পেঁয়াজের বীজ চাষে কোটিপতি সাহিদা
সাহিদা বেগম ২০০৪ সালে পেঁয়াজের বীজের চাষ শুরু করেছিলেন ২০ শতাংশ জমিতে। লাভের মুখ দেখায় পরে বীজ চাষের পরিধি বাড়ান। আসে আরও ভালো ফলন। এ বীজ বিক্রি করে কোটি টাকার মালিক হয়েছেন সাহিদা। পাশাপাশি পেয়েছেন দেশের সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পুরস্কার। বিভিন্ন বিভাগ তাকে দিয়েছে সম্মাননা।
প্রথম প্রথম সাহিদা বেগম বাড়ি থেকেই পেঁয়াজের বীজ বিক্রি শুরু করেন। পরে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পরামর্শে একটি লাইসেন্স করেন। বর্তমানে সাহিদা বেগম পেঁয়াজ বীজ ‘খান বীজ’-এর মোড়কে ফরিদপুর জেলার বিভিন্ন উপজেলা ছাড়াও পাবনা, রাজবাড়ী, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, নওগাঁ ও সিরাজগঞ্জসহ সারাদেশে যায়।
বিজ্ঞাপন
ফরিদপুর সদরের গোবিন্দপুর গ্রামের নারী কৃষক সাহিদা এলাকায় সফল কৃষক হিসেবে পরিচিত। তার দেখাদেখি এলাকার অনেক শিক্ষিত বেকার তরুণ চাকরির পেছনে না ঘুরে এখন কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন।
সাহিদা স্বামী বক্তার হোসেন একজন ব্যাংকার। তাদের দুই মেয়ে। বড় মেয়ে মেরিনা আক্তার (২৯) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ পাস করেছেন কয়েক বছর আগে। তার বিয়ে হয়েছে ঢাকায়। ছোট মেয়ে মার্জিয়া আক্তার (১৬) শহরের সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয় থেকে এ বছর এসএসসি পরীক্ষা দেবে।
সরেজমিনে জমিতে গেলে দেখা হয় সাহিদা বেগমের স্বামী বক্তার হোসেনের (৫০) সঙ্গে। তিনি রাষ্ট্রায়ত্ত একটি ব্যাংকে চাকরি করেন। পাশাপাশি স্ত্রীকে কৃষিকাজে সহায়তা করেন। বক্তার হোসেনের কাছে স্ত্রী সাহিদার সাফল্যের কথা জানতে চাইলে তিনি তাকে নিয়ে আসা কথা বলে বাড়িতে যান।
কিছুক্ষণ পর স্বামীর মোটরসাইকেলের পেছনে চড়ে ক্ষেতে চলে আসেন সাহিদা বেগম। ঘুরে ঘুরে দেখান নিজের হাতে গড়ে তোলা ৩০ একর জমি, যে জমিতে তিনি পেঁয়াজের বীজ বুনেছেন। জানালেন নিজের ১৮ বছরের সহনশীলতা, দূরদর্শিতা দিয়ে শুধু পেঁয়াজের বীজ চাষ করেই কোটি টাকা আয়ের গল্প।
কৃষক পরিবারের সন্তান বক্তার হোসেনের সঙ্গে ১৯৮৭ সালে বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি এসেই গৃহস্থালির কাজে হাতেখড়ি সাহিদার। বিয়ের পর কৃষক পরিবারের কর্মকাণ্ড এবং বিশেষ করে শাশুড়ির আগ্রহ দেখে একসময় কৃষিকাজের প্রতি ভালোবাসা ও অনুরাগ জন্মায় তার। ইরি ধান চাষের মধ্যে দিয়ে কৃষিকাজে তার হাতেখড়ি। বর্তমানে পেঁয়াজের বীজ চাষ করেন।
