সেই মনোয়ারার মাসিক আয় ৫০০০০ টাকা
‘যদি থাকে নসিবে আপনা-আপনি আসিবে। কপালে যা আছে তা ঘটবেই। জীবন মানেই কঠিন সংগ্রাম। মানুষকে পদে পদে বাধার সম্মুখীন হতে হয়। নানা লাঞ্ছনা-বঞ্চনা আর কটূক্তি শুনতে হয়। জীবনযুদ্ধে জয়ী হতে হলে আপনাকে এগুলায় কান না দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। উদ্যম আর সাহস আপনাকে জয়ী করবে। যদি আপনি জয়ী হতে পারেন, তবে যারা আপনাকে নিয়ে কটূক্তি করেছিল, তারাই আপনাকে বাহবা দিবে।’
এভাবেই মনের কথাগুলো ঢাকা পোস্টের কাছে তুলে ধরেছেন হতাশা থেকে উদ্যোক্তা হয়ে ওঠা সিলেটের বালুচর এলাকার বাসিন্দা সৈয়দা মনোয়ারা বেগম (৩৮)। জানিয়েছেন তার জীবনের নানা উত্থান-পতনের ঘটনা। সেসব কাটিয়ে উঠে আজ তিনি পৌঁছেছেন সফলতার শিখরে। জানিয়েছেন হতাশা থেকে নারী উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার গল্প।
বিজ্ঞাপন
জীবনের হতাশাময় দিনগুলো
খুব অল্প বয়সেই বিয়ে হয়েছিল মনোয়ারার। সমাজের আর দশজন নারীর মতো তারও স্বপ্ন ছিল সংসারী হওয়ার। কিন্তু সেই স্বপ্ন তার বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। এক ছেলেসন্তান জন্মের পরই স্বামী মাদকাসক্ত হওয়ায় করতে হয় বিচ্ছেদ। ছেলেকে নিয়ে ওঠেন বাবার বাড়িতে। সেখানেও নানা বাধা, প্রতিকূলতা। হঠাৎ পরিচয় হয় সিলেট জেলা জজ কোর্টের এক আইনজীবীর সঙ্গে। দুজনের বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে একমাত্র ছেলেকে মানার শর্তে ২০১১ সালে আবার বসেন বিয়ের পিঁড়িতে।
শুরুতে সব ঠিক ছিল। কয়েক দিন পর দ্বিতীয় স্বামীর ঘরে জন্ম নেয় এক ফুটফুটে কন্যাসন্তান। ভেবেছিলেন হয়তো কষ্ট ভুলে সুখের দেখা পেয়েছেন। কিন্তু এবারও সুখপাখিটা ওড়াল দিল। দুজনের মধ্যে তৈরি হয় নানা জটিলতার। স্ত্রী-সন্তানের প্রতি তার আইনজীবী স্বামীও হয়ে পড়েন উদাসীন। নেন না পরিবারের খোঁজখবর। ফলে বাধ্য হয়ে আবার চলে আসেন বাবার বাড়ি।
বাবার বাসায় বেশ কয়েক বছর থেকেছিলেন। এবার দিনগুলো কাটতে থাকে ভয়ার্তভাবে। সন্তানদের ভবিষ্যৎ ও ভরণপোষণ নিয়ে পড়েন হতাশায়। তবু ভেঙে পড়েননি। সাহস-সংকল্প নিয়ে শুরু করেন জীবনের আরেকটি অধ্যায়। এবার আর বিয়ে নয়, সিদ্ধান্ত নেন উপার্জন করেই জীবন পার করবেন।
ব্যবসার শুরু ও সফলতার গল্প
সংকল্প মোতাবেক প্রথমে যোগ দেন একটি এনজিওতে। সেখানে অল্প কিছুদিন চাকরি করে ছেড়ে দেন। একদিন বাসার আসবাব কেনার জন্য গিয়েছিলেন একটি শোরুমে। দরদাম দেখে বনিবনা না হওয়ায় বাসায় ফিরে আসেন তিনি। যেহেতু ঘরের আসবাব লাগবেই, তাই তিনি একজন কাঠের মিস্ত্রিকে দিয়ে আসবাব তৈরি করান। এতে তিনি দেখেন যে তার প্রায় অর্ধেক টাকা সাশ্রয় হয়েছে। তিনি সেই মিস্ত্রি সঙ্গে আলাপ করে আসবাবের ব্যবসা শুরু করার চিন্তা করেন। যেই ভাবা সেই কাজ। ২০১৪ সালের প্রথম দিকে মাত্র ৪০ হাজার টাকা দিয়ে তার ভাড়া বাসার গ্যারেজে শুরু করে দেন পুরোনো আসবাব কেনাবেচার ব্যবসা।
