২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর উপকূলে আঘাত হানে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় সিডর। ঘূর্ণিঝড় থেকে বাঁচতে সেদিন চিলা গ্রামের আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছিল শত শত মানুষ। সেখানে ছিলেন এক দম্পতি জর্জি সরকার ও সাথী সরকার। সাথী ছিলেন অন্তঃসত্ত্বা। ভোরের আলো ফোটার মুহূর্তে সাথির কোলজুড়ে জন্ম নিল ফুটফুটে এক শিশু। এ যেন ধ্বংসলীলার ভেতরে এক নতুন জীবন।

দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের কাছে সিডর এক আতঙ্কের নাম, ধ্বংসের নাম। আর সেই ধ্বংসস্তূপে মধ্যে এক নবজাতকের জন্ম যেন বেঁচে থাকার এক আনন্দমুহূর্ত। স্থানীয় বাসিন্দা, এনজিও কর্মী ও সরকারি কর্মকর্তারা― সবার মধ্যে কৌতূহলের সৃষ্টি হয়। তাই ঘূর্ণিঝড় সিডর নামের সঙ্গে মিলিয়ে সেই শিশুর নাম রাখা হয় ‘সিডর সরকার’।

কিন্তু অর্থসংকটে চার বছর ধরে হোম অব লাভ নামের একটি বোর্ডিংয়ে (এতিমখানায়) রয়েছেন সিডর। বিনামূল্য থাকা, পুষ্টিকর খাবার, পড়াশোনা, ভালো পোশাক ও খেলাধুলার সুযোগ থাকলেও, বাবা-মা ও দাদির কাছ থেকে দূরে থাকার চাপা কষ্ট রয়েছে তার। আদরের নাতিকে কাছে না পাওয়ার বেদনায় প্রতিনিয়ত চোখের পানি ঝরে সিডরের দাদি রিভা সরকারের। একের পর এক বিপদে নিঃস্ব, কর্মহীন ও হতদরিদ্র সিডরের বাবা জার্জিস সরকার নিরুপায় হয়ে একমাত্র ছেলেকে দিয়েছেন বোর্ডিংয়ে। এ ছাড়া যে আর কোনো উপায় ছিল না তার।

ভাঙা হাতে বেকার জীবনে ক্যানসারে আক্রান্ত বাবার চিকিৎসায় সর্বস্বান্ত হয় সিডরের পরিবার। দুই বেলা ভাতই যেখানে জোটে না, সেখানে ছেলেকে লেখাপড়া করানোর স্বপ্ন তো তার কাছে বিলাসিতা। ভয়াল ঘূর্ণিঝড় সিডরের রাতে জন্ম নেওয়া সিডর নামের ছেলেটির পরিবারে ১৩ বছরেও আসেনি সচ্ছলতা। শুধু আশ্বাসের বাণী শুনে কেটে যাচ্ছে তাদের দিন।

ঘূর্ণিঝড়ের সময় জন্ম নেওয়া সিডর ছবি: প্রথম আলো

তখনকার নবজাতক সিডরকে নিয়ে দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে গুরুত্বের সঙ্গে ধারাবাহিক সংবাদ প্রকাশ হয়। তাৎক্ষণিকভাবে সামান্য সাহায্য করা হলেও বড় ধরনের আর্থিক সহায়তার আশ্বাস দেন অনেকে। প্রতিবছরের ১৫ নভেম্বর সিডর দিবস এলেই আলোচনায় আসে সিডরের কথা। কিন্তু সিডরের পরিবারের সচ্ছলতা দূরীভূতের আশ্বাসের কোনো উদ্যোগ আর আসে না। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে প্রতিবেশীরাও ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আশ্বাসের ১৩টি বছর কেটে গেলেও অর্থাভাবে শেষ পর্যন্ত পরিবার ছেড়ে বন্দিজীবন হোম অব লাভে যেতে হয় সিডরকে।

সরেজমিন কানাইগর গ্রামের কাটাখালের পাড়ে সিডরের বসতবাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, টিনের চালার ছোট একটি ঘর। নেই কোনো আসবাব। ঘরের মধ্যে রাতে ঘুমানোর জন্য কোনো খাট নেই। জালসহ সুন্দরবনে মাছ ধরার কিছু সামগ্রী পড়ে আছে ঘর ও বারান্দায়। এই ঘরের মেঝেতেই কোনো রকম নির্ঘুম রাত কাটে সিডরের বাবা জার্জিস ও তার মায়ের। ঘরের সঙ্গেই সিডরের দাদা রণজিৎ সরকারের কবর। ঘরের সামনে থাকা একচিলতে উঠানে দাঁড়িয়ে কথা হয় সিডরের দাদি রিভা সরকারের সঙ্গে।

