গুরুত্ব বাড়ছে আশুগঞ্জ নদীবন্দরের, প্রয়োজন অবকাঠামোগত উন্নয়ন
পূর্ণাঙ্গ বন্দর হিসেবে যাত্রা শুরুর ১১ বছর পার হলেও উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ নদীবন্দরে। দেশের অন্য নৌবন্দরগুলোর তুলনায় এখনও অবকাঠামোগত দিক থেকে পিছিয়ে আছে সম্ভাবনাময় বন্দরটি। অথচ গুরুত্ব ও চাহিদা বিবেচনায় আগামী অর্থবছরে বন্দরের ইজারা মূল্য বৃদ্ধির কথা ভাবছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)।
তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিআইডব্লিউটিএ প্রতি অর্থবছরে আশুগঞ্জ নদীবন্দরের জন্য যে ইজারা মূল্য নিচ্ছে, তার তুলনায় বন্দরে সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করছে না। অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলে বন্দরের ব্যবসা-বাণিজ্য যেমন আরও প্রসারিত হবে, তেমনি সরকারও লাভবান হবেন।
বিজ্ঞাপন
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১১ সালে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের পালাটানা বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালামাল পরিবহনের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু হয় আশুগঞ্জ নদীবন্দরের। অবশ্য তার আগে থেকেই আশুগঞ্জের মেঘনা নদীর ফেরিঘাট এলাকায় নোঙর করত পণ্যবাহী ছোট-বড় জাহাজ ও বাল্কহেড। এ বন্দরে পণ্য ওঠানামার কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন এক হাজারেরও বেশি শ্রমিক।
ইতোপূর্বে আশুগঞ্জ নদীবন্দর ব্যবহার করে কয়েক দফায় খাদ্যশস্যসহ বিভিন্ন মালামাল পরিবহন করেছে ভারত।
চট্টগ্রাম ও ঢাকা থেকে নৌপথে স্বল্প সময়ে এবং খুব সহজেই আশুগঞ্জ নদীবন্দর ব্যবহার করে বিভিন্ন কোম্পানি নিজেদের এজেন্টদের কাছে মালামাল সরবরাহ করতে পারে। এর ফলে দিন দিন আশুগঞ্জ নদীবন্দর দিয়ে পণ্য পরিবহন বাড়ছে। এতে করে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে এ বন্দরটি।
বর্তমানে প্রতি মাসে রড, সিমেন্ট, পাথর, সার, ধান ও গমসহ বিভিন্ন পণ্যবোঝাই ছোট-বড় শতাধিক জাহাজ ও বাল্কহেড আসে আশুগঞ্জ নদীবন্দরে। তবে জেটি সংখ্যা বৃদ্ধিসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পেলে বর্তমানের চেয়ে দ্বিগুণ জাহাজ বন্দরে আসবে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
চলতি অর্থবছরে (২০২১-২০২২) আশুগঞ্জের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ১ কোটি ১০ লাখের কিছু বেশি টাকা দিয়ে বন্দরটি ইজারা নেয়। ইজারাদার বন্দরে পণ্য নিয়ে আসা কার্গো জাহাজ ও বাল্কহেডগুলো থেকে প্রতি টন পণ্যের বিপরীতে ২৩ টাকা করে নিয়ে থাকে। এছাড়া বন্দরে অবস্থানকালীন বার্থিং ফি হিসেবে প্রতিদিন ছোট জাহাজগুলোর জন্য ৩০০ টাকা এবং বড় জাহাজগুলোর জন্য ৫০০ টাকা দিতে হয় ইজারাদারকে।
