‘সংসারের হাল ধরতে সাত মাস আগে দালাল মাহমুদুল হাসান মীরের মাধ্যমে কিরগিজস্তানে আসি। চুক্তি অনুযায়ী থাকা-খাওয়ার পাশাপাশি সেখানে গিয়ে ভালো কাজ দেওয়ার প্রলোভন দেয়। ধারদেনা করে সেখানে গিয়ে কাজ তো দূরের কথা, খাওয়া পর্যন্ত পাইনি। ঘাস কাটা, ইট ভাঙাসহ কঠিন কঠিন কাজ করিয়েছে আমাদের দিয়ে। কাজের বিনিময়ে বেতন চাইলে নির্যাতন করত। পিঠে পড়ত চাবুকের বাড়ি! বুকে লাথি মেরে ফেলে দিত। এই নির্যাতন থেকে বেঁচে ফেরার জন্য আমরা ওয়াসিস নামে একটি আন্তর্জাতিক সংগঠনে আশ্রয় নিয়েছি। এখানেও খাওয়ার কষ্ট। আমরা বাঁচতে চাই। আমাদের দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যান।’

রোববার (৮ মে) প্রেসক্লাব যশোরে মানবাধিকার সংগঠন রাইটস যশোরের আয়োজনে সংবাদ সম্মেলনে এক ভিডিও বার্তায় এমন আকুতি জানিয়েছেন কিরগিজস্তানে শ্রম পাচারের শিকার কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার আসাদ্জ্জুামান (৩৪)।

পাচারের শিকার আরেক যুবক কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার ওলিউল্লাহ (৩৩) বলেন, ২৫ দিন ভাত খাইনি। ভালো কাজের প্রলোভন দেখিয়ে অনেক কঠিক কাজ করাচ্ছে। সব সহ্য করেও কঠিন কাজ করে যাচ্ছি। তারপরও কাজ করিয়ে বেতন দেয়নি। বরং নির্যাতন করেছে। আমরা আর পারতাছি না সহ্য করতে। আপনারা যেভাবে পারেন আমাদের দেশে নেওয়ার ব্যবস্থা করেন।

জানা যায়, পরিবারে আর্থিক সচ্ছলতা আনতে শ্রমিকের কাজ নিয়ে আসাদুজ্জামান ও ওলিউল্লাহ কিরগিজস্থান যান। বাংলাদেশের মাহমুদুল হাসান মীর নামে এক দালাল রিক্রুটিং এজেন্সি মেসার্স মক্কা মদিনা ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল ও মেসার্স আল জাবীন এস্টাবলিশমেন্ট লিমিটেডের মাধ্যমে তাদের সেখানে পাঠায় দালাল। সেখানে গিয়ে দেখেন তারাসহ বাংলাদেশের ৬ জেলার ১৪ জন শ্রম পাচারের শিকার হয়েছেন। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে পালিয়ে ইতিমধ্যে ৫ জন বন্দিদশা থেকে পালিয়ে কিরগিজস্তানের ওয়াসিস নামে একটি আন্তর্জাতিক সংগঠনে আশ্রয় নিয়েছেন।

পরে তারা মানবাধিকার সংগঠন রাইটসের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ভিকটিম ও স্বজনদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে তাদের উদ্ধারে তৎপরতা শুরু করেছে মানবাধিকার সংগঠন রাইটস যশোর। তাদের দেশে ফিরিয়ে আনতে সরকারি সহযোগিতা চেয়ে রোববার এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে সংগঠনটি।

মানব পাচারের শিকার আসাদুজ্জামান ও ওলিউল্লাহ ছাড়াও বাকিরা হলেন কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার আলমগীর হোসেন (৩৩), দেলোয়ার হোসেন (২৪), আবু মুসা (২৪), জাহাঙ্গীর আলম (৪৫) দেবীদ্বার উপজেলার লিমন (২২), চান্দিনা উপজেলার শরিফুল ইসলাম (৩৪), নরসিংদীর শামসুল ইসলাম (৩৪), কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর উপজেলার সজল মিয়া (২৭), নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার আমির হামজা (৩৪), চুয়াডাঙ্গার বিপুল হোসেন (২৪) ও নুরুজ্জামান (২৮)।

সংবাদ সম্মেলনে রাইটস যশোরের নির্বাহী পরিচালক বিনয় কৃষ্ণ মল্লিক বলেন, মানব পাচারের শিকার মানুষগুলো উদ্ধারে আমাদের সহযোগিতা চেয়েছে। ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর পক্ষ থেকেও আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। আমরা তৎপরতা শুরু করেছি। এ জন্য সরকারের উচ্চপর্যায়ের সহযোগিতা দরকার। ইতোমধ্যে দালালের বিরুদ্ধে একাধিক জেলায় মামলা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, সাত মাস আগে মাহমুদুল হাসান মীর নামক একজন দালাল চুয়াডাঙ্গা, নরসিংদী, কিশোরগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ ও কুমিল্লার ১৩ জনকে কিরগিজস্তানে গার্মেন্টসে কাজ দেওয়ার প্রস্তাব দেন। এ জন্য প্রত্যেকের কাছ থেকে প্রায় তিন লাখ টাকা করে নেন। প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় কিরগিজস্তানে যাওয়ার পর বেতন হবে ৬০০ ইউএস ডলার এবং কাজের সময় হবে ৮ ঘণ্টা। কিন্তু ওই ১৩ জনকে কিরগিজস্তানে পাঠানোর পর তারা সঠিক কাজ ও মজুরি পাননি।

তাদের একটি ছোট কাপড়ের কারখানায় কাজ দেওয়া হয়। যেখানে তাদের কোনো বেতন দেওয়া হচ্ছে না। তাদের বলা হয়েছে, মাহমুদুল হাসান মীর তাদের কারখানার মালিকের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। এ জন্য বেতন চাইলে বা বেতন না পেয়ে কাজ করতে রাজি না হলে তাদের ওপর চালানো হচ্ছে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। ইতিমধ্যে ৫ জন ওই বন্দিদশা থেকে পালিয়ে কিরগিজস্তানে ওয়াসিস নামে একটি আন্তর্জাতিক সংগঠনে আশ্রয় নিয়েছেন।

বিনয় কৃষ্ণ মল্লিক বলেন, ইতিমধ্যে একজন ভুক্তভোগী কিছুদিন আগে বাংলাদেশে ফেরত এসেছে। এ ছাড়া সাত ভুক্তভোগী পাচারকারী চক্রের হাতে এখনো বন্দি আছে। এ অবস্থায় বন্দি ও ওয়াসিসের আশ্রয়ে থাকা ১৩ বাংলাদেশি যুবককে দ্রুত উদ্ধার করে দেশে ফেরত আনার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয় সংবাদ সম্মেলনে।

জাহিদ হাসান/এনএ