চাঁদপুরের মেঘনার চর

দেশের প্রথম ব্র্যান্ডিং জেলা ইলিশের বাড়ি চাঁদপুরে নতুন করে যোগ হলো পর্যটনের অপার সম্ভাবনা। নান্দনিক ও শৈল্পিক পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার অপার সম্ভাবনা রয়েছে চাঁদপুরের চরগুলোয়। তাই তো পদ্মা, মেঘনা ও ডাকাতিয়ার কোল ঘেঁষে চাঁদপুর শহর সাজতে যাচ্ছে পর্যটন কেন্দ্র ও অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে। এত দিন সরকারি বা বেসরকারিভাবে কোনো বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান এগিয়ে না আসায় তা স্বপ্নই থেকে ছিল। অবশেষে স্বপ্ন বাস্তবায়নে এগিয়ে এসেছে বেসরকারি উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান ‘ব্লু রিভার আইল্যান্ড রিসোর্ট অ্যান্ড ট্যুরিজম ক্লাব লিমিটেড’।

জাপান-বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানটি চাঁদপুরের মেঘনার চরে নান্দনিক ও শৈল্পিক পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার লক্ষ্যে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। প্রকল্পের জন্য ইতিমধ্যে ৬০০ একর জায়গার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এতে ব্যয় করা হবে ৬ হাজার কোটি টাকা। আর উপযোগী জায়গা হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে চাঁদপুর সদর উপজেলার কল্যাণপুর ও বিষ্ণুপুর ইউনিয়ন মৌজার দাসাদী-সংলগ্ন মেঘনা নদীর তিনটি চর।

শহর থেকে চরগুলোর দূরত্ব হচ্ছে― বড় স্টেশন মোলহেড থেকে তিন কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে। তিনটি বিচ্ছিন্ন বিশাল চর বেছে নেওয়ার কারণ চাঁদপুরকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য।

পর্যটন প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যে গত ২৭ ডিসেম্বর মেঘনার ওই চরগুলোয় প্রকল্প পরিচিতি সভা অনুষ্ঠিত হয়। দুপুরে দাসাদী-সংলগ্ন মেঘনার তীরে প্রায় ২৮০ একর জায়গা নিয়ে জেগে ওঠা ওই চরে প্রকল্প পরিচিতি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ অনুষ্ঠানে প্রকল্প প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ছাড়াও স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিকসহ অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। এ সময় প্রকল্প পরিচিতি তুলে ধরেন ব্লু রিভার আইল্যান্ড রিসোর্ট অ্যান্ড ট্যুরিজম ক্লাব লিমিটেডের পরিচালক রাজিব আহমেদ। 

চাঁদপুর মেঘনা ঘাট

যা কিছু থাকবে এই পর্যটন কেন্দ্রে
স্বাধীনতার স্মৃতি ও আধুনিক নানা সুবিধা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বিশাল এই পর্যটন প্রকল্প। এর মধ্যে থাকছে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের স্মৃতি-সংবলিত ভাস্কর্য, জাতীয় চার নেতার ভাস্কর্য, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যের জাদুঘর, পানির ওপর ভাসমান কটেজ, ৪ কিলোমিটার দীর্ঘ ক্যাবল কার, ট্রেডিশনাল কটেজ, স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট, পাঁচ তারকা হোটেল, থিম পার্ক, রিভার ক্রুজ, স্পিডবোট, হেলিকপ্টার, কনভেনশন হল, থিয়েটার, মিউজিয়াম, ইন্টারন্যাশনাল এক্সপো সেন্টার, মার্কেট, ফুড কোট, জিমনেসিয়াম, ইনডোর ও আউটডোর গেমস, ক্রিকেট অ্যারোনা, সুইমিং ক্লাব, ওয়াটার রাইড, হসপিটাল, পার্টি সেন্টার, হলি কর্নার, রিসার্চ ইনস্টিটিউট, স্টাফ রেসিডেন্সিয়াল এরিয়া, অ্যাগ্রিট্যুরিজম, গ্রিন এনার্জি, ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ প্রধান প্রধান শহরের সঙ্গে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত নিজস্ব পরিবহনব্যবস্থা এবং পর্যটন ডিপ্লোমা কোর্স স্কুল।

এ বিষয়ে ব্লু রিভার আইল্যান্ড রিসোর্ট অ্যান্ড ট্যুরিজম ক্লাব লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সাগর মাহমুদ জানান, এই পর্যটন কেন্দ্রে প্রতিদিন লক্ষাধিক লোকের ভ্রমণের ব্যবস্থা এবং ২০ হাজার পর্যটকের রাত্রিযাপনের সুবিধা থাকবে। এই পর্যটন কেন্দ্র নির্মাণ করা হলে প্রায় পাঁচ হাজার লোকের কর্মসংস্থান তৈরির পাশাপাশি বাংলাদেশের পর্যটনশিল্প বিকাশে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে। এ ছাড়া এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব পাবে।

