বিদেশ যেতে ব্যর্থ, গরুর খামারে সফল দুই ভাই
বাবার বড় ছেলে মো. নজরুল ইসলাম। মা নেই। সংসারের হাল ধরতে মধ্যপ্রাচ্যের অনেকগুলো দেশে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ভাগ্য সহায় হয়নি। বাবার পতিত জমিতে চারটি দুগ্ধজাত গরু দিয়ে শুরু করেন ভাগ্য বদলের চেষ্টা। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে আজ তিনি সফল। খামারের আয় থেকে দুই বোনকে বিয়ে দিয়েছেন। ছোট ভাই মো. কামরুল ইসলামকে পড়িয়েছেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে।
দুই ভাই নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের চর হাজারী ইউনিয়নের ৫ নং ওয়ার্ডের হাজীরহাট গ্রামের হাজী আলী আহমদ পাটওয়ারী বাড়ির মো. রফিকুল ইসলামের ছেলে।
বিজ্ঞাপন
সরেজমিনে দেখা গেছে, ৩ একর জমির ওপর নির্মিত কেএন এগ্রোর প্রবেশ পথের বাম পাশে রয়েছে দুটি টিনের শেড। শেডের ভেতরে স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে তৈরি করা হয়েছে আলাদা আলাদা চৌবাচ্চা। খামারের ভেতর-বাইরে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। মশা-মাছি আর পোকামাকড় প্রতিরোধেরও ব্যবস্থা রয়েছে।
খামারের মালিক মো. নজরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার সফলতার পেছনে অনেক কষ্টের ইতিহাসও রয়েছে। আমি পরিবারের বড় ছেলে। বাবা সংসার চালাতে গিয়ে কিছু জমি বিক্রি করে দেন। এরপর পরিবারের বড় সন্তান হিসেবে সংসারের দায়িত্ব আমার ওপর পড়ে। বারবার চেষ্টা করেও বিদেশ যেতে পারিনি। অনেক মানুষ অনেক কথা বলেছে। হাতে সামান্য কিছু পুঁজি ছিল। তার সঙ্গে ধারদেনা করে বাজার থেকে চারটি উন্নত জাতের গাভি কিনে আনি। এখন আমার খামারে ২০টি গাভিসহ দেড় শতাধিক গরু রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, খামারের সব গরুকে প্রাকৃতিক উপায়ে বড় করা হচ্ছে। কোনো রাসায়নিক খাবার কিংবা ইনজেকশন দেওয়া হচ্ছে না। নিয়মিত ভ্যাক্সিনেশন করা হয় গরুগুলোকে। যারা গরু কিনবেন ভালো গরু পাবেন। আমি ভালো গরুর মাংস খেতে পছন্দ করি। তাই আমি চাই, অন্য ভাইয়েরাও ভালো গরুর গোশত খাবে। এতে আল্লাহ ও আল্লাহর রাসুল সন্তুষ্ট হবেন।
খামারটি আমাদের পারিবারিক আয়ের প্রধান উৎস উল্লেখ করে নজরুল ইসলাম বলেন, প্রথমে শখের বসে খামারটি করলেও বর্তমানে খামারটি আমাদের পারিবারিক আয়ের প্রধান উৎস। ২০১৭ সালে অজ্ঞাত ভাইরাসে একসঙ্গে অনেকগুলো গরু মারা যায়। ফলে সে সময় প্রায় ২০ লাখ টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হই। কিন্তু হাল ছাড়িনি। সব মিলিয়ে এখন অনেক ভালো অবস্থানে রয়েছি। আলহামদুলিল্লাহ।
নজরুল ইসলামের ছোট ভাই কামরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ২০১৫ সালে ভাইয়া যখন খামার শুরু করেন তখন আমি ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনা শুরু করি। বাড়িতে ছুটিতে এলে খামারে সময় দিতাম। গরু লালন-পালনে আমার মধ্যে মানসিক প্রশান্তি কাজ করে। উচ্চ শিক্ষার জন্য দেশের বাইরে যাওয়ার ইচ্ছে রয়েছে। তবে আমি আধুনিক খামার করে দেখিয়ে দিতে চাই, দেশে শ্রম দিলে বিদেশের থেকে বেশি আয় করা সম্ভব।
