ থেকে ৩৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে। গ্যাস ও জ্বালানি সংকটের কারণে সারা দেশেই লোডশেডিং হচ্ছে। সব কিছু বিবেচনা করে লোডশেডিং দেওয়া হচ্ছে।
অন্যদিকে নেসকো লিমিটেডের পরিচালন ও সংরক্ষণ সার্কেল-২ রংপুরের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (ভারপ্রাপ্ত) আশরাফুল ইসলাম বলেন, নীলফামারী জেলায় আমাদের চাহিদা ৬৭ মেগাওয়াট, আমরা পাচ্ছি ৩৫ থেকে ৪০ মেগাওয়াট।
এদিকে রংপুর নগরীর হাজীপাড়া চামড়াপট্টি এলাকার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী রমজান আলী বলেন, গত ১০ বছরে এভাবে কখনো বিদ্যুৎ যাওয়া-আসা করেনি। বিদ্যুৎ কখন যাবে আর কখন আসবে তাও বলা মুশকিল। প্রচণ্ড গরম আর লোডশেডিংয়ে জীবন শেষ। দোকানে বসে থাকাও সম্ভব হচ্ছে না। অসহ্য লোডশেডিংয়ের কারণে দুই দিন দোকান বন্ধ রেখেছিলাম।
একই আক্ষেপ রংপুর জেলা পরিষদ সুপার মার্কেটের মোবাইলের মেকানিক আবু সায়েম লাভলুর। তিনি বলেন, লোডশেডিং আর প্রচণ্ড গরমে মার্কেটের অবস্থা খুবই খারাপ। জেনারেটর দিয়ে কতক্ষণ থাকা যায়। আগের মতো এখন কাজও করতে পারছি না। ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে ইলেকট্রিক সামগ্রীও নষ্ট হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে আমাদের ঈদ প্রস্তুতি মাটি হয়ে যাবে।
রংপুর সদরের পাগলাপীর পানবাজার এলাকার আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘হামরা তো গ্রামোত থাকি থাকি কারেন্ট যায়। ছাওয়ারা ঠিক মতো বই নিয়্যা পড়ার সুযোগ পাওছে না। কোন দিন থাকি পরিস্থিতি ভালো হইবে, তাক তো পল্লী বিদ্যুৎ অফিসের লোকেরা কবার পাওছে না।’
পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলেন, রংপুর জেলাসহ পুরো বিভাগে চার দিন ধরে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টার বেশি বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। এটা শুধু রংপুরের সমস্যা নয়, সারা দেশেই একই অবস্থা।
গাইবান্ধায় জেলা ও পৌর শহরে কিছুটা কম হলেও গ্রাম পর্যায়ে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে লোডশেডিং। একবার বিদ্যুৎ গেলে আসতে অন্তত ৪-৫ ঘণ্টা সময় নিচ্ছে। ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে ফ্রিজ, টিভি, ফ্যানসহ বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি নষ্ট হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় ব্যাঘাত সৃষ্টি হচ্ছে। কোমলমতি শিশুসহ বয়স্ক লোকজন অসুস্থ হয়ে পড়ছে। ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিসহ জনজীবনে স্থবিরতা নেমে এসেছে।
গাইবান্ধা শহরের আলমদিনা সুপার মার্কেটের ব্যবসায়ী স্বপন কুমার বলেন, আমার প্রেসের ব্যবসা। বিদ্যুৎ ছাড়া আমরা একেবারে অচল। অতিরিক্ত লোডশেডিংয়ের কারণে কোনো কাজ ঠিকমতো করতে পারছি না। কোনো কোনো সময় মেশিন চালু করার আগেই বিদ্যুৎ চলে যায়। এতে আমার ব্যবসার অনেক ক্ষতি হচ্ছে।
শহরের ১ নং ট্রাফিক মোড়ের লন্ড্রি ব্যবসায়ী দিপু সাহা বলেন, বিদ্যুৎ ছাড়া আমার ব্যবসা অচল। বিদ্যুৎ না থাকায় কয়েকদিন থেকে অনেক কাপড় আয়রন করতে পারিনি। সময় মতো আয়রণ করতে পারছি না। এইভাবে লোডশেডিং চলতে থাকলে ব্যবসার অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে।
এ ব্যাপারে গাইবান্ধা বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড নেসকো-(১) এর নির্বাহী প্রকৌশলী পলাশ চন্দ্র দাস ঢাকা পোস্টকে বলেন, দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন কম হওয়ায় চাহিদার তুলনায় কম বিদ্যুৎ পাচ্ছি। চাহিদার মাত্র ৫০ থেকে ৬০ ভাগ বিদ্যুৎ পাচ্ছি আমরা। আমাদের চাহিদা প্রতিদিন ১২ মেগাওয়াট সেখানে মাত্র ৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাচ্ছি। এত কম বিদ্যুৎ দিয়ে গ্রাহকের চাহিদা কোনোভাবেই পূরণ করা সম্ভব নয়। তাই লোডশেডিং দিতে আমরা বাধ্য হচ্ছি।
