স্কুল-কলেজের গণ্ডি পেরিয়েছে অপু। স্নাতকে তৃতীয় বর্ষ পর্যন্ত পড়াও হয়েছে। পাশাপাশি ডিগ্রি সম্পন্নের সনদ অর্জন করেছেন। পড়ালেখা করে নিজেকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্ন ছিল তার। সেই স্বপ্ন পূরণে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যোগ্যতানুযায়ী চাকরির চেষ্টাও করেছেন। কিন্তু ভাগ্য পরিবর্তনে কোনো চাকরি জোটেনি তাদের। বরং তৃতীয় লিঙ্গের (হিজড়া) হওয়ায় চাকরিদাতারা তাকে বরাবরই ‘না’ শব্দটি শুনিয়েছেন।

অনেক বিড়ম্বনার ধকল কাটিয়ে পড়ালেখা শেষে চাকরি না পেয়ে বাধ্য হয়ে ভিক্ষাবৃত্তিতে জড়িয়ে পড়েন অপু। এখন রংচটা সাজসজ্জা নিয়ে পথেঘাটে হাত পেতে জীবন চলছে তার।

অপুর মতো রংপুরে তৃতীয় লিঙ্গের অনেকেরই শিক্ষাগত যোগ্যতা রয়েছে। যাদের সংখ্যা খুব বেশি নয়। তারপরও তারা চাকরিবঞ্চিত। সুনির্দিষ্ট কোটা না থাকায় ছোট-বড় প্রতিষ্ঠানসহ সরকারি চাকরিতেও সুযোগ পাচ্ছেন না তারা। সমাজ, পরিবার ও স্বাভাবিক জীবন― সবকিছু থেকেই বঞ্চিত এই মানুষগুলো। সামাজিক বৈষম্য, অসম দৃষ্টিভঙ্গি আর স্বজন-বন্ধুহীন অস্পৃশ্য জীবনযন্ত্রণায় ধুঁকে ধুঁকে দিনাতিপাত করছেন অপুর মতো তৃতীয় লিঙ্গের অনেকেই।

পথচারীদের কাছ থেকে টাকা তুলছেন তৃতীয় লিঙ্গের একজন

অপু জানান, তার আসল নাম শাওন। কিন্তু তৃতীয় লিঙ্গের কারণে এখন তিনি শাওন থেকে এখন অপু। এটি তার দলীয় নাম হলেও মানুষের চোখেমুখে তাকে ‘হিজড়া’ হিসেবে ডাকা হয়। শত কষ্ট আর যন্ত্রণাকে বুকে চেপে ধরে অনেক জায়গায় চাকরির জন্য চেষ্টা করেছেন। শূন্য পদে জনবল নেওয়ার বিজ্ঞপ্তি দেখে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন অফিসে লিখিত পরীক্ষাসহ মৌখিক পরীক্ষাও দিয়েছেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষ তৃতীয় লিঙ্গের পরিচয় জানতে পেরে চাকরিতে নিয়োগ দেয়নি।

অপু বলেন, আমি বেশ কিছু জায়গায় ইন্টারভিউ ভালো করেছি। কিন্তু যখন জানতে পেরেছে আমি তৃতীয় লিঙ্গের। তখন আমাকে সেখানে নেওয়া হয়নি। এমন অনেক হয়েছে জীবনে। যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও এভাবে বঞ্চিত হয়ে থাকাটা কষ্টের। কিন্তু সরকারের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ও কোনো কার্যকর পদক্ষেপ না থাকায় আমরা শুধু পরিবার, সমাজ থেকেই নয়, পড়ালেখা করে চাকরি থেকেও বঞ্চিত।

দলনেতা রানা

রংপুর জেলায় ৩৭০ জনের অধিক তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ রয়েছেন। যাদের মধ্যে অন্তত ৩০ থেকে ৩৫ জন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেছেন। আর গোটা দশেক রয়েছেন, যাদের কেউ উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতকের গণ্ডি পেরিয়েছেন। তৃতীয় লিঙ্গের এসব মানুষের অভিযোগ, সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানেই পরিচ্ছন্নতাকর্মী, অফিস সহায়ক, পিয়ন, নৈশপ্রহরী নেওয়া হয়। এসব পদে যদি তাদের যোগ্যতা ও শিক্ষা অনুযায়ী চাকরি দেওয়া হয়, তাহেল তাদের কর্মসংস্থান হতো। কিন্তু কোথাও তাদের চাকরির সুযোগ নেই।