কামরুল ইসলাম আরও বলেন, ২০১৯ সালে পড়াশোনা শেষ হলেও করোনা মহামারির কারণে চাকরির বাজার ছোট হয়ে আসে। আমি তখন পুরোদমে খামারে সময় দেই। ভাইয়ার সঙ্গে উদ্যোক্তা হতে পেরে আমি খুশি। আমার মাধ্যমে কিছু মানুষের কর্মসংস্থান হলে, আমি বেশি খুশি হবো। সবাইকে নিয়ে থাকার মাঝে আনন্দ আছে।
তিনি আরও বলেন, খামারে বর্তমানে ৮ জন শ্রমিক কাজ করে। আমার স্বপ্ন আছে শতাধিক শ্রমিক এই খামারে কাজ করবে। এতে করে শতাধিক মানুষের কর্মসংস্থান হবে। আমরা সবার আগে ক্রেতার সন্তুষ্টির কথা চিন্তা করি। ক্রেতা খুশি হলে আমাদের প্রচার এমনিইতেই হবে।
খামারে গরু কিনতে আসা মো. রফিক ঢাকা পোস্টকে বলেন, ২০১৫ সালে খামারটি শুরু হয়। বর্তমানে খামারের আয়তন ও মোটাতাজাকরণ গরুর সংখ্যা বেড়েছে। আমরা প্রতি বছর এই খামার থেকে গরু নিই, এবারও নেব।
গরু কিনতে আসা মো. মিশন নামে আরেক ক্রেতা ঢাকা পোস্টকে বলেন, নজরুল ইসলাম অনেক ভালো মানুষ। গত বছর আমি তার থেকে গরু কিনছি। এই খামারে বেশি লাভে গরু বিক্রি হয় না। স্বল্প লাভে গরু বিক্রি হয়। এক দিনের ব্যবসায়ী না হওয়ায় মানুষ কম দামে ভালো গরু পাচ্ছে। যে কেউ তার খামারে আসলে পছন্দ করবে।
নজরুল ইসলাম ও কামরুল ইসলামের বাবা মো. রফিকুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ওদের মা মারা যাওয়ার পর আমি তাদের মায়ের অভাব বুঝতে দেইনি। বিদেশে যাওয়ার শত চেষ্টা করেও যেতে পারেনি নজরুল। খামারটি করার জন্য জমি বিক্রি করেছি। বর্তমানে ৮ জন লোকের কর্মের ব্যবস্থা হয়েছে। আমি বাবা হিসেবে তাদের পরামর্শ ও দিক-নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছি।
চরহাজারী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. মহিউদ্দিন সোহাগ ঢাকা পোস্টকে বলেন, খামারটিকে তিল তিল করে বেড়ে উঠতে দেখেছি। অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আজ দুই ভাই সফল উদ্যোক্তা হয়েছেন। বিদেশে না যেতে পারলেও দেশে ভালো অবস্থানে আছেন। তারা এখন অনেক বেকার যুবকের অনুপ্রেরণা।
উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা তাসলিমা লিনা ঢাকা পোস্টকে বলেন, কোম্পানীগঞ্জের অন্যতম বড় খামার হলো কেএন এগ্রো। ওই খামারের সব গরু আমাদের পর্যবেক্ষণের মধ্যে রয়েছে। নিয়মিত টিকা দেওয়া হচ্ছে। খামারি দুই ভাই দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখছে। সব সময় তাদের উপজেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগের পক্ষ থেকে সহযোগিতা ও পরামর্শ দেওয়া হয়।
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. কাজী রফিকুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, মানুষের ভাগ্য তার কর্মের মধ্যে রয়েছে। আর পরিশ্রম ছাড়া সফলতা আসে না। কঠোর পরিশ্রম ও ধৈর্য থাকলে জীবনে সফলতা আসে, নজরুল ইসলাম-কামরুল ইসলাম তার অনন্য উদাহরণ। আমি খামারটির সমৃদ্ধি ও উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করছি।
হাসিব আল আমিন/এসপি