সিডরের দাদি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার নাতিরে নিয়ে আমার মনের যে আশা ছিল, তা করতে পারছি না। আর্থিক অনটনের কারণে বোর্ডিংয়ে দিয়েছি। যারা অসহায়, তারাই তো বোর্ডিংয়ে দেয়। আমি তো দিতে চাইলাম না। কিন্তু অর্থের অভাবে বাধ্য হয়ে সিডরকে ওখানেই দিয়েছি। মাঝেমধ্যে দেখা করতে যেতাম। কিন্তু এখন আর পারছি না। ওর দাদা মারা যাওয়ার আগে বলেছিল ওকে মানুষের মতো মানুষ করতে। কিন্তু তাকে নিয়ে এত মানুষ যে আশ্বাস দিয়েছিল, আমিও অনেক বড় স্বপ্ন দেখেছিলাম ওকে নিয়ে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কী হবে জানি না।

কান্নারত সিডরের দাদি রিভা সরকার

তিনি আরও বলেন, ওর (সিডর) দাদা মারা যাওয়ার পর এখন মনে হয় সবকিছু হারাতে বসেছি। আমার অবস্থা এতই খারাপ যে আমি মানুষের বাড়িতে কাজ করে খাই। আমার ছেলেটারও হাত ভাঙা, আমার করার মতো কিছু নেই। আমি এমন একটা কাজ চাই, যেন আমি বাঁচার মতো বাঁচতে পারি। আমার নাতির ভবিষ্যৎটা যেন ভালো হয়, আপনারা সেটা করে দিয়েন, এই বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন সিডরের দাদি রিভা সরকার। বড়দিনেও সিডরকে কাছে না পেয়ে অসহায়ত্ব প্রকাশ করেন তিনি।

সিডরের প্রতিবেশী মোস্তফা খান বলেন, আমরা দেখি সাংবাদিকসহ বিভিন্ন লোক আসে সিডরের বাড়িতে। শুধু শুনি সিডরকে এই দিচ্ছে, সেই দিচ্ছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত কিছুই দেখলাম না। তারা খুব গরিব। জার্জিসের বাবার ক্যানসার চিকিৎসায় প্রায় আড়াই লাখ টাকা খরচ হয়েছে। তারপরও বাঁচাতে পারেনি। সিডরের বাবার আর্থিক অবস্থা এত খারাপ যে দোকানে বসে এক কাপ চা খেতে পারে না। অনেক সময় আমাদের চা খাওয়াতে হয়। কাজকর্ম না থাকায় জার্জিসের স্ত্রীও পরিবার ছেড়ে কর্মের সন্ধানে ঢাকায় চলে গেছেন। সিডরের বাবার কোনো কাজের ব্যবস্থা করে তার পরিবারে সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনার দাবি জানান তিনি।

আরেক প্রতিবেশী কল্পনা দাস বলেন, সিডরের দাদা আমার ফুফাতো ভাই। মারা যাওয়ার আগে আমাকে বলেছিল সিডরকে দেখে রাখিস। কিন্তু আমি দেখতে পারিনি। অভাবের তাড়নায় তাকে হোস্টেলে দিয়েছি। আমি অনেকবার অনেক সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছি। বলেছি, আপনারা যদি কিছু করতে পারেন আমার সিডরের জন্য। কেউ কিছু করতে পারল না।

সিডরের বাবা জার্জিস সরকার বলেন, ঝড়ের দিন রাতে চিলা ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রে সিডরের জন্ম হয়। সাংবাদিকরা এল, সিডরের ছবি তুলল। তারপর নিয়ে আসলাম বাড়ি। তারপর সুন্দরবনে মাছ ধরে এবং দিনমজুরের কাজ করে দিন চলত। অনেকেই আশ্বাস দিয়েছিল কিন্তু পাইনি কিছু। এর মধ্যে প্রথম আলো পত্রিকা কর্তৃপক্ষ আমাকে ৪০ হাজার টাকার মালামাল ক্রয় দিয়ে দোকান দিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু বাকি দিয়ে বাবার ক্যানসারে খরচ করে সব শেষ হয়ে গেছে।

জার্জিস বলেন, বাবার ক্যানসারের চিকিৎসা ও সুন্দরবনে ডাকাতের কবলে পড়ে আমার হাত ভাঙায় চরম দুর্দিনে পড়ি আমি। শেষ পর্যন্ত ভাতের অভাবে সিডরকে বোর্ডিংয়ে দিয়েছি। নিজ স্ত্রীও রাগ করে চলে গেছে বছরখানেক আগে। জীবনে ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য সরকারের সহযোগিতা দাবি করেন তিনি।

