টিকিট নিয়ে লুকোচুরি, ঈদ-পরবর্তী যাত্রায়ও ভোগান্তি
রংপুরে ঈদ শেষে ঢাকায় ফেরা যাত্রীরা টিকিট নিয়ে ভোগান্তিতে পড়েছেন। সহজে কোথাও মিলছে না বাসের টিকিট। কাউন্টারগুলো থেকে টিকিট নেই জানিয়ে দেওয়া হলেও বাইরে চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে টিকিট নামের সোনার হরিণ। কোনো কোনো বাস কাউন্টারে ৫ মে থেকে ৯ মের টিকিট দেওয়া শেষ হয়েছে উল্লেখ করে সাঁটানো হয়েছে নোটিশ।
তবে যাত্রীদের অভিযোগ, কালোবাজারিদের হাতে চলে গেছে ঈদপরবর্তী যাত্রার টিকিট। এ কারণে চলছে টিকিটের জন্য হাহাকার। কাঙ্ক্ষিত টিকিট পেতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা আর ধরনা দিতে হচ্ছে। আবার অনেকে কাউন্টার থেকে টিকিট নেই বলে যাত্রীদের ফিরিয়ে দিলেও গোপনে বেশি দামে টিকিট বিক্রি করছেন। কালোবাজারিদের হাতেও বাড়তি দাম ধরিয়ে দিলেই পাওয়া যাচ্ছে টিকিট।
বিজ্ঞাপন
ঈদ-পরবর্তী যাত্রার টিকিট নিয়ে কারসাজির এ চিত্র রংপুর নগরীর কামারপাড়া ঢাকা কোচ স্ট্যান্ডের। একই অবস্থা রংপুর রেলওয়ে স্টেশনেও। বাস ও ট্রেনের মতো বিমানের টিকিটও সহসাই মিলছে না। অনলাইনেও পাওয়া যাচ্ছে না সঠিক তথ্য। এতে করে চরম বিপাকে পড়েছে ঢাকাগামী হাজার হাজার কর্মজীবী মানুষ।
সরেজমিনে দেখা গেছে, কামারপাড়া ঢাকা কোচ স্ট্যান্ডের বিভিন্ন কাউন্টারে টিকিট না পাওয়ায় যাত্রীদের মধ্যে হতাশা বিরাজ করছে। ঈদ উদযাপন শেষে নির্দিষ্ট সময়ে কর্মস্থলে ফেরা নিয়ে তাদের মধ্যে রয়েছে সংশয়। সারি সারি বাস থাকলেও ঈদের আগেই আগ্রিম টিকিট হওয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে দাবি করছেন পরিবহন শ্রমিকরা। আবার কোনো কোনো কাউন্টার থেকে টিকিট মিললেও বাসের একদম পেছনের সিটই ভরসা। তবে যাত্রীদের অসহায়ত্বের সুযোগ বুঝে অনেকেই দ্বিগুণ দামে কাউন্টারের বাহিরে সিন্ডিকেট করে টিকিট বিক্রি করছেন।
তবে কাউন্টারগুলো থেকে বেশি দামে টিকিট বিক্রির অভিযোগ অস্বীকার করছেন দায়িত্বে থাকা পরিবহন সংশ্লিষ্টরা। তাদের দাবি- ঈদের পর ঢাকায় ফেরা যাত্রীদের সুবিধার্থে ঈদের তিন-চার দিন আগ থেকে অনেকেই টিকিট বিক্রি শুরু করেন। আর ঈদের দ্বিতীয় দিন থেকে টানা এক সপ্তাহের (১০ মে পর্যন্ত) টিকিট আগাম বিক্রি হওয়ায় এ দুর্ভোগ সৃষ্টি হয়েছে।
কামারপাড়া কোচ স্ট্যান্ডের শ্যামলী এনআর ট্রাভেলস কাউন্টারে ‘ঈদের টিকিট দেয়া শেষ’ উল্লেখ করে একটি নোটিশ সাঁটানো রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘ঈদের টিকিট দেয়া শেষ- ৫, ৬, ৭, ৮ ও ৯ তারিখ পর্যন্ত টিকিট নাই, অযথা সময় নষ্ট করিয়েন না।’ অথচ ওই কাউন্টারের বাইরে কিছু কলারবয়কে বাড়তি দামে টিকিট বিক্রি করতে দেখা যায়।