সাহিদা বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের এলাকায় ধান, পাট, গম, ছোলার চাষাবাদ হতো। পেঁয়াজের বীজ যে এখানে চাষ করা সম্ভব, তা কল্পনাও করতে পারিনি। ২০০৪ সালে মাথায় আসে পেঁয়াজের বীজ চাষের কথা। ঝুঁকি নিয়ে ২০ শতাংশ জমিতে পেঁয়াজের বীজ চাষ করি। প্রথম বছর ২০ শতাংশ জমিতে দুই মণ বীজ পাই। তা বিক্রি করি ৮০ হাজার টাকায়। তারপর থেকে উৎপাদন বাড়াতে থাকি।
২০১৯ সালে ২৪ একর জমিতে পেঁয়াজ বীজ চাষ করে পান ১৫০ মণ বীজ। ২০২০ সালে ৩৫ একর জমিতে চাষ করে পান ২০০ মণ। প্রতি মণ বিক্রি হয়েছে ৭০ হাজার থেকে লাখ টাকায়। চলতি বছর সাহিদা পেঁয়াজ-বীজের চাষ করেছেন ৩০ একর জমিতে। তবে বিরূপ আবহাওয়ার কারণে পাঁচ একর জমিতে পানি জমে থাকায় বীজের চাষ করা সম্ভব হয়নি। সাহিদার স্বামী বক্তার পৈতৃক সূত্রে চার একর জমির মালিক। বাকি জমি এলাকাবাসীর কাছ থেকে ইজারা নিয়ে তিনি চাষ করেছেন।
সাহিদা বেগম আরও জানান, পেঁয়াজের বীজ পেতে ছয় মাস জমিতে কাজ করতে হয়। নভেম্বর থেকে রোপণ শুরু এবং খেত থেকে বীজ শুকিয়ে প্রস্তুত করতে এপ্রিল-মে মাস পর্যন্ত সময় লাগে। আর বিক্রি করতে করতে সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবর মাস চলে যায়। গত বছর পেঁয়াজের বীজ বিক্রি করেছেন চার কোটি টাকার। উৎপাদন খরচ বাদ দিলে সাহিদার আয় হয়েছে প্রায় তিন কোটি টাকা।
সরেজমিনে বীজ ক্ষেতে দেখা যায়, ২০ থেকে ২৫ জন নারী ও দুজন পুরুষ শ্রমিক কাজ করছেন ক্ষেতে। নারী শ্রমিকরা পেঁয়াজের বীজের ফুল ছিঁড়ে ছিঁড়ে বড় গামলায় রাখছেন। পুরুষ দুই শ্রমিক সেগুলো বস্তায় করে বাড়িতে নিয়ে ঢালছেন। বাড়িতে আবার আরেক দল শ্রমিক সেগুলো ঝাড়াই-মাড়াইয়ের কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন। আর এসব কাজ তদারক করছেন সাহিদা বেগম নিজে।
স্বামী বক্তার হোসেন নিজের কর্মস্থলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত স্ত্রীর সঙ্গে ছায়ার মতো লেগে থেকে এসব কাজে স্ত্রীকে সহায়তা করেন। এদিকে সংসার, কৃষিকাজ সব সমানতালে সামাল দেন সাহিদা।
জানতে চাইলে তিনি বলেন, তিনি ভোর ৫টায় ঘুম থেকে ওঠেন। পরিবারের সদস্যসহ কৃষিশ্রমিকদের জন্য নিজেই রান্না করেন। সকালে খাবারটুকু খেয়ে চলে যান মাঠে। জমির কাজ তদারক করেন। মাঠে কাজের চাপ বেশি থাকলে শ্রমিকদের সঙ্গে খেয়ে নেন দুপুরের খাবার।
সাহিদা বেগমের ক্ষেতে পেঁয়াজের বীজের ফুল ছেঁড়ার কাজ করেন রাহু বেগম (৬০)। তার বাড়ি ফরিদপুর সদরের গোবিন্দপুর গ্রামে। তিনি বলেন, আমার বয়স হয়েছে। অন্য কাজ তেমন করতে পারি না। এখানে এসে সারা দিন পেঁয়াজের বীজের ফুল ছিঁড়ি। যতগুলো পেঁয়াজের ফুল ছিঁড়ে দিতে পারি, সেই পেঁয়াজগুলো আমি নিয়ে যেতে পারি। এতে প্রতিদিন আমার দেড় থেকে দুই মণ পেঁয়াজ হয়, যা ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা করে বিক্রি করা যায়।