তবে পণ্য পরিবহনে আশুগঞ্জ নদীবন্দর ব্যবহারে চাহিদা বাড়লেও বন্দরের অবকাঠামোগত উন্নয়ন হচ্ছে না। বর্তমানে বন্দরে মাত্র দুটি জেটি আছে। অথচ একেকটি জাহাজ থেকে পণ্য আনলোডিংয়ে সময় লাগে ৪-৫ দিন। এ সময়টাতে জেটি খালি না পেয়ে বন্দরে নোঙর করা অন্য জাহাজের পণ্য আনলোডিং করা যায় না। এতে করে জাহাজের জটলা তৈরি হয়। এছাড়া জাহাজ বন্দরে নোঙর করার ৭ দিনের মধ্যে পণ্য আনলোড করতে না পারলে পরবর্তী দিন থেকে অতিরিক্ত টাকা দিতে হয় জাহাজ মালিককে। অবশ্য জেটি ফাঁকা না থাকলে নদীর ঘাটগুলোতেই বাল্কহেডের পণ্য আনলোডিং করা হয়।
এদিকে বন্দরের বিদ্যমান ওয়্যারহাউসটি নির্মিত হয়েছিল ভারতীয় পণ্য রাখার জন্য। ফলে এখানকার ব্যবসায়ীরা চাহিদা থাকা সত্ত্বেও এটি ব্যবহার করতে পারছেন না। এতে করে জাহাজ থেকে পণ্য আনলোডের পর ডেলিভারিতে বিলম্ব হলে পণ্য নিয়ে বিপাকে পড়তে হয় ব্যবসায়ীদের। এছাড়া বন্দরে কোনো ট্রাকইয়ার্ড নেই। ফলে পণ্য পরিবহনে ব্যবহৃত ট্রাকগুলো বন্দরের সামনের সড়কে দাঁড় করিয়ে রাখতে হয়। এতে করে সড়কে পথচারীদের চলাচলে সমস্যা হয়।
নদীবন্দরের কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, পর্যাপ্ত জেটির অভাবে পণ্য আনলোডিংয়ে অতিরিক্ত সময় লাগে। এতে করে জাহাজ মালিককে যেমন অতিরিক্ত টাকা দিতে হয়, তেমনি বন্দরে অবস্থানকালীন বার্থিং ফিও দিতে হয় ইজারাদারকে। সব মিলিয়ে আর্থিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। সেজন্য চাহিদা বিবেচনায় বন্দরে আরও অন্তত ৫টি জেটি নির্মাণ করা প্রয়োজন। এতে করে বন্দরের বাণিজ্যিক কার্যক্রম আরও প্রসারিত হবে।
আশুগঞ্জ নদীবন্দরের ব্যবসায়ী মো. নাসির মিয়া জানান, প্রতিষ্ঠার ১১ বছরেরও বেশি সময় পার হলেও আশুগঞ্জ নদীবন্দরের কাঙ্ক্ষিত অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়নি। জেটি স্বল্পতায় নির্ধারিত সময়ে জাহাজ থেকে পণ্য আনলোড করা যায় না। বন্দর থেকে পণ্য পরিবহনে ব্যবহৃত ট্রাকের জন্য একটি ট্রাকইয়ার্ড প্রয়োজন বলে জানান তিনি।
আরেক ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম জানান, বন্দরে প্রতিদিনই জাহাজ আসে। একটি জাহাজের পণ্য আনলোডিং না হওয়া পর্যন্ত অন্য জাহাজগুলোকে বন্দরেই নোঙর করে থাকতে হয়। মূলত জেটি স্বল্পতার কারণেই সবচেয়ে বেশি সমস্যা হচ্ছে। নিরবচ্ছিন্ন লোড-আনলোডিংয়ের জন্য আরও অন্তত ৫টি জেটি নির্মাণ করা প্রয়োজন। জেটি সংখ্যা বাড়লে বন্দরে বর্তমানের চেয়ে দ্বিগুণ জাহাজ আসবে বলে জানান তিনি।
আশুগঞ্জ নৌবন্দরের দায়িত্বে থাকা বিআইডব্লিউটিএর উপ-পরিচালক মো. শহীদ উল্যাহ বলেন, ‘এক সময় আশুগঞ্জ নদীবন্দরটি খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। তখন বন্দরের ইজারা মূল্যও কম ছিল। কিন্তু এখন এ বন্দর দিয়ে পণ্য পরিবহন বাড়ায় গুরুত্ব বাড়ছে। এতে করে বন্দরের ইজারা মূল্যও বাড়ছে। আগামী অর্থবছরেও ইজারা মূল্য বাড়বে।’
তিনি আরও বলেন, বন্দরে আরও জেটিসহ অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রয়োজন—এটি আমরাও বুঝতে পারছি। তবে ব্যবসায়ীরা যদি তাদের চাহিদাগুলো লিখিতভাবে জানান, তাহলে আমরা সুপারিশ করে ঊর্ধ্বতনদের কাছে পাঠাব।
এসপি