রংপুর নগরের নূরপুর জে এন সি রোডে (ছড়ারপাড়) একটি জরাজীর্ণ ভাড়া বাসায় থাকেন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ। সেখানে তিনটা রুমে গাদাগাদি করে অন্তত ৫০ জন বসবাস করছেন। অবহেলিত এই জনগোষ্ঠী তাদের অধিকার আদায়ে গড়ে তুলেছেন ন্যায় অধিকার তৃতীয় লিঙ্গ উন্নয়ন সংস্থা। কিন্তু বাস্তবতার কাছে তারা মানবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। আবাসন-সুবিধাসহ কর্ম এবং চিকিৎসা দুটোই যেন তাদের জন্য অধরা। অথচ কাজের সুযোগ পেলে এই মানুষেরা বোঝা না হয়ে হতে পারেন একেকজন স্বাবলম্বী মানুষ।

নূরপূরে বসবাসরত তৃতীয় লিঙ্গ জনগোষ্ঠীর দলনেতা আনোয়ারুল ইসলাম রানা। তিনিও দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন। ইচ্ছে ছিল উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার। কিন্তু সামাজিক হীনম্মন্যতা, অর্থনৈতিক দূরবস্থা, পরিবারের অভাব-অনটন আর সহপাঠী ও শিক্ষকদের অসম দৃষ্টিভঙ্গি তাকে বেশি দূর এগোতে দেয়নি। এসএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণ করে পরীক্ষা না দিলেও পরবর্তীতে তিনি ভর্তি হয়েছিলেন উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু সেখানেও তার আঙ্গিক বৈসাদৃশ্য বেশি দিন টিকে থাকতে দেয়নি।

কর্ম না করে ভিক্ষাবৃত্তি পেশায় তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর জড়ানো প্রসঙ্গে ঢাকা পোস্টকে রানা বলেন, আমাদের কোনো কর্মসংস্থান নেই। কিন্তু পেট তো ক্ষুধা মানে না। ফলে রাস্তায় মানুষের কাছে হাত পাততে বাধ্য হই। লোকে বলে আমরা চাঁদাবাজি করি। আমাদের কাজ দেন। যেন পেট ভরে খেতে পারি। সমাজে অন্য সবার মতো চলতে পারি। অনেকের শিক্ষা আছে, যোগ্যতা আছে। কিন্তু চাকরি নেই, কর্ম নেই। কর্মের সুযোগ দেওয়া হলে অবশ্যই পরিবর্তন আসবে।

কারিগরি শিক্ষায় নিজেকে বদলে নেওয়ার চেষ্টায় টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন মাসুদ। কিন্তু সেখানে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার কারণে তার পড়ালেখা হয়নি। এসএসসি পাস করা মাসুদ পিয়ন ও অফিস সহকারী হিসেবে বেশ কয়েকটি চাকরির পরীক্ষা দিয়েছেন। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ হওয়ায় ‘চাকরি নামক ভাগ্য’ তার সহায়ক হয়নি। এ কারণে মাসুদ থেকে দোলা হয়ে ওঠা হতাশ এ মানুষটিও এখন ভিক্ষাবৃত্তিতে জড়িয়েছেন।  

রংপুরে একটি মেসে থাকেন পপি সরকার। তিনি মিঠাপুকুরের বালারহাট আদর্শ ডিগ্রি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী। নিজের মা-বাবা ও স্বজনদের ছেড়ে মেসে থাকতে তার কষ্ট হয়। মন কাঁদে মায়ের মমতায় আঁচলে ফিরে যেতে। কিন্তু  হিজড়া শব্দটি তাকে পরিবার থেকে আলাদা করে দিয়েছে। এখন  ইচ্ছে হলেই মায়ের আদর পাওয়ার সুযোগ নেই তার। তার বাবার পাঠানো টাকায় মেসে থেকে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু কতদূর চালিয়ে যেতে পারবেন, সে বিষয়েও তিনি অনিশ্চিত।

