ক্লাসে ছিল লাজুক ও শান্তশিষ্ট, লেখাপড়ায় ছিল বেশ মনোযোগী। প্রাথমিক স্কুলে ক্লাসের ফাঁকে অন্য সবাই যখন খেলাধুলা আর হইহুল্লোড়ে মেতে উঠত, তখন সে বেশ মনোযোগসহকারে ক্লাসে একা বসে পড়াশোনায় মগ্ন থাকত। পড়াশোনায় বেশ ভালো ও শান্তশিষ্ট স্বভাবের হাওয়ায় শিক্ষকরা তাকে অনেক আদর করতেন। ছোটবেলা থেকে নম্র ও ভদ্র স্বভাবের হওয়ায় পাড়া-প্রতিবেশী সবাই তাকে খুব স্নেহ করতেন এবং খোকা বলে ডাকতেন। কিন্তু কে জানত, লাজুক সেই খোকা হয়ে উঠবেন দেশের আলোচিত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট!

মো. সারোয়ার আলম ১৯৭৮ সালে ২৮ ডিসেম্বর কিশোরগঞ্জ জেলার পাকুন্দিয়া পৌর সদরের বড়বাড়িরতে জন্মগ্রহণ করেন।
ব্যবসায়ী বোরহান উদ্দিন ও গৃহিণী আমেনা খাতুনের একমাত্র পুত্রসন্তান সারোয়ার আলম। ছয় ভাই-বোনের মধ্যে সবার বড় তিনি।

সারওয়ার আলম ২৭তম বিসিএসে ক্যাডার সার্ভিসে যোগদান করেন। এর আগে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাণিবিদ্যা বিভাগে পড়াশোনা শেষ করেন। ছয় ভাই বোনের মধ্যে সবার বড় সারওয়ার।

সৎ ও মেধাবী কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত পাওয়া সারওয়ার আলম র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নে (র‌্যাব) যোগদানের পর থেকে সব সময় আলোচিত ছিলেন। কর্মদক্ষতা আর নিষ্ঠার পরিচয় দিয়ে গেছেন বারংবার। ব্যক্তিস্বার্থ নয়, বরং তিনি প্রাধান্য দিয়েছেন দেশ ও জনগণের স্বার্থকে। স্বার্থান্বেষী মহল তার কাজে অসন্তুষ্ট থাকলেও জনগণ তাকে অফুরান ভালোবাসা দিয়ে বরণ করে নিয়েছে।

তার উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে বিশেষ করে ভেজাল খাদ্য, নকল প্রসাধনী ছাড়াও অবৈধ হাসপাতাল পরিচালনা, মাদকবিরোধী অভিযান এবং আলোচিত ক্যাসিনো অভিযান অন্যতম। ২০১৯ সালে ফকিরাপুলে ক্যাসিনোতে ও যুবলীগ নেতা জি কে শামীমের অফিসে অভিযান ছিল সবচেয়ে আলোচিত। এসব ক্ষেত্রে সামনের সারিতে থেকে অভিযান পরিচালনা করেছেন তিনি। এ ছাড়া ৮ মার্চ দেশে করোনার সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে কোয়ারেন্টিন ও সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত, নকল মাস্ক-গ্লাভসের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেছেন র‌্যাবের এই সাবেক চৌকস কর্মকর্তা।

সারোয়ার আলম

এ ছাড়া ফার্মগেটে পদচারী-সেতু দিয়ে চলাচল না করে সড়ক পারাপারের ঘটনায় নামমাত্র জরিমানা করে যাত্রীসাধারণকে সচেতন করেন তিনি। কিশোর গ্যাং আটকে অভিযান, কুকুর ও পশুর মেয়াদোত্তীর্ণ ভ্যাকসিন উদ্ধার, নামীদামি হাসপাতালে অভিযান, হজের টিকিট জালিয়াতির বিরুদ্ধে অভিযান, পুরান ঢাকার কেমিকেল অভিযান ও জড়িতদের জেল-জরিমানাসহ অসংখ্য আলোচিত অভিযানে অংশ নিয়ে দেশজুড়ে একনামে পরিচিত হয়ে ওঠেন অপরাধী চক্রের পিলে কাঁপানো সারওয়ার আলম। সর্বশেষ পুরান ঢাকায় হাজী সেলিমের বাড়িতে অভিযান ও ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে তিনি আরও আলোচনায় আসেন।

সারোয়ার আলম বর্তমানে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে সিনিয়র সহকারী সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

১৯৮৩ সালে তার শিক্ষাজীবন শুরু হয় বাড়ির পাশের ইসমাইল মেমোরিয়াল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে। ১৯৯৩ সালে পাকুন্দিয়া পাইলট উচ্চবিদ্যালয় (বর্তমান পাকুন্দিয়া সরকারি উচ্চবিদ্যালয়) থেকে এসএসসি পরীক্ষায় প্রথম বিভাগ পেয়ে ভর্তি হয় কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল সরকারি কলেজে।