গোবিন্দপুর গ্রামের বাসিন্দা আরেক শ্রমিক নুরী বেগম (৫০) বলেন, একজন পুরুষ সারা দিন মাঠে কাজ করলে ৬০০ টাকা পায়। সেখানে আমাদের শ্রমমূল্য আরও কম। সাহিদা আপার পেঁয়াজের ফুল তুলে দিলে সব পেঁয়াজ দিয়ে দেন। এতে আমাদের সারা দিনে পুরুষের চেয়েও বেশি টাকা আয় হয়। এ জন্য সাহিদার আপার ক্ষেতে আমরা কাজ করি।
স্বামী বক্তার হোসেন বলেন, কৃষিকাজে যে এত মর্যাদা, তা আগে বুঝিনি। আমার স্ত্রী ক্ষেত করার পর যখন দেশের শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও সরকারের বিভিন্ন পুরস্কার পেতে শুরু করলেন, তখন তার পরিচয়ে আমিও মর্যাদা পেতে শুরু করলাম।
তিনি আরও বলেন, আমার স্ত্রীর এই পেঁয়াজবীজের ক্ষেত দেখতে কৃষিসচিব, সর্বশেষ গত ৭ এপ্রিল কৃষিমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাকও এসেছিলেন। স্বামী হিসেবে এটা আমাকে গর্বিত করে। পাশাপাশি সামাজিক মর্যাদা ও আর্থিকভাবেও আমরা অনেক স্বাবলম্বী হয়েছি।
সাহিদা বেগম বলেন, আমার এখানে আমি কিছু মানুষের বিশেষ করে কয়েকজন নারীর কাজের সুযোগ করে দিয়ে তাদের স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ করে দিতে পেরেছি এটা আমার জন্য অনেক ভালো লাগার। পাশাপাশি আমার দেখাদেখি পাশের অনেকেই পেঁয়াজ বীজ চাষে আগ্রহ দেখাচ্ছে, সেটাকেও আমি উৎসাহিত করছি।
তিনি আরও বলেন, আমার এখানে অল্প কিছু জমিতে পরীক্ষামূলকভাবে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের বীজ চাষ করেছি। এটার সফলতা পেলে দেশের পেঁয়াজের জোগানে একটা ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। সর্বোপরি আমার জায়গা থেকে দেশকে পেঁয়াজ চাষে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে কাজ করে যাচ্ছি।
অম্বিকাপুর ইউনিয়ন পরিষদের ইউপি চেয়ারম্যান আবু সাঈদ চৌধুরী বলেন, বর্তমান সরকার উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে গুরুত্ব দিচ্ছে। সাহিদা বেগম নিজে স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি আরও অনেক মানুষকে স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছেন। ওনার ক্ষেত দেখতে মন্ত্রী, সচিবরা আসছেন, এটা আমাদের ইউনিয়নবাসীর জন্য গর্বের ব্যাপার।
ফরিদপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. হযরত আলী বলেন, পেঁয়াজের বীজ চাষ করে সাহিদা বেগম বিশাল সাফল্য অর্জন করেছেন। পেঁয়াজের বীজ মাঠে লাগানো থেকে শুরু করে গুদামজাতকরণ পর্যন্ত তিনি নিজে তদারক করার কারণে তার বীজের সুনাম দেশব্যাপী। তিনি আরও বলেন, আমি নিজে সাহিদার ক্ষেতের বীজ ভোলা, পিরোজপুর, শরীয়তপুর, মৌলভীবাজার সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় পাঠিয়েছি। সেসব জায়গা থেকে ভালো সাড়া পাওয়া গেছে।
এনএ