পদ্মা সেতু দক্ষিণাঞ্চলের ৩ কোটি মানুষের জীবনে উন্নয়ন ঘটাতে যাচ্ছে
দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের স্বপ্নের বিষয় এখন পদ্মা সেতু। এটিকে ঘিরে ব্যবসা-বাণিজ্যের নতুন দুয়ার খুলবে বলে স্বপ্ন বুনছে পটুয়াখালী জেলাসহ দক্ষিণের মানুষ। যোগাযোগ সহজীকরণের ফলে এখানকার মানুষের জীবনে আসবে ব্যাপক পরিবর্তন। এই সেতুর কারণে সারা দেশের সঙ্গে সামাজিক-অর্থনৈতিক সেতুবন্ধ রচনা হবে বলে মনে করছেন সচেতন মহল।
এ সেতুর কারণে শুধু শিল্প খাতেই নয়, সুফল পাওয়া যাবে কৃষি ও পর্যটন খাতেও। দক্ষিণাঞ্চলে এসব সম্প্রসারণ জাতীয় অর্থনীতিকে করবে আওর চাঙা। দীর্ঘদিনে নৌপথের ঝক্কি আর সারা দিনের সময় অপচয়ের বদলে এখন মাত্র ছয় ঘণ্টার মধ্যে রাজধানী থেকে এ অঞ্চলে পণ্যবাহী ট্রাক চলাচল করতে পারবে।
বিজ্ঞাপন
স্থানীয়রা জানান, দক্ষিণাঞ্চলের ৩ কোটি মানুষের জীবনে উন্নয়ন ঘটাতে যাচ্ছে পদ্মা সেতু। এটি চালু হলে তা শুধু এ অঞ্চলের জনগণের জীবনমানকে এগিয়ে নেবে তা নয়, বরং এটা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পুরো বাংলাদেশের মানুষের জীবনকেই এগিয়ে নেবে। পুরো দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে পদ্মা সেতু হবে একটি নতুন মাইলফলক। ইতিমধ্যে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের মুখে হাসি ফুটেছে এই সেতুকে ঘিরে।
পটুয়াখালীর তরমুজ সারা দেশে সুস্বাদু ফল হিসেবে পরিচিত। উপকূলীয় এ এলাকার মাটি তরমুজ চাষে উপযোগী হওয়ায় ফলনও হয় বেশ। মানুষের কাছে আলাদা গুরুত্ব রয়েছে রাঙ্গাবালীর তরমুজের। গত বছর ১৩ হাজার ৭১৮ হেক্টর জমিতে তরমুজ আবাদ হলেও এবার হয়েছে ২১ হাজার ৬৮২ হেক্টর জমিতে। দিন দিন তরমুজ চাষে কৃষকরা ঝুঁকছেন। এতে তারা সচ্ছলতা ফেরাচ্ছেন। কিন্তু ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না।
কৃষকদের কাছ থেকে পাইকাররা সরাসরি তরমুজ সংগ্রহ করে রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পাঠাচ্ছেন। কিন্তু পদ্মার ফেরি জটিলতার কারণে সময় বেশি লাগছে। এতে পাইকাররা কৃষকদের তরমুজের সঠিক দাম দিচ্ছেন না। এখন পদ্মা সেতু চালু হলে যেমন কৃষকরা বেশি লাভবান হবেন, তেমনি ব্যবসায়ীদেরও মুনাফা বেশি হবে। আবার চাইলে কৃষকরা নিজেরাই তরমুজ নিয়ে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে চলে যেতে পারবেন।
তরমুজচাষি কৃষক ফোরকান সরকার বলেন, ক্ষেত থেকে তরমুজ নিয়ে যায় পাইকাররা। আমাদের বেশি দাম দেয় না। আমরাও সরাসরি বিক্রি করতে পারতাম না বলে দিয়ে দিতাম। পদ্মা সেতু হয়ে গেলে নিজেরাই গাড়ি ভাড়া করে ঢাকা শহরে তরমুজ নিয়ে চলে যাব। দামও বেশি পাব। মাঠে ফলন ফলাই আমরা সাধারণ কৃষকরা আর মাঝখানে লাভ করে মধ্যস্থতাকারী ব্যবসায়ীরা। এ খন আর অন্য কারও কাছে তরমুজ বিক্রি করব না। প্রধামনমন্ত্রীকে ধন্যবাদ আমাদের এই সুযোগ করে দেওয়ার জন্য।
