একটি সাইকেল দিয়ে মাত্র আড়াই মাসে ৫০ জন মেয়েকে বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন কিশোরগঞ্জের ফারাবি হাসান মাহদি। এখন তার লক্ষ্য, প্রতিটি জেলা শহরে ১০০ জন মেয়েকে এ প্রশিক্ষণের আওতায় আনা। সে জন্য প্রশিক্ষণের কেন্দ্র হিসেবে তিনি বেছে নিয়েছেন শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম স্টেডিয়ামকে।

তার প্রশিক্ষণ পেয়ে ৫০ জন মেয়ে এখন সাইকেল চালাচ্ছে। আর নতুন করে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে আরও ১০ জন। অপেক্ষমাণ তালিকায় আছে আরও ৪০ জন।

বিডি সাইক্লোহোলিক (bdcycloholic) কিশোরগঞ্জ নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এই সাইকেল চালানোর প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। এ সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা হলেন জেলা শহরের বত্রিশ এলাকার ফারাবি হাসান মাহদি।

ইতোমধ্যেই এই সংগঠন থেকে তিন ধাপের প্রশিক্ষণ শেষ করেছে ৬০ জন মেয়ে। কারও কাছ থেকেই তিনি টাকা গ্রহণ করেননি। এমন মহৎ কাজ কারায় শহরের সাবার প্রশংসা কুড়াচ্ছেন ফারাবি মাহদি।

ফারাবি হাসান মাহদির সঙ্গে শহরের শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম স্টেডিয়ামে কথা হলে তিনি ঢাকা পোস্টেকে জানান, তিনি একজন ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করছেন। তিনি একদিন কোনো এক কাজে পাশের জেলা ময়মনসিংহে গিয়ে দেখেন সেখানে অনেক মেয়েই সাইকেল চালাচ্ছে। সেটা দেখে তিনি সিদ্ধান্ত নেন মেয়েদের সাইকেল চালানোর প্রশিক্ষণ দেবেন।

তিনি আরও জানান, বিডি সাইক্লোহোলিক (bdcycloholic) কিশোরগঞ্জ নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। আর সেই সংগঠনের মাধ্যমেই তিনি এখন মেয়েদের সাইকেল শেখানো প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন।

সংগঠনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের প্রশ্নে ফারাবি জানান, তিনি প্রতিটি জেলা শহরে ১০০ জন মেয়েকে বিনামূল্যে এই সাইকেল চালানোর প্রশিক্ষণ দিতে চান। যারা প্রশিক্ষণ পাবে, তারাই পরে বিভিন্ন স্কুলে গিয়ে মেয়েদের ফ্রি প্রশিক্ষণ দেবে।

শুধু মেয়েদেরই কেন সাইকেল চালানোর প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ছেলেরা তো সহজেই সাইকেল চালানো শিখতে পারে। কিন্তু মেয়েরা পারে না। তাদের অনেক প্রতিবন্ধকতার মধ্যে পড়তে হয়। তাই মেয়েদেরই টার্গেট করে এ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করি। তারপরও আমি পিছপা হইনি। এখনো শেখাচ্ছি।

তার তিনজন মেয়ে বন্ধুকে দিয়ে সাইকেল চালানোর প্রশিক্ষণের শুরু। পরে আস্তে আস্তে ১০ জন, তারপর ১৫ থেকে ৫০ জন। মাত্র আড়াই মাসেই ৫০ জনকে সাইকেল চালানো শেখানো শেষ। রেজিস্ট্রেশন করা হয়ে গেছে ১০০ জনের ওপরে। শিখতেছে ১০ জন ও অপেক্ষায় আছে ৪০ জন।

বিনামূল্যে কেন প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন, এমন প্রশ্নের জবাবে ফারাবি বলেন, আমি একজন সাইক্লিস্ট হিসেবে চাই মেয়েরা সাইক্লিংয়ে আসুক। আর কিশোরগঞ্জ শহরের কথা চিন্তা করলে দেখা যায় মেয়েরা একদম সাইক্লিং করতই না। তাই বিনামূল্যে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছি যেন তাদের আগ্রহ বাড়ে।

আমরা শুধু সাইকেল শেখানোতেই সীমাবদ্ধ না, নারীদের একটা সুন্দর কমিউনিটি তৈরির মাধ্যমে সমাজের অসহায়, সুবিধাবঞ্চিত ও মেধাবীদের পাশে দাঁড়ানোই আমাদের লক্ষ্য।