কাউন্টার মাস্টার কামরুল ইসলাম বলেন, ঈদের চার দিন আগেই আমাদের নির্ধারিত টিকিট বিক্রি শেষ করেছি। এখন আমাদের হাতে কোনো টিকিট নেই। বাইরে যারা টিকিট বিক্রি করছেন, তারা হয়তো অন্য কোনো যাত্রীর ফেরত দেওয়া টিকিট বিক্রি করছেন। এটার সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। কেউ তাদের কাছ থেকে টিকিট নিতে চাইলে নিতে পারবে।
বেশি দামে টিকিট বিক্রির বিষয়টি অস্বীকার করেছেন অনেকেই। এ নিয়ে আপত্তিও জানান নাবিল পরিবহনের কাউন্টার মাস্টার শাকিল আহমেদ। তিনি বলেন, আগামী ৭ মে পর্যন্ত কোনো টিকিট নাই। যাত্রীরা তো টিকিট চাইছে, কিন্তু সবাইকে তো টিকিট দেওয়া সম্ভব না। এত টিকিট আমরা পাব কোথায়। ঈদের আগেই তো টিকিট শেষ হয়েছে।
যারা এখন এসে টিকিট পাচ্ছেন না, তারাই অভিযোগ করছেন দাবি করে শাকিল আহমেদ বলেন, আমরা বেশি দামে টিকিট বিক্রি করি না। নির্ধারিত ভাড়ার বাইরে বেশি টাকা নেওয়ার সুযোগ নেই। তাছাড়া আমাদের তো হাতে এখন টিকিটও নেই। অন্য কাউন্টারগুলোতে কি হচ্ছে, সেটা আমরা জানি না।
এদিকে আগমনী কাউন্টারের সামনে কথা হয় আমিনুল ইসলাম নামে এক শিক্ষকের সঙ্গে। তিনি এসেছেন শুক্রবার (৬ মে) রাতের টিকিট নিতে। কিন্তু কোনো কাউন্টার থেকে টিকিট নিতে পারেননি। বরং তার কাছে দ্বিগুণ দামে টিকিটের ব্যবস্থা করে দেওয়ার কথা কাউন্টার থেকে বলা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
এই শিক্ষক ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঈদের পর দিন থেকে টানা দুই দিন হানিফ, শ্যামলী, আগমনী, নাবিল ও এসআরসহ বেশ কয়েকটি কাউন্টারে গিয়েছি। চারটি টিকিটের জন্য অনেক চেষ্টা করেছি। কাউন্টারে টিকিট নেই বলে সাফ জানিয়েছে। শুধুমাত্র আগমনী কাউন্টারের একজন দ্বিগুণ দামে টিকিট দিতে চেয়েছেন। চারটা টিকিটের জন্য ওই ব্যক্তি ছয় হাজার টাকা দাবি করেছেন। এতো টাকা দিয়ে ননএসি বাসের টিকিট কাটা অসম্ভব।
মিঠাপুকুর উপজেলার শঠিবাড়ী থেকে আসা সেলিম মিয়ার সঙ্গে এনা কাউন্টারের পাশে কথা হয়। তিনি আজ রাতেই (শুক্রবার) ঢাকায় যাবেন। এজন্য টিকিট নিতে এসেছেন। টিকিটও পেয়েছেন। তবে কাউন্টার থেকে নয়। ৭শ টাকার টিকিট ১২শ টাকায় কাউন্টারের বাইরের এক কলারবয়ের কাছ থেকে কিনেছেন বলে জানান এই যুবক।
ছুটি শেষ হওয়ার আগে কর্মক্ষেত্রে পৌঁছাতে না পারলে হয়তো চাকরি হারাতে হবে এমন আশঙ্কা প্রকাশ করে সেলিম মিয়া বলেন, প্রত্যেক বছর ঈদপরবর্তী যাত্রার সময়ে বেশি দামে টিকিট কিনতে হয়। কালোবাজারিদের কাছ থেকে ছাড়া কাউন্টার থেকে টিকিট পাওয়া যায় না। এবারও তো সেই একই অবস্থা হলো। টিকেট নিয়ে এই কারসাজি বন্ধে প্রশাসন ও ভোক্তা অধিকারকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।