পটুয়াখালী শহরের রিকশাচালক মিনহাজ পদ্মা সেতু নিয়ে আবেগাপ্লুত। তিনি বলেন, আগে ঢাকা ছিল আমাদের কাছে অনেক দূর। এক দিন লেগে যেত ঢাকা শহরে যেতে। আমার বাবা যখন ঢাকায় কাজ করতেন, তখন ইচ্ছা করলেও বাড়িতে আসতে পারতেন না। আজ পদ্মা সেতু হয়ে গেছে। এখন দিনে গিয়ে দিনেই ফিরে আসতে পারব। আগে পদ্মা সেতুর কথা মানুষের মুখে মুখে শুনতাম। এখন পদ্মা সেতু হয়ে গেছে। আমাদেরও জীবনের পরিবর্তন আসবে।
দিনমজুর ইব্রাহিম বলেন, পদ্মা সেতু হওয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্য আরও ভালোভাবে হবে। আমাদের এই এলাকার মানুষ বেশি সুযোগ-সুবিধা পাবে। বিশেষ করে নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। আগে তো আমাদের এই অঞ্চল ছিল অবহেলিত। আস্তে আস্তে সবকিছুই পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। ঢাকা শহর এখন আর আমাদের কাছে দূরে মনে হবে না। সকালবেলা ঢাকা গেলে বিকেলের মধ্যে কাজ শেষ করে বাসায় আসতে পারব।
তিনি আরও বলেন, পদ্মা সেতুর কারণে জায়গা-জমির দাম বেড়ে গেছে কয়েক গুণ। লেবুখালী ব্রিজ উদ্বোধনের পর থেকেই বরিশালের সাথে আমাদের পটুয়াখালী জেলার আর কোনো ফেরি ছিল না। এরপর পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর থেকে রাজধানীর সাথে কুয়াকাটা পর্যন্ত যেতে আমাদের আর কোনো ফেরির জন্য অপেক্ষা করতে হবে না। আমাদের উন্নয়ন মানে দেশের উন্নয়ন।
ব্যবসায়ী ইছা সিকদার বলেন, জেলার যেসব পণ্যদ্রব্য ঢাকা শহরে পাঠাতে হয়, সেগুলো এখন আর লঞ্চে যাবে না, সরাসরি ট্রাকে করে ঢাকায় চলে যাবে। পদ্মা সেতু হওয়ার কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য আরও বেশি ত্বরান্বিত হবে। আবার পদ্মার ওপারের ব্যবসায়ীরাও আমাদের জেলায় এসে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করতে পারবে। চালু হবে শিল্পকারখানা। এই উন্নয়নটুকু আমাদের জীবনের জন্য অনকে বড় কিছু।
স্কুলশিক্ষক সালমা জাহিদ জানান, ক্লাসে যখন পদ্মা সেতু নিয়ে কথা বলি, তখন গর্বে বুকটা ভরে যায়। একটি দেশের সামগ্রিক উন্নতি অনেকাংশে নির্ভর করে সেই দেশের যোগাযোগব্যবস্থার ওপর। স্বপ্নের পদ্মা সেতু বাংলাদেশর জন্য আরও একটি মাইলফলক। এই স্বপ্নের সেতু বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে দক্ষিণাঞ্চলের বিশেষ করে পটুয়াখালী জেলার মানুষ বেশি উপকৃত হবে।
ফেরি ও লঞ্চের পার্থক্য করে তিনি বলেন, যাতায়াতের দুর্ভোগ কমিয়ে পদ্মা সেতু বাংলাদেশের সড়কব্যবস্থার ইতিহাসে নতুন দিগন্তের সূচনা করবে। ধন্যবাদ জানাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে, যার সাহসিকতা ও অক্লান্ত পরিশ্রমে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু উদ্বোধনের অপেক্ষা করছে। পদ্মা সেতুর আগামীর জন্য রইল শুভকামনা।
এনএ