নোয়াখালীর সোনাপুর-চৌমুহনী চৌরাস্তা সড়ক চার লেনে উন্নীতকরণের কাজ শুরু হয়েছে চার বছর আগে। মেয়াদ শেষ হলেও প্রকল্পের কাজ হচ্ছে ধীরগতিতে। সড়কে বড় বড় গর্ত তৈরি হয়ে জমেছে পানি। পাশাপাশি রয়েছে কাদামাটির স্তূপ। এতে জনজীবনে শুরু হয়েছে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ।

৯৬০ কোটি টাকা ব্যয়ের সড়কটিতে প্রতিদিনই ঘটছে দুর্ঘটনা, বিকল হচ্ছে যানবাহনের মূল্যবান যন্ত্রাংশ। দুর্ভোগে পড়ছে এই রুটে চলাচলকারী হাজার হাজার পথচারী, যাত্রী ও চালক। রোদ-বৃষ্টিতে তাদের দুর্ভোগ বেড়ে যায় আরও কয়েক গুণ।

এ অবস্থার জন্য সড়ক বিভাগের গাফিলতি ও নজরদারি এবং ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে দুষছেন স্থানীয়রা। তবে দ্রুত সমস্যা সমাধানের অশ্বাস দিয়েছে সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগ।

সড়কের কাজের দায়িত্ব পাওয়া দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হলো ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড ও ইনফ্রাটেক। আর তারা বলছে, সড়কের দুপাশে থেকে বিদ্যুতের খুঁটি ও গ্যাসের লাইন স্থানান্তর না করা এবং অধিগ্রহণকৃত জায়গা থেকে স্থাপনা না সরানোয় এ দেরি হয়েছে।

স্থানীয়রা জানান, ১৩ দশমিক ৩৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের সোনাপুর-মাইজদী বাজার সাত কিলোমিটার সড়কটি পার হতে সময় লাগার কথা ২০ মিনিট। কিন্তু এখন এক ঘণ্টায়ও পার হতে পারে না যানবাহগুলো। তারা বলছেন, সওজের নির্দেশনা ও তাগাদাও মানছে না ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দুটি।

সড়ক বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ২০১৭ সালে সোনাপুর-চৌমুহনী চৌরাস্তা সড়ক চার লেন উন্নীতকরণকাজের প্রকল্প পাস হয়। ২০২০ সালের জুন মাসে কাজ বুঝিয়ে দেওয়ার কথা ছিল। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ না হলে পরে আরও দুই বছর মেয়াদ বাড়ানো হয়। চার বছর ধরে চলা কাজ এখনো শেষ করতে পারেননি ঠিকাদাররা। কিন্তু ৬০ শতাংশ বিল তারা তুলে নিয়েছেন।

সরেজমিনে সোনাপুর-চৌমুহনী চৌরাস্তা সড়ক উত্তর সোনাপুর, দত্তেরহাট, মাইজদী ও মাইজদী বাজার অংশে দেখা গেছে, গুরুত্বপূর্ণ এ আঞ্চলিক মহাসড়ক বেহাল। চার লেনের জন্য প্রশস্তকরণকাজ চলমান থাকায় সড়কের পাশে মাটি খুঁড়ে বড় বড় গর্ত করা হয়েছে। কোথাও গর্ত বালু দিয়ে ভরাটের কাজ চলছে, কোথাও জমাট বেঁধেছে পানি। আর এ পানির কারণে মূল সড়কের পিচঢালাই-খোয়া উঠে গিয়ে বড় বড় খানাখন্দের সৃষ্টি হয়েছে।

এ কারণে কাদামাটি স্যাঁতসেঁতে হয়ে আছে পুরো সড়কে। নোয়াখালী শহরে যাওয়ার বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় এই সড়ক দিয়ে ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত যানবাহন চলাচল অব্যাহত রয়েছে। এতে চালক, যাত্রী ও পথচারীরা ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। সোনাপুর-চৌরাস্তা পর্যন্ত ১৩ দশমিক ৩৮ কিলোমিটার সড়ক অংশের ৩টি প্যাকেজের মধ্যে ২ ও ৩ নম্বর প্যাকেজের প্রায় ৬ কিলোমিটার সড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ এখনো বাকি আছে।

সোনাপুর-চৌমুহনী সড়কে চলাচলকারী আবদুল খালেক, জাকির হোসেন, নজরুল ইসলাম, সুমাইয়া বেগমসহ ভুক্তভোগী কয়েকজন অভিযোগ করে বলেন, অফিস-আদালত, হাসপাতালসহ নানা গুরুতপূর্ণ প্রতিষ্ঠান জেলা শহর মাইজদীতে অবস্থিত। যে কারণে প্রতিনিয়ত আসতে হয় এখানে। বিকল্প সড়ক না থাকায় এ সড়কই ভরসা। কিন্তু তাদের খামখেয়ালিতে দিনের পর দিন ভুগছি আমরা।

তারা আরও বলেন, সোনাপুর থেকে জেলা শহরে যেতে যেখানে আগে ১২ থেকে ১৫ মিনিট সময় লাগত, এখন প্রায় ৪০ থেকে ৪৫ মিনিট সময় লাগে। আবার ভাঙা সড়কের অজুহাতে পরিবহনে আদায় করা হচ্ছে দ্বিগুণ ভাড়া। যে কারণে সময় ও অর্থ নষ্টসহ নানা সমস্যায় পড়তে হচ্ছে আমাদের।