এখানেও এল আরেক বাধা। ভাই-বোন কেউই তার এই পেশাকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নেননি। শুধু অনুমতি মেলে মায়ের কাছ থেকে। এমনিতে সিলেট অঞ্চল রক্ষণশীল সমাজের হওয়ায় পাড়াপ্রতিবেশী কেউই ব্যাপারটা ভালোভাবে নেয়নি। কিন্তু মনোয়ারা তো সিদ্ধহস্ত। সমাজকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তিনি শুরু করবেনই কারণ জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত তো আর পাড়াপ্রতিবেশীকে সইতে হয় না।
শুরুতে বেশ ঝামেলা পোহালেও বিভিন্ন জায়গা থেকে পুরোনো আসবাব কিনে তা আবার সামান্য লাভে বিক্রি করে দিতেন। মাঝেমধ্যে পড়তেন লোকসানে। বাসার গ্যারেজে আসবাব বিক্রি করতে হতো বলে ক্রেতারা আসতেন না। পরে দিয়েছেন আসবাবের কারখানা ও একটি শোরুম। তার কারখানায় পুরোনো আসবাব কিনে এনে রং-বার্নিশ করে নতুনের মতো বানিয়ে বিক্রি করেন। আবার নতুন কোনো আসবাবের অর্ডার পেলে তিনি তাও বানিয়ে দেন।
ব্যবসার আয় থেকে ১৬ লাখ টাকায় সিলেট নগরীতে তিন শতক জমি কিনেছেন। তার বড় ছেলেও এখন প্রাপ্তবয়স্ক। পড়ালেখা করছে সিলেটের একটি কলেজের একাদশ শ্রেণিতে। আর ছোট মেয়েকে ভর্তি করিয়েছেন বাসার পার্শ্ববর্তী একটি মাদরাসায়।
উদ্যোক্তা মনোয়ারা তৃপ্তি নিয়ে ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি এখন খুব সুখে আছি। সব খরচ বাদ দিলে মাসে আমার ৫০ হাজার টাকা আয় হয়। আমার প্রতিষ্ঠানে এখন ১৭ জন কর্মচারী কাজ করছেন। আমি মূল কারিগরকে ১৫ হাজার টাকা মাসে বেতন দিই। অন্যদের গড়ে পাঁচ হাজার টাকা করে দিই। তাদের আমি নিজ হাতে বেতন দিই। অনেকগুলো পরিবার আমার ব্যবসার টাকা দিয়ে চলে। এটা ভাবতেই এখন ভালো লাগে।
প্রতিকূল অবস্থায় দৃঢ়চেতা ছিলেন, সেটি মনে করে মনোয়ারা বলেন, আমার ব্যবসার বিষয়টি আমার দ্বিতীয় স্বামী খুব ভালোভাবে নেয়নি। বিভিন্ন মারফতে সে আমাকে প্রায় হুমকি-ধমকি দিত। তার বিরুদ্ধে সিলেট কোর্টে আমার একটি পারিবারিক মামলা এখনো চলমান রয়েছে। এ ছাড়া ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে স্থানীয় মাস্তানরা প্রায় সময় চাঁদাবাজি করতে আসত। আমি কোনো দিনই কাউকে এক টাকাও চাঁদা দিইনি। তবু তারা প্রায় আমাকে বিরক্ত করত। আমি তাদের বিরুদ্ধেও মামলা করেছি। এসব মামলা করার কারণে আমাকে বেশ ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছে।
মনোয়া শুরু উদ্যোক্তা নন, সংগঠকও। তিনি তৃণমূল নারী উদ্যোক্তাদের সংগঠনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। জড়িত ছিলেন সিলেট মেট্রোপলিটন উইমেন্স চেম্বারের সঙ্গে।
বর্তমান যুগের নারীদের বার্তা দিয়ে মনোয়ারা বলেন, নারীরা কখনোই সমাজের বোঝা নন, সেটা প্রথমে নারীকেই অনুধাবন করতে হবে। তারপর উঠে দাঁড়ানোর মানসিকতা তৈরি করতে হবে। ভাবতে হবে নারীদের জন্ম হয়েছে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য। অনেকেই অনেক কথা বলবে, সেগুলাতে আটকালে চলবে না।
বর্তমানে সমাজসেবা করতে চান মনোয়ারা। তাই আগামী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রার্থী হতে চান। হতে চান নারী কাউন্সিলর।
এত কঠিন পথ মাড়ি দিয়ে সফল হয়ে জনপ্রতিনিধি হতে চান কেন, জানতে চাইলে সৈয়দা মনোয়ারা বেগম বলেন, আমি প্রতিশ্রুতিশীল নারীদের প্রতিনিধি হতে চাই। যাতে তারা আমাকে দেখে অনুপ্রেরণা পায়। আর আমি প্রমাণ করে দিতে চাই যে আমি বা নারীরা সমাজের বোঝা নয়, সমাজের সম্পদ।
এনএ