এশিয়ার ১৪ দেশে ভেনামি চিংড়ির চাষ হলেও বাংলাদেশে অনুমতি নেই
খুলনাঞ্চলের বৈদেশিক আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস চিংড়ি। এ অঞ্চলের এক কোটি মানুষ চিংড়ি চাষের সঙ্গে সম্পৃক্ত। চিংড়ির জন্য এখানকার অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটেছে। খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা অঞ্চলে ব্যাপকহারে চিংড়ি চাষ হয়। বাগদার চাহিদা আছে কিন্তু উৎপাদন কম। এ জন্য বাগদার পাশাপাশি ভেনামি চিংড়ি চাষ করা একান্ত প্রয়োজন। কারণ বিশ্বে ভেনামি চিংড়ি এখন সহজলভ্য, চাহিদাও ব্যাপক।
এশিয়ার ১৪টি দেশে ভেনামি চিংড়ির ব্যাপক চাষ হলেও এখনো বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে চাষের অনুমতি মেলেনি। ভেনামি চিংড়ির উৎপাদন বাগদার চেয়ে অনেকগুণ বেশি। এমন তথ্য দিয়েছেন চিংড়ি উৎপাদনকারীরা। তারা বাগদার পাশাপাশি ভেনামি চিংড়ি চাষের বাণিজ্যিক অনুমতির দাবি জানিয়েছেন।
বিজ্ঞাপন
চিংড়ি উৎপাদনকারীদের দেওয়া তথ্যমতে, ২০২০ সালে চিংড়ির বিশ্ব বাজার ছিল ১৮.৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। যা ২০২৬ সালে বাজার দাঁড়াবে প্রায় ২৩.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। যার বৃহৎ অংশ ভেনামির দখলে। বিগত দুই দশক যাবৎ বিশ্বের ৬২টি দেশে উচ্চ ফলনশীল ভেনামি চিংড়ি উৎপাদন করছে। বিশ্বে সর্বমোট চিংড়ি উৎপাদনের ৭৭ শতাংশ ভেনামি চিংড়ি।
বর্তমান বিশ্বের চাষ মাধ্যমে চিংড়ি উৎপাদনকারী ৬২টি দেশ ভেনামি চিংড়ি চাষ করে। আর এশিয়ার চিংড়ি উৎপাদনকারী ১৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যতীত ১৪টি দেশেই বাণিজ্যিকভাবে ভেনামি চিংড়ি চাষ করে থাকে। ভেনামির সাশ্রয়ী মূল্য এবং সহজলভ্য হওয়ায় বিশ্বের ৭৭ ভাগ বাজার দখল করে নিয়েছে। ভেনামির উৎপাদন বেশি এবং আকার প্রায় একই হয়। ফলে ভেনামি চিংড়ি শুধুমাত্র ক্রেতা বা ভোক্তার চাহিদামত দেওয়া যায়, যা গলদা-বাগদার ক্ষেত্রে সম্ভব নয়। ফলে ভেনামি চিংড়ির বাণিজ্যিক চাষ বাংলাদেশে প্রয়োজন। তবে বাণিজ্যিক চাষের জন্য ভেনামি চিংড়ি এখনও অনুমোদন দেওয়া হয়নি।
শুধুমাত্র পাইলট প্রকল্পের আওতায় খুলনা অঞ্চলের ১২টি ফার্মকে ভেনামি চিংড়ির পরীক্ষামূলক চাষের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। যারমধ্যে ৮টি প্রতিষ্ঠানকে সরাসরি এবং ৪টি প্রতিষ্ঠানকে শর্তসাপেক্ষে ভেনামি চিংড়ির পরীক্ষামূলক চাষের অনুমতি দিয়েছে সরকার।
মৎস্য অধিদপ্তরের অনুমোদিত পরীক্ষামূলক ভেনামি চিংড়ি চাষে আগ্রহী প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে- যশোর ইমইউসি ফুড্স লিঃ (বিএফআরআই, পাইকগাছা), খুলনার বটিয়াঘাটার ফাহিম সী ফুড্স লিঃ, পাইকগাছার গ্রোটেক একোয়াকলচার লিমিটেড, সাতক্ষীরার শ্যামনগরের রেডিয়েন্ট শ্রিম্প কালচার-১, কয়রার আয়ান শ্রিম্প কালচার, ডুমুরিয়ার ইএফজি একোয়া ফার্মিং, বটিয়াঘাটার জেবিএস ফুডস প্রডাক্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ লিঃ ও কয়রার প্রান্তি এ্যাকোয়া কালচার লিঃ।
এছাড়া শর্তসাপেক্ষে অনুমতি প্রদান করবে- সাতক্ষীরার দেবহাটার মেসার্স আল-হেরা মংস্য প্রকল্প, রূপসার ফ্রেশ ফুডস লিমিডেট, সাতক্ষীরার কালীগঞ্জের নলতা আহছানিয়া ফিস ও রূপসার জেমিনি সি ফুডস লিমিডেট।
বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুড্স এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক শেখ সোহেল পারভেজ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ভেনামি উচ্চ ফলনশীল চিংড়ি। ভেনামি সফল হলে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ সস্তায় কিনে খেতে পারবে। সবাই এই চিংড়ি চাষে ঝুঁকে পড়ার জন্য যে পরিস্থিতি প্রয়োজন সেটাকে তৈরি করার জন্য বিএফএফইএ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। রপ্তানি বাণিজ্যে ভেনামির একটা বিশাল ভূমিকা রয়েছে। এই চিংড়ি রপ্তানি বাণিজ্যে ভেনামি সারাবিশ্বে ৭৭ শতাংশ মার্কেট দখল করে রয়েছে। যে প্রডাক্টটা বাংলাদেশে নেই, আমরা সেই প্রডাক্টটা বিশ্বের দরবারে নেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছি। আমাকে যখন বিদেশি ক্রেতারা ক্রয় অর্ডার দিচ্ছে, তখন বাগদার পাশাপাশি ভেনামি চাচ্ছে। শুধু বাগদা-গলদা রপ্তানি করতে পারছি, কিন্তু ৭৭ শতাংশ দখল করে রাখা বড় মার্কেটের অংশে আমরা প্রবেশ করতে পারছি না ভেনামি ছাড়া।
