সম্পত্তি লিখে নিয়ে মা-বাবাকে বাড়ি থেকে বের করে দিলেন ছেলে
নিজের ভবিষ্যতের কথা না ভেবে বসতবাড়িসহ ছেলের নামে সব জমিজমা রেজিস্ট্রি করে দেন বাবা। বিষয়টি তিন মেয়ের কাছে গোপনও রাখেন। শুধু ছেলের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য এমনটাই করেছেন বৃদ্ধ নবির হোসেন।
নব্বই বছর বয়সী এই বাবা ভেবেছিলেন, জীবনের পড়ন্ত বেলায় ছেলের সংসারে স্ত্রীকে সুখে-শান্তিতে থাকবেন তিনি। কিন্তু জমিজমা নিজ নামে রেজিস্ট্রি করে নেয়ার দু-মাস পার না হতেই বাড়ি ছাড়া হতে হয় বৃদ্ধ নবির ও সুফিয়া দম্পতিকে।
বিজ্ঞাপন
যে ছেলেকে বড় করতে সারা জীবন কষ্ট করেছেন কৃষক বাবা। সেই ছেলেই জমিজমা ও সম্পত্তির লোভে বৃদ্ধ বাবাকে ঘর থেকে তাড়িয়েছে। শুধু তাই নয়, বাবার সঙ্গে নিজের অসহায় মাকেও বাড়ি বের করে দেন ছেলে সাইদুল ইসলাম। এখন বৃদ্ধ নবির ও সুফিয়া দম্পতি আশ্রয়ের খোঁজে ঘুরছেন পথে পথে। থাকছেন অন্যের বাড়ি বাড়ি।
এ ঘটনাটি ঘটেছে রংপুর নগরীর সিওবাজার উত্তম বেতারপাড়ায়। অভিযোগ উঠেছে, বাড়ি-ঘর ও আবাদি জমিসহ সব সম্পত্তি নিজ নামে লিখে নিয়ে বাড়ি থেকে বৃদ্ধ বাবা-মাকে বের করে দিয়েছে ছেলে সাইদুল ইসলাম। প্রায় দুই মাস ধরে এখন মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন বৃদ্ধ দম্পতি।
ভুক্তভোগীর স্বজন ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, রংপুর নগরীর ২ নম্বর ওয়ার্ডের সিওবাজার উত্তম বেতারপাড়ায় বৃদ্ধ নবির হোসেনের বসবাস। দীর্ঘ ৫০ বছর স্থানীয় একটি মসজিদে মুয়াজ্জিন ছিলেন তিনি। বর্তমানে বয়সের ভারে অসুস্থ। মসজিদে মুয়াজ্জিনের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি নিজের জমিতে চাষাবাদও করতেন। অনেক কষ্টে আবাদি জমিসহ বাড়ি-ঘর তৈরি করছেন তিনি। শারীরিক অসুস্থতায় ভুগতে থাকা বৃদ্ধ নবির হোসেন জীবন সায়ান্হে একটু সুখের আশায় বাড়ি-ঘরসহ সমস্ত জমিজমা ছেলে সাইদুল ইসলামের নামে রেজিস্ট্রি করে দেন। এরপরই সুখের বদলে নবির হোসেনের জীবনে নেমে আসে অশান্তি। একের পর এক নির্যাতনে নবির-সুফিয়া দম্পতি হারিয়ে ফেলেন প্রতিবাদের ভাষা। শেষ পর্যন্ত তাদের হতে হয় গৃহ ছাড়া।
নবির হোসেনের অভিযোগ, ছেলের পরিবারসহ তিনি ও তার স্ত্রী সুফিয়া খাতুন একই বাড়িতে ছিলেন। সম্প্রতি ছেলের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে নিজের সব জমি-জমাসহ বসতবাড়িকে ছেলেকে রেজিস্ট্রি করে দেন। এর কিছুদিন না যেতেই ছেলে সাইদুল ইসলাম তাদের স্বামী-স্ত্রীর খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দেন। এর প্রতিবাদ করায় রমজান শুরুর কয়েকদিন আগে সাইদুল তাদের দুজনকে মারধর করে জোরপূর্বক বাড়ি থেকে বের করে দেয়।
স্থানীয় মসজিদ কমিটি ও ওয়ার্ড কাউন্সিলরসহ এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিরা বিষয়টি জানার পর বেশ কয়েকবার সালিস বৈঠকও করেন। কিন্তু সাইফুল ইসলামের খামখেয়ালিপনায় কোনো সমাধান হয়নি। এখন নিরূপায় হয়ে বৃদ্ধ নবির-সুফিয়া দম্পতি এলাকার বিভিন্ন মানুষের বাড়িতে রাত্রিযাপন করছেন। কখনো অনাহারে নয়তো অর্ধাহারে তাদের দিন কাটছে।
নবির হোসেন জানান, তিনি তার বাপদাদার সম্পত্তি সূত্রে ১০/১২ বিঘা জমি পেয়েছিলেন। নিজে স্থানীয় মসজিদে মুয়াজ্জিন ছিলেন। গ্রামের ছোট বাচ্চাদের আরবি পড়াতেন। পাশাপাশি জমিতে চাষাবাদ করতেন। আবাদি ফসল থেকে যা আয় হতো তাই দিয়ে তাদের সংসার চালাতেন।