তীব্র গরম ও ঘন ঘন লোডশেডিংয়ে শোচনীয় অবস্থায় ঠাকুরগাঁওয়ের লাখ লাখ মানুষ। শ্রমজীবী, ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ বিদ্যুৎ বিপর্যয়ে অতিষ্ঠ। লোডশেডিংয়ের প্রভাব পড়েছে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসহ হাসপাতালেও। বিদ্যুৎ নির্ভর ব্যাটারিচালিত যানবাহন চালকরাও পড়েছেন চরম ভোগান্তিতে। লোডশেডিংয়ের কারণে হাজারো মানুষের আয় রোজগারও কমতে শুরু করেছে।
মুদি ব্যবসায়ী মাসুদ হাসান বলেন, একদিকে তীব্র রোদ আরেক দিকে লোডশেডিং। ২০ মিনিট কারেন্ট থাকলে তিন ঘণ্টা পাওয়া যায় না। শুধু দিনের বেলা এ ভোগান্তি হয় না, রাতেও হয়। খুব দ্রুত এই সমস্যাগুলো সমাধান করা উচিত।
ঠাকুরগাঁও সদর হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে সন্তানকে নিয়ে আসা অনুপ সরকার বলেন, আমার বাচ্চাটাকে শিশু ওয়ার্ডে ভর্তি করিয়েছি দুদিন হলো। গরম আর ঘন ঘন লোডশেডিং হওয়ার ওয়ার্ডে আরও অস্বস্তি বেড়েছে। সুস্থ হওয়ার চেয়ে আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েছে।
ঠাকুরগাঁও পল্লী বিদুৎ সমিতির জেনারেল ম্যানেজার আবু আশরাফ মোহাম্মদ সালেহ বলেন, গ্যাস সংকটের কারণে লোডশেডিং হচ্ছে। আমাদের জেলায় চাহিদা ৫০ মেগাওয়াট। আমরা পাচ্ছি ৩০ মেগাওয়াট। চাহিদা অনুযায়ী না পাওয়ার কারণে তিন দিন থেকে এ সমস্যা হচ্ছে। তবে কবে নাগাদ সমস্যার সমাধান হবে তা বলা মুশকিল।
এদিকে লোডশেডিংয়ের কারণে ওয়েল্ডিং, ঝালাই, বিদ্যুৎচালিত মোটর, মেকানিকের যন্ত্রপাতি ও বিদ্যুৎনির্ভর কাজ ও ব্যবসায় মারাত্মক ক্ষতির মুখে ব্যবসায়ীসহ শ্রমিকরা। বিদ্যুতে অভ্যস্ত মানুষ বহু বছর পর আবারও কেরোসিনের বাতি কিংবা মোমবাতি ব্যবহার করতে শুরু করেছেন বলে জানিয়েছে কুড়িগ্রামের ব্যবসায়ীসহ সাধারণ মানুষ।
কুড়িগ্রাম সদরের পাঁচগাছী ইউনিয়নের নুরুল মিয়া বলেন, দিনে-রাতে কতবার বিদ্যুৎ যায় আসে তার কোনো হিসেব নেই, খুব সমস্যা হচ্ছে। আমি অটোরিকশা চালাই, রাতে চার্জ হচ্ছে না। এখন গাড়ি চার্জ দেই কখন, আর ভাড়া মারি কখন। এমনিতে অভাবের সংসার, তার ওপর যদি এমনটা হয়, তাহলে বাঁচবে কী করে?
একই এলাকার কম্পিউটার ব্যবসায়ী নুরুন্নবী বলেন, বিদ্যুৎ ঠিকমতো না থাকায় ব্যবসা-বাণিজ্যে খুব সমস্যা হচ্ছে। একবার গেলে দুই ঘণ্টা থাকে না, আবার আসে অল্প সময়ের জন্য আবার চলে যায়। এভাবে আসা যাওয়া করলে আমরা ব্যবসা করি কীভাবে।
এদিকে মঙ্গলবার (৫ জুলাই) রংপুরে সর্বোচ্চ ৩৬ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অফিস। আগামী কয়েক দিনে রংপুরে বৃষ্টির কোনো সম্ভাবনা নেই।
রংপুর বিদ্যুৎ বিভাগের নর্দার্ন ইলেক্ট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি (নেসকো) সূত্র বলছে, জাতীয় গ্রিড থেকে চাহিদার তুলনায় অনেক কম বিদ্যুৎ পাওয়ায় ঘন ঘন লোডশেডিং দিতে হচ্ছে। অবস্থা স্বাভাবিক হতে কত দিন সময় লাগবে তা জানাতে পারেননি কোনো কর্মকর্তা। রংপুর বিভাগে পিক আওয়ারে বিকেল ৫টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত নেসকো ও পল্লী বিদ্যুৎ মিলিয়ে চাহিদা রয়েছে ৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। সেখানে পাওয়া যাচ্ছে সর্বোচ্চ ৫০০ মেগাওয়াট। ফলে বাধ্য হয়ে লোডশেডিং করে রেশনিংয়ের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে হচ্ছে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে নেসকোর প্রধান প্রকৌশলী শাহাদত হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, রংপুর বিভাগে নেসকো আর পল্লী বিদ্যুতের চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে লোডশেডিং দিতে হচ্ছে। দিনের বেলায় বিভাগে বিদ্যুতের চাহিদা ৬০০ মেগাওয়াট। সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে সর্বোচ্চ ৪০০ মেগাওয়াটেরও কম। সন্ধ্যার পর থেকে চাহিদা ৭০০ মেগাওয়াট। পাওয়া যাচ্ছে সর্বোচ্চ ৫০০ মেগাওয়াট।
ফরহাদুজ্জামান ফারুক/আরএআর