একটি মাত্র সাইকেল থাকায় আরও তিনজন প্রশিক্ষক জোগাড় করে বড় পরিসরে এ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করবেন। মেয়েরা যখন প্রশিক্ষণ নিতে আসে, তখন ইভটিজিংয়ের শিকার হতে হচ্ছে। এ ছাড়া এই সাইকেল প্রশিক্ষণ আরও সহজতর করতে একটি ওয়াকিটকির প্রয়োজন। তাই তিনি এ সমস্যাগুলো সমাধানে প্রশাসনের সহযোগিতা কামনা করেন।

সাইকেল শিখতে আসা বৃষ্টি বিশ্বাস রিমঝিম নামে এক শিক্ষার্থী ঢাকা পোস্টেকে বলে, আমি সাইকেল চালানো শেখার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে নিজেকে স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলা। বাসা থেকে কলেজে বা প্রইভোটে গেলে রিকশায় করে যেতে হয় সেখানে অনেক টাকা খরচ হয়। কিন্তু সাইকেলে করে গেলে আমার জন্য অনেক সাশ্রয়ী হয়। এ কারণে সাইকেল চালানে শেখা।

তিনি আরও বলেন, আমি নিজের ইচ্ছায় সাইকেল চালানো শিখেছি। আমার মতো সব মেয়েরই সাইকেল চালানো শেখার দরকার আছে। সাইকেল চালানো শেখার পর দুই চাকায় ঘুরে বেড়ানো ইচ্ছাটা পূরণ হবে। মেয়েদের সাইকেল চালানো শিখা জরুরি আমার মনে হয়।

আন্তা রহমান রোজ নামের এক শিক্ষার্থী ঢাকা পোস্টকে বলে, আমি সাইকেল চালানো শিখতে চাচ্ছিলাম অনেক আগে থেকেই কিন্তু শেখার জন্য কাউকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। একজন বন্ধুকে বললাম আমাকে সাইকেল চালানো শেখাবি, তখন সে বলল, বিডি সাইক্লোহোলিক নামে একটি সংগঠন আছে, তারা ফ্রিতে শেখায়। তারপর ফারাবি ভাইয়া সাইকেল চালানো শিখেয়েছেন।

আন্তা আরও বলে, এখন সাইকেল কেনার প্রস্তুতি চলছে। বেসিক শেখানোর পর আমাদের শেখানো হয় ফাস্ট রাইড সেকেন্ড রাইড। আমি ফাস্ট রাইডে যেতে পারিনি বৃষ্টির জন্য। এখন আমি ফাস্ট রাইড শিখব। সাইকেল চালানোর সময় মাঠে ও শেখার সময় রাস্তায়  মারাত্মক ইভটিজিংয়ে শিকার হতে হয়। মানুষজন হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। বলে, মেয়ে সাইকেল চালাচ্ছ। এগুলো উপেক্ষা করে ভাবি, বেগম রোকেয়া তো একা লেখাপড়া করেছেন, আমরা নাহয় একা সাইকেল চালাব।

অভিভাবক মোশাররফ হোসেন ঢাকা পোস্টেকে বলেন, ফারাবি যে কাজটি করছে, সেটা অনেক ভালো। আমি একজন অভিভাবক হিসেবে আমার বোনকেও চাই সাইকেল চালানো শেখাতে। তবে সাইকেল চালানো শিখতে আসা মেয়েরা যেন ইভ-টিজিংয়ে শিকার না হয়, সেগুলো প্রশাসনকেই দেখতে হবে।

কিশোরগঞ্জ জেলা ক্রীড়া কর্মকর্তা মো. আল-আমিন ঢাকা পোস্টেকে বলেন, সাইক্লোহোলিক মেয়েদের ফ্রি সাইকেল চালানোর প্রশিক্ষণ দিচ্ছে, তাদের পাশে আছে জেলা ক্রীড়া অফিস। তাদের একটি মাত্র সাইকেল থাকায় আরও সাইকেলের ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে। প্রাথমিকভাবে তাদের জন্য সাইকেল, সেফটি গার্ডস, প্রাথমিক চিকিৎসা উপকরণ দেওয়ার চেষ্টা করব। কিশোরগঞ্জে যেকোনো প্রতিযোগিতায় মেয়েদের ফলাফল অনেক ভালো। আশা করছি এখান থেকেও একদিন জাতীয় মানের খেলোয়াড় বেরিয়ে আসবে।

এসকে রাসেল/এনএ