ছেলে ভালো থাকুক, থাকুক সুখে শান্তিতে। এমন ভাবনায় ছিল তার চোখে। কিন্তু ছেলের এমন অমানবিক কাণ্ডে নির্বাক নবির হোসেন অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে বলেন, অনেক কষ্টে ছেলেকে লেখাপড়া শিখিয়েছি। শেষ বয়সে ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে সুখে শান্তিতে থাকব। কিছু হলে ছেলে সুচিকিৎসা করাবে, সংসার চালাবে। তাই নিজের কথা না ভেবে ছেলের ভবিষ্যতের কথা ভেবে এবং তার কথায় ভুলে গিয়ে তিন মেয়েদের না জানিয়ে সব জমি-জমা ছেলের নামে রেজিস্ট্রি করে দিয়েছি। দু-মাস না যেতেই ছেলের বউ ঠিক মতো খাবার দিত না। সকালের নাস্তা দুপুরে দিত, তাও আবার পান্তা ভাত। কোনদিন ২/১টা রুটি দিলেও সঙ্গে তরকারি দিত না। আবার বেলা গড়িয়ে যদি দুপুরের ভাত খেতে দিত, সেদিন রাতে আর খাবার দিত না। ছেলেকে এসব কথা জানালে উল্টো আমাদের ওপর চড়াও হয়ে গালিগালাজ করত।
অসহায় এই বৃদ্ধ বলেন, এবার রমজান শুরুর কয়েকদিন আগে গাছ থেকে সুপারি নামা আর আমার থাকার ঘরের কাজের জন্য দুটি বাঁশ কাটার ঘটনায় ছেলে আমার ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে নির্যাতন করে। তার মা সুফিয়া প্রতিবাদ করতে গেলে তাকেও লাঞ্ছিত করে। এরপর আমাদের দুজনকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। আমরা যাতে বাড়িতে ফিরে ঘরে থাকতে না পারি সেজন্য থাকার ঘরটিও ভেঙে ফেলেছে। বর্তমানে স্বজন আর এলাকার বিভিন্ন জনের বাড়িতে কোনো রকমে দিনাতিপাত করছি।
ছেলের এমন কাণ্ডে অভিযোগ নেই বৃদ্ধা মায়ের। তিনি শুধু স্বামী নবির হোসেনের মুখের দিকে তাকিয়ে হু হু করে কাঁদছেন। পিঁপড়ের ভয়ে যে ছেলেকে মাটিতে রাখেননি। কোলে পিঠে আগলে রাখা সেই ছেলেই আজ তাদের করেছেন বিতাড়িত। তাই আক্ষেপ থেকে নিজের কোনো অভিযোগ নেই জানিয়ে মা সুফিয়া বেগম বলেন, আমার ছেলের বিচার করার কেউ নেই। কতজনকে তো বলেছি, কারো কথায় তো কাজ হয়নি। মসজিদ কমিটি ও ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কাছে কয়েক দফা বিচার দেয়া হলেও বিচারে সাইদুল উপস্থিত হয়নি। বরং তার বাবাকেসহ আমাদের নানাভাবে হুমকি-ধমকি দিচ্ছে।
এ ব্যাপারে বৃদ্ধ নবির হোসেনের তিন মেয়ে আছিয়া খাতুন, নাজমা ও বুলবুলি বেগম জানান, তারা তাদের বৃদ্ধ বাবা-মাকে মারধর করে বাড়ি থেকে বের করে দেয়ার ঘটনার বিচার চান। সঙ্গে বাবার সম্পত্তি ফিরে পেতে আইনি সহযোগিতাও দাবি করেন।
ওই গ্রামের কৃষক ফজলু মিয়া ও নুরুল হক বলেন, সাইদুল তার বাবা-মাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে চরম অন্যায় করেছে। আমরা গ্রামের মানুষ তাকে অনেকবার বোঝানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। মসজিদ কমিটি ও কাউন্সিলরসহ সালিসে বসা হয়েছিল, সেখানে সাইদুল আসেনি।
এ ব্যাপারে নির্যাতনকারী ছেলে সাইদুল ইসলামের সঙ্গে কথা বলতে তার বাসায় কয়েক দফা গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি। ফোনে যোগাযোগ করেও ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে। তবে তার স্ত্রী সালমা আখতার এসব অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, আমার স্বামীর বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ এনে সমাজের কাছে হেয় করা হচ্ছে। আমার স্বামী তার বাবা-মাকে মারধর করেনি।
এদিকে রংপুর সিটি করপোরেশনের ২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আবুল কালাম আজাদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি কয়েকবার ঘটনাস্থলে গিয়েছি। এলাকার মানুষ ও ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা বলেছি। বৃদ্ধ বাবা-মাকে নির্যাতন করে বাড়ি থেকে বের করে দেয়ার ঘটনাটি সত্য। এ ব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থা নিতে অসহায় নবির-সুফিয়া দম্পতিকে পরামর্শ দিয়েছি।
ফরহাদুজ্জামান ফারুক/এমএএস