চাঁদপুরের দুটি স্থানে ইকোনমিক জোন করার লক্ষ্যে ইতোমধ্যে ১২ হাজার একর ভূমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এখানে গড়ে উঠবে বিভিন্ন প্রকার শিল্পপ্রতিষ্ঠান। চাঁদপুরে এই পর্যটন কেন্দ্রটি স্থাপন করা হলে ইকোনমিক জোনের ব্যবসায়ীরা বিভিন্নভাবে উপকৃত হবেন। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করার জন্য তিনটি ধাপে বিভক্ত করা হয়েছে। মোট ৬০০ একর ভূমির মধ্যে প্রথম ধাপে ২৬৫ একর, দ্বিতীয় ধাপে ২১০ একর এবং তৃতীয় ও শেষ ধাপে প্রয়োজন ১২৫ একর।

চাঁদপুর তিন নদীর মোহনা বড়স্টেশন মোলহেডে ঘুরতে আসা হিমেল মাহমুদ ও ফরহাদ আলম উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে জানান, চাঁদপুরে শুধু বড়স্টেশন মোলহেড ছাড়া তেমন কোনো পর্যটন কেন্দ্র নেই। শুধু শীতের এই সময়ে দর্শনার্থীরা মেঘনার বালুচরে যেতে পারে। তবে এখন যদি চরগুলোয় নান্দনিক ও শৈল্পিক পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়, পর্যটকরা উপকৃত হবেন। এটি চাঁদপুরবাসীর দীর্ঘদিনের স্বপ্ন। আমরা চাই, যাতে খুব দ্রুত পর্যটন কেন্দ্রটি গড়ে তোলা হয়। তখন শুধু চাঁদপুর নয়, দেশের এবং বিদেশের পর্যটকরাও এখানে এসে ভিড় জমাবেন।

চাঁদপুর সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ অসিত বরণ দাশ বলেন, মেঘনার চরগুলোতে স্থায়ীভাবে পর্যটন অঞ্চল গড়ে তোলা হলে এটি হবে চাঁদপুরবাসীর বিশাল প্রাপ্তি। ৬০০ একর জমিতে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা ব্যায়ে চরগুলোতে নান্দনিক ও শৈল্পিক পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা হবে। এতে একদিকে প্রচুর কর্মসংস্থান তৈরি হবে, অন্যদিকে চাঁদপুর হবে আরও উন্নত। চাঁদপুর জেলার জন্য এটি একটি বড় প্রকল্প। পরিকল্পনা অনুযায়ী পর্যটন কেন্দ্র তৈরি হলে সারা বাংলাদেশের পর্যটকরা তখন চাঁদপুরে আসবেন।

ইলিশ চত্বর

চাঁদপুর পৌরসভার মেয়র অ্যাডভোকেট জিল্লুর রহমান জুয়েল বলেন, চাঁদপুরকে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার লক্ষ্যে জাপান-বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান ব্লু রিভার আইল্যান্ড রিসোর্ট অ্যান্ড ট্যুরিজম ক্লাব এগিয়ে এসেছে। তারা চাঁদপুরের মেঘনার বালুচরে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তুলতে আগ্রহী। আমরা চাঁদপুরকে নান্দনিক ও অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে গড়ে তোলার জন্য চাঁদপুর পৌরসভার পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করব।

এ বিষয় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ জামান বলেন, অনেক আগেই ব্লু রিভার আইল্যান্ড রিসোর্ট অ্যান্ড ট্যুরিজম ক্লাব আমাদের কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছে। তাদের ধারণা অত্যন্ত চমৎকার। তবে কবে নাগাদ চূড়ান্তভাবে কথা হবে, তা বলা যাচ্ছে না। ট্যুরিজম ক্লাবটি তারা নিজেরাই এখানে টাকা ব্যয় করতে ইচ্ছুক। তারপরও এ বিষয়ে মন্ত্রণালয় যেভাবে চাইবে, ঠিব সেভাবেই হবে।

চাঁদপুরে পর্যটন কেন্দ্র তৈরি হলে পুরো জেলার অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে। ইতিমধ্যে তারা সব স্থান পরিদর্শন করে গিয়েছেন। এখানে যেভাবে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার পরিকল্পনা করা হয়েছে, তা নির্মিত হলে দেশ-বিদেশ থেকে মানুষ এখানে ছুটে আসবে। আমরা চাঁদপুর জেলা প্রশাসন থেকে এ কাজে সর্বাত্মক সহযোগিতা করতে প্রস্তুত রয়েছি বলে জানান এই কর্মকর্তা।

শরীফুল ইসলাম/এনএ