তিনি আরও বলেন, ২০১৯ সালে পরীক্ষামূলক অনুমোদন পাওয়ার পরে করোনা আক্রান্ত হলো সারাবিশ্ব। এরপর ২০২১ সালে একটি পাইলট প্রকল্পে ভেনামির পরীক্ষামূলক চাষে হেক্টর প্রতি প্রায় ১০ হাজার মেট্রিক টন উৎপাদন হয়েছে। এখন পাইকগাছা ও বটিয়াঘাটা দুটি স্থানে আমরা পাইলট প্রকল্পে আছি। এখন পাইলট প্রকল্পের সফলতা এবং অর্জনগুলো যদি সরকারের পছন্দনীয় হয়, তখন হয়তো সরকার বাণিজ্যিকভাবে চাষের সুযোগ করে দেবে।
বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুড্স এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি এস হুমায়ুন কবির বলেন, ভেনামি চাষ বাংলাদেশে হচ্ছে না। এখনো পর্যন্ত সরকার বাণিজ্যিকভাবে ভেনামির চাষের অনুমতি দেইনি। পরীক্ষামূলকভাবে পাইলট প্রকল্পে ভেনামি চিংড়ির চাষ করেছি। এক হেক্টর জমিতে সনাতন পদ্ধতিতে ৩৫০ কেজি বাগদা চিংড়ি পেয়ে থাকি। সেই এক হেক্টর জমিতে যদি ভেনামি চিংড়ি চাষ করি তাহলে আমরা পাব ১০ টন। তাহলে প্রডাকশন কস্ট কমে আসবে। ফলে আমরা কমে কিনে বিক্রি করতে পারব। ৭৮ শতাংশ ভোক্তার কাছে আমরা ভেনামি চিংড়ি পৌঁছাতে পারব। আমরা বাগদা এবং গলদার মার্কেটে আছি। যার মার্কেট ১৬ শতাংশ। এতে আমরা লাভ করতে পারছি না। ওই বাজারে আমাদের যেতে হবে। তাহলে দেশে বৈদেশিক মুদ্রা আসবে, কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে।
তিনি বলেন, এ বছর ৮টি প্রতিষ্ঠানকে সরাসরি ও চারটি প্রতিষ্ঠানকে শর্তসাপেক্ষে পাইলট প্রকল্প হিসেবে এক বছরের জন্য ভেনামি চাষের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে এ বছর যশোরের এমইউ সি ফুডস লিমিটেড খুলনার দুটি স্থানে পরীক্ষামূলক চাষ করছে। সময়মতো অনুমতি না দেওয়ায় বাকিরা চাষ করতে পারেনি। যারা অনুমতি পেয়েছেন স্বল্প সময়ের জন্য অনুমতি দেওয়ায় তারা ওই প্রকল্পের জন্য ব্যাংক ঋণ পাচ্ছেন না। ভেনামির পোনা থেকে শুরু করে খাদ্য, ওষুধ সবকিছুই আমদানি নির্ভর। এ কারণে ওই চিংড়ি চাষে ব্যাংক ঋণ প্রয়োজন। বাণিজ্যিকভাবে চাষের অনুমতি দিলে তখন দেশেই পোনা ও খাদ্য উৎপাদন করা যাবে। এতে আমদানি নির্ভরতা কমবে।
তিনি আরও বলেন, এ প্রকল্প শেষ হওয়ার পর আমরা চাইব বাণিজ্যিকভাবে ভেনামি চিংড়ি চাষের অনুমতি যেন দেওয়া হয়। বাণিজ্যিকভাবে চাষের অনুমতি পেলে মা চিংড়ি এনে এখানকার হ্যাচারিতে পোনা বানানো হবে। তাহলে বাইরে থেকে আর পোনা আনতে হবে না। নিজেরাই পোনা তৈরি করতে পারব। পাইলট প্রকল্পের পরিবর্তে বাণিজ্যিক অনুমোদন চাচ্ছি। তখন অবকাঠামো থাকলে সাধারণ চাষিরাও ভেনামি চিংড়ির চাষ করতে পারবে। আমরা কোনোভাবে নদীর বাঁধ কেটে লবণপানি ঢুকিয়ে চিংড়ি চাষ সমর্থন করব না।
এ দিকে বুধবার (২৯ জুন) দুপুরে চিংড়ির উৎপাদন ও রপ্তানি বৃদ্ধিতে বাগদার পাশাপাশি ভেনামি চিংড়ির বাণিজ্যিক চাষের আবশ্যকতা বিষয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
ফিশারি প্রোডাক্টস বিজনেস প্রমোশন কাউন্সিল (এফপিবিপিসি) এবং বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুড্স এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন(বিএফএফইএ) এ মতবিনিময় সভার আয়োজন করে। সভায় সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুড্স এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট এস হুমায়ুন কবির।
মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন খুলনা প্রেসক্লাবের সভাপতি নজরুল ইসলাম। বিশেষ অতিথি ছিলেন, খুলনা প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মামুন রেজা, খুলনা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি ফারুক আহমেদ ও বিএফএফইএ এর সিনিয়র সহ-সভাপতি এম খলিলুল্লাহ প্রমুখ।
মোহাম্মদ মিলন/এমএএস