সড়কে টেকসই কাজ হচ্ছে না জানিয়ে তারা বলেন, সড়কের কাজে নিম্নমানের পাথর, ইট ও বালু ব্যবহার করা হচ্ছে। কোথাও কোথাও সড়ক উন্নয়নের বক্স বৃষ্টির পানিতে বালুর পরিবর্তে মাটিতে ভরে যাচ্ছে। পাথরের জায়গায় ইট ঢুকিয়ে দিচ্ছে। সোনাপুর জিরো পয়েন্ট এলাকায় আরসিসি ঢালাইয়ের কাজে ব্যবহার করা হয়েছে নিম্নমানের বাংলা রড, পরিমাণে কম দেওয়া হয়েছে সিমেন্ট। এসব অনিয়মে সড়ক বিভাগের তদারকির অভাব রয়েছে বলেও জানান ভুক্তভোগীরা।

সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালক ইসমাইল, আবদুল করিম; বাসচালক জামাল উদ্দিন বলেন, এ সড়ক দিয়ে একবার সোনাপুর থেকে মাইজদী কিংবা মাইজদী থেকে সোনাপুর গেলে দ্বিতীয়বার আর যাতায়াত করতে মন চায় না। ভাঙা সড়ক দিয়ে চলতে গিয়ে প্রতিনিয়তই দুর্ঘটনার শিকার হতে হয়। কখনো বিকল হয়ে যায় যানবাহন। 

ব্যাটারিচালিত রিকশাচালক নুর মোহাম্মদ বলেন, মাঝেমধ্যে মাঝ রাস্তায় কাদার মধ্যে রিকশা আটকে যায়। তখন যাত্রী নামিয়ে ঠেলতে হয়। আবার একটু বেশি ভাড়া আদায় করলেও লাভের চেয়ে দণ্ড বেশি হচ্ছে।

এ বিষয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের লোকজনের দাবি, সড়ক বিভাগ সোনাপুর-চৌমুহনী চৌরাস্তা সড়কের দুপাশে থেকে বিদ্যুতের খুঁটি ও গ্যাসের লাইন সময়মতো স্থানান্তর না করায় চার লেনের কাজ এগিয়ে নিতে কিছুটা দেরি হয়েছে। এ ছাড়া সড়ক চার লেনে উন্নীতকরণের জন্য অধিগ্রহণ করা জায়গার ওপর থেকে সময়মতো স্থাপনা সরিয়ে না নেওয়ায় কাজ বাধাগ্রস্ত হয়েছে।

ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির প্রজেক্ট ম্যানেজার মাসুম বিল্লাহ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা চেষ্টা করছি দ্রুত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে। তবে শহরের স্থাপনা এবং বিদ্যুৎ ও গ্যাসলাইন যথাসময়ে সরিয়ে না নেওয়ায় কাজ এগিয়ে নিতে পারিনি।

তিনি আরও বলেন, প্রতিনিয়তই বড় গর্তগুলোতে ইট-বালু ফেলে খানাখন্দ পূরণ করা হচ্ছে। বৃষ্টির কারণে ইট-বালু সরে গিয়ে কাদামাটি আর পানি জমাট বাঁধছে। তবু নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে পারবেন বলে আশা করছেন তিনি।

সড়ক ও জনপথ বিভাগের (সওজ) নোয়াখালী কার্যালয়ের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মো. নিজাম উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রকল্প ২০১৮ সালে শুরু হলেও অধিগ্রহণ কাজ শেষ হয়েছে ২০২১ সালের নভেম্বরে। আমরা এই ছয় মাসে উল্লেখযোগ্য অংশে কাজ শেষ করেছি। যে অংশে কাজ হচ্ছে, সেখানে ড্রেনেজ ব্যবস্থা সঠিকভাবে নেই।

এ ছাড়া বর্ষা আসার কারণে কাজে সমস্যা হচ্ছে। বৃষ্টি হলেই লোকালয়ের পানি রাস্তায় চলে আসে। ড্রেনেজ ব্যবস্থা ভালো না হওয়ায় রাস্তায় কাদামাটি জমে যাচ্ছে। যদি কিছুটা খরা পাওয়া যায়, তাহলে দ্রুত প্রকল্পটি শেষ হবে বলে জানান তিনি।

নোয়াখালী পৌরসভার মেয়র সহিদ উল্যাহ খান সোহেল ঢাকা পোস্টকে বলেন, ড্রেন নির্মাণ করা হচ্ছে। এ ছাড়া পানি যেন জমতে না পারে, সে জন্য আলাদাভাবে পানি নামার জন্য রাস্তা করে দেওয়া হচ্ছে। আমরা চাই চার লেনের কাজ দ্রুত শেষ হোক। জনগণ এর সুবিধা ভোগ করুক।

সড়ক ও জনপথ বিভাগের (সওজ) নোয়াখালী কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ আহাদ উল্যাহ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ভূমি অধিগ্রহণে দেরির কারণে সড়কের কাজে গতি কমে গেছে। তবে এখন পুরোদমে কাজ চলছে। ইতোমধ্যে প্রকল্পের ৭৩ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। 

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে তাগাদা দিয়েছেন কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, কাজ দ্রুত শেষ করার জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে গত ৮ মাসে ২০টির বেশি চিঠি দিয়েছি। অনেকবার তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছি। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে পুরো প্রকল্পের কাজ শেষ হবে।

এনএ