একসঙ্গে গাদাগাদি করে বাস করেন তারা

পপি বলেন, আমাদের এই সমাজ ভালো চোখে দেখে না। কেউ কোথাও ভালোভাবে দেখার চেষ্টাও করে না। আমাদের পরিবারে জায়গা হয় না। বাইরে কেউ বাড়িভাড়াও দেয় না। আমাদের জন্য কর্মসংস্থানও নেই। এত কিছুর পরও পড়াশোনা করছি, যদি কখনো চাকরির সুযোগ হয়। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারব কি না জানি না, কিন্তু শিক্ষিত তো হতে পারব।

এ নিয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) রংপুর মহানগর সভাপতি অধ্যক্ষ ফখরুল আনাম বেঞ্জু ঢাকা পোস্টকে বলেন, দীর্ঘকাল ধরে আত্মীয়স্বজনহীন, বন্ধুবিহীন, অস্পৃশ্য জীবনের এক ভয়াবহ শাস্তি মাথায় নিয়ে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ। তারা সমাজের মূল স্রোতোধারা থেকে বঞ্চিত। মানুষ হিসেবে তাদের মৌলিক ও মানবিক অধিকার আজও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। পিছিয়ে পড়া এই জনগোষ্ঠীর অনেকেই শিক্ষিত। এখনো অনেকে পড়ালেখা করছেন। তাদের স্বপ্ন জীবন পরিবর্তনের। কিন্তু বর্তমান সমাজব্যবস্থায় তারা আমাদের চোখে যাযাবর। তাদের এখনো ভাসমানভাবে জীবন যাপন করতে হচ্ছে।

পরিবহনে টাকা তুলছেন তৃতীয় লিঙ্গের একজন

ফখরুল আনাম বলেন, এই জনগোষ্ঠীকে ভিক্ষাবৃত্তি বা চাঁদা তোলা থেকে বের করে আনা এক দিনে সম্ভব নয়। এ জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার পাশাপাশি তাদের প্রশিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষাগত যোগ্যতার মূল্যায়ন বাড়াতে তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ দিতে হবে। নয় তো তারা শিক্ষাবিমুখ হয়ে পড়বেন। আজ সঠিক কর্মসংস্থানের অভাবে তারা বিয়ে বাড়িতে নয়তো নবজাতকের বাড়িতে চাঁদা তোলেন। কখনো রাস্তাঘাট, হাটবাজারে দলবেঁধে ভিক্ষাবৃত্তি করছেন। এটা থেকে এই জনগোষ্ঠীকে সরিয়ে আনতে সঠিক আবাসন প্রদান, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করার প্রয়োজন রয়েছে।

এ ব্যাপারে রংপুর জেলা সমাজসেবা উপপরিচালক মো. আব্দুল মতিন ঢাকা পোস্টকে জানান, জেলায় তৃতীয় লিঙ্গের ৩৭০ জনের নামের তালিকা রয়েছে। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন শিক্ষিত। তাদের কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ বিভিন্ন জায়গাতে চাকরির ব্যবস্থা করে দিতে চেষ্টা করা হয়। ইতোমধ্যে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতায় এই জনগোষ্ঠীর ১৫০ জনকে বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।

তিনি আরও জানান, তৃতীয় লিঙ্গের ১৫০ জনকে তিন ব্যাচে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। তাদের সেলাই মেশিন, কম্পিউটার, বিউটিশিয়ান, রাঁধুনী, ইলেকট্রিক সার্ভিসিং বিষয়ে ৫০ দিনের প্রশিক্ষণ দেওয়ার পাশাপাশি নৈতিকতার শিক্ষা দেওয়া হয়। ভিক্ষাবৃত্তি ছেড়ে তাদের কর্মমুখী হওয়ার জন্য বিভিন্ন সময়ে অনুদান দেওয়া হয়েছে।

এনএ