বছরে খামার থেকে ২০০ গরু বিক্রি করেন শিহাব
২০১৮ সালে সাত একর পতিত জমিতে একটি শেড বানিয়ে ৮০টি গরু দিয়ে যাত্রা শুরু করেন আইনজীবী শিহাব উদ্দিন শাহিন। এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি তাকে। এখন প্রতিবছর ২০০ গরু বিক্রি করেন তিনি। তার সফলতা দেখে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন জেলার নতুন খামারিরা।
শিহাব উদ্দিন পুরো খামারটিতে রেখেছেন আধুনিকতার ছোঁয়া। শেডের ভেতরে প্রতিটি গরুর জন্য স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে তৈরি করা হয়েছে আলাদা আলাদা চৌবাচ্চা। রয়েছে গরুর গোসল, চিকিৎসা ও প্রজননের জন্য আলাদা ব্যবস্থা।
বিজ্ঞাপন
নোয়াখালীর সদর উপজেলার শুল্লুকিয়া ইউনিয়নের চর উড়িয়ার খলিলের দরজা এলাকায় এমন উন্নত ও আধুনিক মানফাত মিট ক্যাটেল অ্যান্ড ডেইরি ফার্ম খামারটি সবার দৃষ্টি কাড়ছে।
পৈতৃক ব্যবসার সূত্র ধরে খামারটি তৈরি করেছেন শিহাব উদ্দিন শাহিন। বলা হচ্ছে বৃহত্তর নোয়াখালী ও কুমিল্লা অঞ্চলের গরু মোটাতাজাকরণের সবচেয়ে বড় খামার এটি।
মোটাতাজা ও দুগ্ধ উৎপাদনের জন্য ৮০টি শাহিওয়াল ও ফ্রিজিয়ান জাতের গরু দিয়ে যাত্রা শুরু হয়। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী প্রতিদিন গমের ভুসি, মুগডাল ভুসি, মসুর ভুসি, সয়াবিন খৈল, কাঁচা ঘাস, খড় ও লবণ ছাড়াও দেশীয় বিভিন্ন দানাদার খাবার দেওয়া হয় গরুকে। সাতজন শ্রমিক সারাক্ষণ সেবায় খামারের কাজে নিয়োজিত থাকেন।
সরেজমিনে দেখা যায়, দূর থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই গরুর খামার এটি। ভেতরে নজর কাড়ার মতো সাজানো গোছানো। সারিবদ্ধ গাভী ও ষাঁড় খাবার খাচ্ছে। তিনটি শেডে এবছর গরু রয়েছে দুই শতাধিক। এসব গরুর লালন পালন এবং যত্নে কাজ করছে সাত জন শ্রমিক। খামারে ঢুকেই প্রথম শেডে রয়েছে গাভী। দ্বিতীয় ও তৃতীয় শেডে রয়েছে মোটাতাজা করণ গরু।
কর্মরত শ্রমিক আব্দুর রহিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা সাতজন কর্মচারী গরুগুলোর যত্ন নেই। সপ্তাহে দুই দিন ব্লিসিং পাউডার ও চুন দিয়ে খামার পরিষ্কার করে রাখি। শুধু গরু কেনার জন্য নয়, অনেকেই শখ করে খামার দেখতে আসেন। মশা-মাছি কোনো রকমের দুর্গন্ধ নেই খামারে। সুন্দর পরিবেশ আর আধুনিক উপায়ে গরু পালন করি আমরা।
খামারের মালিক উদ্যোক্তা শিহাব উদ্দিন শাহিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, স্বাধীনতার আগ থেকেই আমাদের পরিবার কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত। আমাদের আগে বাথান ছিল, যা এখানো আছে। বর্তমানে বাথানে দেশীয় গরু, মহিষ ও ভেড়া রয়েছে। দীর্ঘদিন আমাদের দুধের গাভি ছিল। আমি সেখান থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছি।
আমাদের পতিত জায়গায় বছরে একবার ধান চাষ হতো আর সারা বছর পড়ে থাকত। এর বহুমুখী ব্যবহার করার জন্য আমি খামার শুরু করেছি। গরুর পাশাপাশি মাছের ও পোলট্রি খামার রয়েছে এখানে। ঈদুল আজহাসহ সারা বছরে কীভাবে এ অঞ্চলের মানুষকে পুষ্টিকর ও স্বাস্থ্যসম্মত গরুর মাংস দেওয়া যায়, সে লক্ষ্যে খামারটি করেছি।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে খামারের পাঁচ বছর চলছে। যদি ঈদুল আজহা উপলক্ষে মানুষকে সুস্থসবল ও সুঠাম দেহের গরু দিতে পারি, তাহলে তাদের মানসিক প্রশান্তির পাশাপাশি আমিও সওয়াবের অধিকারী হলাম। আমি খুব লাভের চিন্তা করি না। কেননা, আমিও এই সমাজের একজন। মানুষ যদি কোরবানির সময় প্রতারিত না হয়ে ভালো গরু পায়, তাহলে সবাই কমবেশি উপকৃত হবে। আমার দেখাদেখি জেলায় অন্যরাও উদ্বুদ্ধ হচ্ছে।
