ভাইয়ের শোকে এখনো রাতে ঘুমাতে পারে না শিশু মরিয়ম
‘আমি আমার ছেলেকে খুঁজে পাইনি। আমার পাশের সিটে ঘুমানো ছিল। দুর্ঘটনার সময় আরেকটি সিটের নিচে চলে যায়। ওর মুখটা আমি দেখতে পারিনি। আমি অনেক চিৎকার করেছি। কিন্তু ছেলেকে পাইনি। আমার মেয়ে পাশের আরেকটি সিটের সঙ্গে আটকে ছিল। ওর হাত ধরে রেখেছিলাম। ছেলে কোনো কিছুই বলতে পারেনি। মা বা ব্যথা কোনো কিছুই বলতে পারেনি। তবে আমার মেয়ে ওর ভাইকে দেখে বলেছে, তার মুখে রক্ত।’
বরিশালের উজিরপুর উপজেলার বামরাইলে সড়ক দুর্ঘটনায় ৯ বছরের ছেলে আরাফাতকে হারানোর এমন হৃদয় বিদারক বর্ণনা দিচ্ছিলেন তার মা আঁখি বেগম। হাসপাতালে চিকিৎসাও সঠিকভাবে নেননি তিনি। শুধু ছেলেকে শেষবারের মতো দেখার জন্য ছুটে গেছেন। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি। আরাফাত এখন ঝালকাঠি সদর উপজেলার নথুল্লাবাদ ইউনিয়নের হাওলাদার বাড়িতে দাদা শাহজাহান হাওলাদারের কবরের পাশে চিরঘুমে।
বিজ্ঞাপন
সন্তান হারানোর শোক সব সময় তাড়া করে বেড়ায় আঁখি বেগমকে। দুর্ঘটনায় নিজে পায়ে আঘাতপ্রাপ্ত হন এবং চার বছরের মেয়ে মরিয়মের পা ভেঙে যায়। এখনো ব্যান্ডেজ মরিয়মের পায়ে আর আঁখি বেগম হাঁটাচলা করতে পারেন না স্বাভাবিকভাবে।
তিনি বলেন, আমার ছোট্ট মেয়েটাকে ওর ভাইয়ের ছবি দেখাই না। ছবি দেখলেই ভাইকে খোঁজে, কান্নাকাটি করে। দুর্ঘটনার পরে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরলেও আজও স্বাভাবিক হতে পারিনি কেউ। মেয়েটা রাতে চিৎকার করে ওঠে ভয়ে। আরাফাতকে খোঁজে। আমাদের সব কিছু কেমন শেষ হয়ে গেছে। আরাফাতের মৃত্যু না হয়ে যদি আমার মৃত্যু হতো তাহলেও অনেক খুশি হতাম। অতটুকুন ছোট্ট ছেলেটা কত কষ্ট পেয়ে মারা গেছে।
বলতে বলতে থমকে যান আঁখি। চোখে হয়তো ভেসে ওঠে মুহূর্তেই ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার সেই রাতের চিত্র। কিছুক্ষণ পর আবার বলেন, ফুলের মতো এক সন্তান হারালাম। শেষ দেখাটাও দেখতে পারলাম না। এখন আমার সম্বল আরাফাতের ছবিটাই। ছবিটি দেখতে গিয়ে আবারও কণ্ঠ ধরে আসে এই গৃহবধূর।
তিনি বলেন, বাসে আমাদের সিটের ডান পাশে ঘুমন্ত অবস্থায় ছিল আরাফাত। আমি মরিয়মকে কোলে নিয়ে সিটের বাঁ পাশে বসা ছিলাম। ফজরের আজানের একটু পরে আচমকা ঘুম ভেঙে যায়। এর কিছুক্ষণ পরেই দুর্ঘটনাটি ঘটে। চোখের সামনেই দুটি লাশ দেখি রক্তাক্ত। আমার পা আরেকটি সিটের সঙ্গে আটকে যায়। আমার মেয়েও পাশের আরেকটি সিটে আটকে যায়। ঘটনার পর দেড় ঘণ্টা ওভাবে আটকে ছিলাম। আটকা অবস্থায়ই আরাফাতকে খুঁজতে থাকি। কিন্তু পাইনি।
আঁখি বেগম বলেন, ফায়ার সার্ভিস খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে উদ্ধার কাজ শুরু করে। তারা পেছনের দিক থেকে উদ্ধার শুরু করে। তবে দুর্ঘটনার খবর পেয়ে আমার পরিবারের লোক সেখানে গিয়ে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের আমাদের শনাক্ত করে দেন। তারপর তারা আমাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে আসেন। এখন আমার বাবার বাসায় থেকেই চিকিৎসা করাচ্ছি।