অন্যদিকে সুবর্ণা ইব্রাহিম ও রাজ বাবু নামে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া দুই শিক্ষার্থী জানান, তারা দুজন তিন হাজার ৬শ টাকা দিয়ে এসি বাসের দুটি টিকিট নিয়েছেন। দাম বেশি হলেও উপায় ছিল না। জরুরি কাজে তাদের ঢাকায় যেতে হচ্ছে।
ঈদ-পরবর্তী যাত্রার ‘টিকিট নেই, টিকিট আছে’ এমন নাটকে অতিষ্ট সাধারণ যাত্রীরা। তাদের অভিযোগ, কাউন্টারগুলোতে টিকিট না পাওয়া গেলেও বাইরে ঠিকই বেশি দামে টিকিট পাওয়া যাচ্ছে। আর এসব নিয়ন্ত্রণ করছে স্থানীয় একটি কালোবাজারি চক্রসহ পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা।
রংপুর নগরীর কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল ও ঢাকা কোচ স্ট্যান্ডে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পরিবহন কর্মীরাসহ একটি মহল বাড়তি দামে টিকিট বিক্রির আশায় ঈদের পরের কয়েকদিনের টিকিট আটকে রেখেছেন। নির্ধারিত দামের চেয়ে বাড়তি দাম পেলেই হাত বদল হচ্ছে এসব টিকিটের।
নাম না প্রকাশের শর্তে শাহ ফতেহ আলী ট্রাভেলসের একজন স্টাফ জানান, ১০ তারিখ পর্যন্ত টিকিট দেওয়া যাচ্ছে না। স্থানীয় অনেকে আগে থেকেই বিভিন্ন নামে বেনামে বেশ কিছু টিকিট কিনে রেখেছেন। ওই টিকিটগুলো তারা এখন কলারবয়দের দিয়ে চড়া দামে বিক্রি করছেন।
কালোবাজারিরা কীভাবে টিকিট পাচ্ছে জানতে চাইলে এর সদুত্তর না দিয়ে তিনি জানান, এখন যারা কাউন্টার থেকে টিকিট পাচ্ছেন তাদের বেশির ভাগই পরিচিত লোকজন। টিকিটের এই পরিকল্পিত সংকট ঈদের আর কয়েকদিন পর্যন্ত থাকবে। আগামী ১০ মের পর টিকিট স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
বিআরটিসির রংপুর ডিপো সূত্র জানা গেছে, ঈদের ছুটিতে রংপুরে দুই শতাধিক দোতলা ও শতাধিক একতলা বিআরটিসি বাস রিজার্ভ করে কয়েক হাজার পোশাকশ্রমিক এসেছেন। এসব বাস ঢাকার বিভিন্ন রুটে চলাচল করে। রংপুর নগরীর আরকে রোড, মডার্ন মোড়, ট্রাক স্ট্যান্ড, মাহিগঞ্জ ও তাজহাট এলাকায় সারিবদ্ধভাবে রাস্তার পাশে বাসগুলো রাখা হয়েছে। ঈদের ছুটি শেষে বাসগুলো শ্রমিকদের নিয়ে পর্যায়ক্রমে গন্তব্যে ফিরতে শুরু করেছে।
রংপুর জেলা মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক এম এ মজিদ জানান, কামারপাড়া ঢাকা কোচ স্ট্যান্ড থেকে বিভিন্ন কোম্পানির ১৭০টি গাড়ি যায়। টিকিট নিয়ে কালোবাজারির কোনো সুযোগ নাই। আগ্রিম টিকিট শেষ হওয়ার কারণে কোনো কোনো কাউন্টারে টিকিট নাও থাকতে পারে। তবে ঈদের সময় অনেক গাড়ি অনিয়ম করে। আমরা প্রশাসনকে অনুরোধ করব, যেন কেউ বেশি ভাড়া নিতে না পারে।
ফরহাদুজ্জামান ফারুক/আরএআর