১৯৯৫ সালে কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় প্রথম বিভাগ অর্জন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন প্রাণিবিদ্যা বিভাগে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ থেকে ২০০৫ সালে প্রথম শ্রেণিতে স্নাতকোত্তর পাস করেন তিনি। সারওয়ার আলম ২০০৮ সালে ২৭তম বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়ে যোগ দেন প্রশাসনে।

বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে নিয়মিত পড়াশোনা করে ভালো ফল করার পাশাপাশি করেছেন টিউশনি। তিনি অস্ট্রেলিয়ার সিডনি থেকে ইনস্টিটিউট অব পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে ডিপ্লোমা ডিগ্রিও অর্জন করেছেন।

সারওয়ারের সহপাঠী মো. আবু নোমান ঢাকা পোস্টকে জানান, সারওয়ার আলম খোকা আমার ক্লাসমেট ছিল। ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত আমরা একসঙ্গে লেখাপড়া করেছি। সে অনেক ভালো ছাত্র ছিল এবং বন্ধুবৎসল। খুবই বিনয়ী। স্যারদের প্রতিও শ্রদ্ধাশীল ও বিনয়ী ছিল।

তার চাচাতো ভাই মো. আল আমিন বলেন, আমার চাচতো ভাই মো. সারওয়ার আলম খোকা। সে ছোটবেলা থেকেই লেখাপড়ার প্রতি অত্যন্ত মনোযোগী ছিল। তার ব্যবহার এমন কোমল ছিল যে আমি কোনো দিন দেখিনি কারও সঙ্গে ঝগড়া করতে। সে নিয়মিত স্কুলে যেত এবং পড়ালেখা করত। গভীর রাতে সজাগ হয়ে শুনতাম সারওয়ার আলম খোকার পড়া।

আল আমিন আরও বলেন, সে যখন গুরুদয়াল কলেজে পড়ত, তখন মাস্টার বাড়ির একটা মেসে সে থাকত। সেখানেও সে ভালো লেখাপড়া করত এবং আমি সেখানে যেতাম ও দেখাশোনা করতাম। ওইখান থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করার পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগে ভর্তি হয়। সেখানে ফজলুল হক হলে সে থাকত। আমি ঢাকায় কোনো কাজে গেলে ওর রুমে থাকতাম। আমি শুয়ে থেকে দেখতাম, সারা রাত সে পড়ত। তখন থেকেই তার লক্ষ্য ছিল একজন আদর্শ মানুষ হবে এবং দেশের সেবা করবে। ছোটবেলায় তার যেমন মনোভিত্তি ছিল, এখনো দেখছি তার মনোভিত্তি সে রকম। আমি তার সাফল্য কামনা করি।

সারোয়ার আলম

পাকুন্দিয়া সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মো. হাবিবুল্লাহ তমিজ বলেন, সারওয়ার আলম খোকা আমার ছাত্র ছিল। আমি যখন পড়াতাম, তখন সে ক্লাস সেভেনে ছিল। তখন শিক্ষকদের ধর্মঘট চলছিল। তার উৎসাহে তাকে ও তার কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে আমার রুমের মধ্যে দরজা লাগিয়ে পড়াতাম। একদিন আমি ইউএনওর অফিসে গিয়ে দেখি খোকা বসে আছে। খোকা এসে আমাকে পা ছুঁয়ে সালাম করল। ইউএনও বিষয়টা দেখল, এত অভিডিয়েন্ট ছেলে, এত বড় চাকরি করার পরও একজন স্যারকে সে সালাম করছে, এ জন্য সে অনেক ধন্যবাদ পেল ইউএনওর কাছ থেকে। আমি সব সময় তার জন্য দোয়া করি। আল্লাহ তাকে আরও বড় মানুষ করুক।

১৯৮৩ সালে সারওয়ারের শিক্ষাজীবন শুরুর দিককার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইসমাইল মেমোরিয়াল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সাবেক সহকারী শিক্ষক রেনু মাস্টার বলেন, সারওয়ার আলম খুব ভালো ছাত্র ছিল। মেধা খুব ভালো ছিল। সবার সঙ্গে মিলেমিশে চলত। গ্রামের বিভিন্ন সমস্যা সে দূরীভূত করেছে। অনেকে আমাকে বলে যে সারওয়ার কি আপনার ছাত্র? আমি বলি জি, হ্যাঁ। এ বিষয়টাই আমি খুব গর্ববোধ করি।

সারওয়ার আলমের বাবা মো. বোরহান উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে জানান, আমার ছেলে সারওয়ার আলম ছোটবেলা থেকেই বেশ নম্র ভদ্র ছিল। আল্লাহ রহমতে লেখাপড়ায় ভালো ছিল। বর্তমানে তার চেষ্টায় এবং আল্লাহ অশেষ রহমতে সে এ পর্যন্ত এগিয়ে এসেছে। এ জন্য আমি তার পিতা হিসেবে গর্বিত।

মো. সারওয়ার আলম ২০০৯ সালে চট্টগ্রামের মেয়ে সানজিদা শারমিন লিন্ডার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের চারটি মেয়ে রয়েছে। যাদের নাম মাহরিন সামারা, নাজিফা সাফরিন, তানহা ও মানহা।

এনএ