তিনি বলেন, ঘটনার পর মামলা হলো। ড্রাইভার শনাক্ত হলো। কিন্তু এখনো গ্রেপ্তার হয়নি। মনে হয় না এসবের কোনো বিচার হবে। এমনকি কেউ আমাদের কোনো খোঁজও নেয়নি। শুনেছিলাম নিহতদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা করা হবে। সেসব কিছুই করা হয়নি।
আঁখি বেগমের স্বামী মনির হোসেন হাওলাদার বিদেশে থাকেন। অনিক নামে বড় আরেক ছেলে রয়েছে। তবে পুরো পরিবারেই যেন সার্বক্ষণিক শোকের ছায়া লেগে আছে।
নিহত আরাফাতের দাদি মায়া বেগম বলেন, আরাফাত অনেক লক্ষ্মী ছেলে ছিল। ওর আচার-আচরণ অন্য সকলের চেয়ে আলাদা। সবাই ওকে খুব ভালোবাসতাম। কিন্তু কী থেকে কী হয়ে গেল। এইভাবে ওকে কবরে শুইয়ে রাখতে হবে তা কে জানতো। আরাফাতকে হারানোর বেদনা কোনো দিন ভুলতে পারবো না।
আরাফাতের মামা মেহেদী হাসান বলেন, এসব দুর্ঘটনার পেছনে রাষ্ট্রের অবশ্যই দায় আছে। সঠিকভাবে মনিটরিং না হওয়ায় দুর্ঘটনা হয়। পরিবহন সেক্টরে চালকরা কোনো বিশ্রাম পান না। গাড়ির মালিকরা একই ড্রাইভার দিয়ে সারাদিন ট্রিপ দেওয়ান। ড্রাইভারওতো মানুষ। যে কারণে দুর্ঘটনা ঘটে। আর আমরা স্বজন হারাই।
তিনি বলেন, উজিরপুরের দুর্ঘটনায় এমন বিচার চাই যেন পরবর্তীতে বেপরোয়া গাড়ির চালকরা সতর্ক হয়ে যান।
গৌরনদী হাইওয়ে থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ বেলাল হোসেন বলেন, আমরা চেষ্টা করছি গাড়ির চালককে গ্রেপ্তারের। কিন্তু শনাক্ত হলেও তার অবস্থান নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। কয়েক দফায় গাড়ির মালিক পক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। কিন্তু তারা কোনো সহায়তা করছে না। ফলে গাড়ির চালককে আইনের আওতায় এখনো নিয়ে আসা সম্ভব হয়নি। তবে আমাদের চেষ্টার কমতি নেই।
তিনি জানান, আগে যে তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন তিনি বদলি হয়ে যাওয়ার পরে বর্তমানে মামলাটি আমি নিজেই তদন্ত করছি।
বরিশালের জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দিন হায়দার বলেন, দুর্ঘটনার পরপরই বিভাগীয় কমিশনার স্যার, আমি হাসপাতালে আহতদের দেখতে যাই। তখন বিভাগীয় কমিশনার স্যার নিহতদের দাফনের জন্য ২০ হাজার টাকা করে বরাদ্দ দেন। আমি বরিশাল জেলায় একজনকে পেয়েছি তাকে সেই সহায়তা করেছি। এছাড়া যারা হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন তাদের চিকিৎসা খরচ সম্পূর্ণরূপে জেলা প্রশাসন বহন করেছে। এখনো বলব, দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত যারা বিভিন্ন জেলায় রয়েছেন তারা স্ব স্ব জেলা প্রশাসনে যোগাযোগ করলে তাদের সার্বিক সহায়তা সরকার থেকে করা হবে।
প্রসঙ্গত, গত ২৯ মে ঢাকা থেকে ভান্ডারিয়ার উদ্দেশে ছেড়ে আসা যমুনা লাইন পরিবহনের চালকের ভুলে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের উজিরপুর উপজেলার বামরাইল নামক স্থানে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। এতে ঘটনাস্থলেই ৯ জন এবং হাসপাতালে নেওয়ার পথে একজনের মৃত্যু হয়।
নিহতরা হলেন- ইমরান, রিপন খান, আরাফাত হোসেন হাওলাদার, নজরুল ইসলাম আকন, আনোয়ারা বেগম, হালিম মিয়া, সেন্টু মোল্লা, মাধব শীল, রেজা চোকদার ও রমজান হাওলাদার। নিহতদের কোনো পরিবার দাফনের জন্য ঘোষিত বিভাগীয় কমিশনারের বরাদ্দের অর্থ পায়নি।
সৈয়দ মেহেদী হাসান/আরএআর