নোয়াখালীতে প্রথম আমি লাইভ ওয়েট স্কেলে গরু বিক্রি শুরু করি, উল্লেখ করে তিনি বলেন, পরে আমার দেখাদেখি অন্যরাও শুরু করেছে। আমি মনে করি বাজারে গেলে মানুষ বিভিন্নভাবে প্রতারিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। কোরবানির হাটে দালাল থাকে, তারা মানুষকে বিভ্রান্তিতে ফেলে। খামারে এলে পছন্দের গরু লাইভ ওয়েট স্কেলে কিনতে পারে। আমরা শতভাগ সুষ্ঠু ও সুঠাম দেহের গরু দিয়ে থাকি। পুরো বছর ধরে জেলা প্রাণিসম্পদের পরিচর্যার মধ্যে গরুগুলো বড় হতে থঅকে। যে যে ভ্যাকসিন দেওয়া প্রয়োজন, সব দেওয়া হয়।
শাহিনের খামারে প্রতিদিন একবার বা দুবার গরুগুলোকে গোসল করানো হয়। দুর্গন্ধমুক্ত রাখা হয়। এখানে ঘাসের চাষ করেছেন তিনি, যা দিয়ে গরুগুলোর ঘাসের চাহিদা পূরণ হয়। পাশাপাশি খড়, ভুসি, পোলট্রি ফিড ব্যবহার করা হয়।
তিনি বলেন, আমি ৮০টা গরু দিয়ে শুরু করেছিলাম। এর মধ্যে ১২টি দুধের গরু ছিল। বর্তমানে ২৫০টি গরু রয়েছে। আমার বাবার জমি হওয়ায় কোনো ভাড়া দিতে হয় না। শেড নির্মাণসহ তখন প্রায় ৩ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। বর্তমানে ১ লাখ থেকে ৫ লাখ টাকা দামের পর্যন্ত গরু রয়েছে। বর্তমানে গোখাদ্যের দাম বেশি হওয়ায় আমাদের সামগ্রিক খরচ বেড়ে গেছে।
সরকার খামারিদের উদ্বুদ্ধ করেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, গত কয়েক বছর প্রতিবেশী দেশ থেকে গরু আনা হয় না। এতে আমাদের খামারিরা উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। এটা সরকারের অসাধারণ সিদ্ধান্ত। অল্প কয়েক বছরের মধ্যে আমার স্বয়ংসম্পূর্ণ হব। এতে নতুন খামারি বাড়ছে। সরকার প্রণোদনা দিলে আমরা দেশের চাহিদা পূরণ করে বিদেশে গরু রপ্তানি করতে পারব।
প্রাণি সম্পদ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, বৃহত্তর নোয়াখালীর তিন জেলা ও বৃহত্তর কুমিল্লার তিন জেলার মধ্যে শাহিনের খামারটি সবচেয়ে বড়। তার খামারে সারা বছর গরু বেচাকেনা হয়ে থাকে। তিনি ওয়েবসাইটের মাধ্যমে গরুর ছবি ভিডিও প্রকাশ করেন। এতে মানুষ আশ্বস্ত হয় গরু কিনতে।
সদর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. গৌতম চন্দ্র দাস ঢাকা পোস্টকে বলেন, দীর্ঘদিন থেকেই আমি এই আধুনিক গরুর খামারের নানা দিক নিয়ে পরামর্শ দিয়ে আসছি। গরুর খাদ্য, স্বাস্থ্যচিকিৎসা ছাড়াও বিভিন্ন বিষয়ে খামারির সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছি। গরুর খুরারোগের ভ্যাকসিনসহ সব ভ্যাকসিন যথাসময়ে দেওয়া হচ্ছে।
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. কাজী রফিকুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, নোয়াখালীতে কোরবানির জন্য এ বছর ১ লাখ গবাদিপশু লালনপালন করা হচ্ছে, যা আমাদের চাহিদার থেকে ১০ হাজার বেশি। যা আমরা অন্য জেলায় পাঠাতে পারব। ঈদুল আজহা সামনে রেখে ক্রেতা-বিক্রেতা যেন অবাধে তাদের পশু ক্রয়-বিক্রয় করতে পারে, সে জন্য জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে মিটিং করা হয়েছে।
রাস্তাঘাট ও পশুরহাট গুলোতে কঠোর নিরাপত্তা থাকবে। প্রতি হাটে একজন করে ভেটেরিনারি মেডিকেল টিম থাকবে। যেহেতু ডিজিটাল বাংলাদেশ, তাই ক্রেতা-বিক্রেতার জন্য অনলাইনে একাধিক প্লাটফর্ম তৈরি করা হয়েছে। এখান থেকেও তারা উপকার পাবেন বলেও আশা করেন এ কর্মকর্তা।
এনএ