বাড়িতে যে একটু সবজি করে খাবেন, তারও ব্যবস্থা নেই জার্জিস সরকারের। মাত্র ৬ শতক জমি। তিন শতকে রয়েছে পুকুর, বাবার কবর, উঠোন ও ঘর মিলিয়ে বাকি জমি শেষ। বাড়ির বাইরে কর্ম ছাড়া আয়ের কোনো সুযোগ নেই তার।

সিডরের বাবাকে সিঙ্গে নিয়ে পশুর নদী পার হয়ে আমরা যাই খুলনা জেলার দাকোপ উপজেলার লাউডোব এলাকায়। সেখানে ২০০৫ সালে প্রতিষ্ঠিত বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা লাভ ইওর নেইবারের বর্ডিং হোম অব লাভে। দেখা করি সিডরের সঙ্গে। জন্মের পরের পরিবারের নানা সমস্যার কথা জানায় সিডর। তবুও সে বড় হয়ে মানুষের সেবা করার ইচ্ছে পোষণ করে। যে হোমে সে পড়াশোনা করছে, সেখানে সবার সহযোগিতায় পড়ালেখা করে ভবিষ্যতে চিকিৎসক হয়ে মানুষের সেবা করতে চায় সিডর।

হোম অব লাভে খেলাধুলা করছে সিডর

প্রাকৃতিক দুর্যোগের নামে নামকরণের সিডর নানা হতাশা কাটিয়ে চিকিৎসক হওয়ার জন্য দোয়াও চেয়েছে দেশবাসীর কাছে। প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারাও সিডরের অদম্য সাহস ও ইচ্ছাকে বাস্তবে রূপ দিতে কাজ করে যাচ্ছেন। সহপাঠীরাও খুশি সিডরের আচরণে।

সিডরের সহপাঠী ঋত্তিক পোদ্দার ও চয়ন বিশ্বাস বলেন, আমাদের এখানে ৩০ জন ভাই রয়েছে। সিডর ভাইয়ের ব্যবহার অনেক ভালো। আমাদের বিভিন্ন কাজে সহযোগিতা করেন। আমরাও তাকে আমাদের মতো সহযোগিতা করে থাকি।

লাভ ইওর নেইবারের প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর মোনালিসা বিশ্বাস ঢাকা পোস্টকে বলেন, সিডর আমাদের কাছে আসে ২০১৭ সালে। ওর জন্ম ২০০৭ সালে। ঝড়ের রাতে জন্ম হওয়ার কারণে ওর নাম রাখা হয় সিডর। ওকে যখন আমরা পাই, তখন ও চতুর্থ শ্রেণিতে পড়লেও আচার-ব্যবহার বেশ সুবিধাজনক ছিল না। অনেক ভালোবাসা ও নিয়মানুবর্তিতার মধ্য দিয়ে আমরা ওর আচরণে ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছি। সে লেখাপড়ায়ও ভালো করা শুরু করে। খেলাধুলায়ও ভালো। আমরা নিজেদের ওর অভিভাবক বা বাবা-মায়ের জায়গায় চিন্তা করি। আমরা অভিভাবক হিসেবে চেষ্টা করব ও ওর সার্বিক সহযোগিতা করার জন্য। ওর মানসিক ও শারীরিক সুস্থতার জন্য আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। ওর স্বপ্নপূরণে ওকে আমরা স্পেশাল কেয়ার দিচ্ছি। আশা করি বড় হয়ে সিডর তার এলাকার সেবা করতে পারবে।

মোংলা উপজেলার চাঁদপাই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোল্লা মো. তারিকুল ইসলাম বলেন, বিষয়টি খুবই হৃদয়বিদারক। ২০০৭ সালের সেই সিডরের সময় সাইক্লোন শেল্টারে জন্ম হয়েছিল সিডরের। অত্যন্ত দরিদ্র পরিবার তার। তার জন্মের পর থেকে আমরা বিভিন্নভাবে তাকে সহযোগিতা করেছি। কিন্তু কোনোভাবে পরিবারটি আর্থিকভাবে সচ্ছলতা ফিরে আসছে না। পরিবারটি নগদ টাকা দিলে খরচ হয়ে যায়। ফলে আমরা চেষ্টা করছি একটু স্থায়ী কিছু করে দেওয়ার জন্য।

মোংলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কমলেশ মজুমদার বলেন, আমি আসার পর বিভিন্নভাবে সিডরের খোঁজখবর নিয়েছি। সিডরের বাবাকে ইতোপূর্বে এক লাখ টাকার একটি ঘর দেওয়া হয়েছে। সিডরের পরিবারের যদি কোনো কিছু প্রয়োজন হয়, তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতায় তা দেওয়ার চেষ্টা করব।

এনএ