মেহেরপুর কৃষিনির্ভর একটি জেলা। এখানে তেমন কলকারখানা বা শিল্প প্রতিষ্ঠান নেই। কৃষি কাজই মেহেরপুরের মানুষের একমাত্র উপার্জনের মাধ্যম। এখানকার অধিকাংশ কৃষকেরই বসবাস দারিদ্র্যসীমার নিচে। সাধারণত ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত জেলার দরিদ্র মানুষরা কাজের অভাবে বাড়িতে অলস সময় কাটান।

কাজের অভাবে এই সময়ে তারা নানা সংকট ও কষ্টে দিনাতিপাত করেন। জীবন চালাতে বিভিন্ন এনজিও সংস্থার কাছে নেওয়া কিস্তির টাকা পরিশোধ করতে নাজেহাল হয়ে পড়েন নারীপ্রধান সংসারগুলো। 

কৃষি থেকে শুরু করে ইটভাটা ও রাজ মিস্ত্রির কাজ করেন অনেক নারী। কাজের ক্ষেত্রে সমতা থাকলেও নেই মজুরি সমতা। প্রতিটি ক্ষেত্রেই মজুরি বৈষম্যের শিকার হয়ে নারী শ্রমিকদের ঠকতে হচ্ছে। মজুরি বৈষম্য রোধে উদ্যোগ নেই সরকারি কিংবা বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানের। পুরুষদের সাথে তাল মিলিয়ে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেও নারী শ্রমিকরা কাঙ্খিত পারিশ্রমিক পাচ্ছেন না এমন অভিযোগ অনেকের।

জানা গেছে, মেহেরপুর জেলায় ৬ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯২ জনের মোট জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ মানুষ শ্রমিক। কৃষিকাজ থেকে শুরু করে বিভিন্ন জায়গায় শ্রম বিক্রি করে জীবন চালায়। পুরুষ শ্রমিকদের পরিসংখ্যানের দুই ভাগের এক ভাগই নারী শ্রমিক। বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়নে নারী শ্রমিকদের ভুমিকা চোখে পড়ার মতো। সরকারি নানা উন্নয়নমুখী কর্মকাণ্ডে নারী শ্রমিকদের অংশগ্রহণ থাকলেও পারিশ্রমিকের বেলায় পুরুষদের অর্ধেক মজুরিতে কাজ করতে হচ্ছে জেলার নারী শ্রমিকদের। 

অন্যান্য বছরের তুলনায় ২০২১-২২ অর্থবছরে দরিদ্র মানুষরা যাতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতে পারে, সে জন্য বিশ্ব ব্যাংক চালু করেছে ‘অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসূচি’ (ইজিপিপি)। এ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে স্ব-স্ব উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিস। এ প্রকল্পের আওতায় নারী ও পুরুষ শ্রমিকদের সমমর্যাদা দেওয়া হয়েছে।

জেলায় ইজিপিপি শ্রমিক রয়েছে ৩৬৬০ জন। এদের অর্ধেক নারী শ্রমিক। কিন্তু স্থানীয়ভাবে কাজ করতে গেলে নারী-পুরুষের মধ্যে মজরি বৈষম্য করার অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।

মেহেরপুর ঝাউবাড়িয়া গ্রামের নারী শ্রমিক বিলকিস আরা বলেন, আমার স্বামী মারা যাবার পর সন্তানদের নিয়ে কষ্টে দিন যাপন করছিলাম। এখন স্থানীয়দের কৃষি জমিতে কাজ করে সেই পারিশ্রকি দিয়ে সংসার চালাই। পুরুষদের পাশাপাশি আমরাও কর্মক্ষেত্রে কাজ করি, কিন্তু মজুরি পাই কম। আমাদের সাথে বৈষম্য করা হয়।

ভাটপাড়া গ্রামের তরিফা খাতুন জানান, ছোট বেলায় বাবাকে হারিয়েছি। স্বামীর বাড়িতেও ঠাঁই হয়নি। এখন কৃষি কাজ করি। কচু বাছায়, আলু, বেগুন ও মরিচ তোলার কাজ করি। পুরুষদের তুলনায় আমরা অনেক বেশি সময় ধরে কাজ করে দিই, তারপরও আমাদেরকে মজুরি কম দেয়। সারাদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে অল্প মজুরি পাওয়ার সময় মন খারাপ হয়।

চৌগাছা ভিটাপাড়ার হুর মদিনা জানায়, আমরা কর্মক্ষেত্রে পুরুষদের সম পরিমাণ কাজ করেও গেরস্তর কাছ থেকে ঠকে আসছি। আমাদের পাশে দাঁড়াবার কেউ নেই।

মেহেরপুর জেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা নীল হাফিয়া বলেন, জেলায় নারী শ্রমিকদের কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে পুরুষদের পাশাপাশি নারীরা কৃষিসহ নানা বিষয়ে শ্রম দিয়ে যাচ্ছে। এতে পরিবার, সমাজ ও দেশ সব দিক দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। নারীরা শুধু ঘর গোছানোর কাজই নয়, রোজগার করে পুরুষদের সহায়তা করছে।

যারা মাঠে-ঘাটে কাজ করছে তারা বিভিন্নভাবে অবহেলিত। স্থানীয় মানুষকে এ বিষয়টি বুঝতে হবে। তাদেরকেও সম্মানজনক মজুরি প্রদান করা নৈতিক দায়িত্ব। আমি তাদের এ দাবির কথা জানাব।

মেহেরপুর জেলার ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) সিনিয়র ম্যাজিস্ট্রেট হুমায়ুন কবীর বলেন, শুধু মেহেরপুরই নয়, সারাদেশেই নারী শ্রমিকদের অংশগ্রহণ প্রশংসনীয়। প্রতিটি শ্রমিকের পারিশ্রমিকের ব্যাপারে সরকারি কর্মমজুরি বোর্ড রয়েছে। নারী শ্রমিকরা যেহেতু উন্নয়নের অংশিদার, সেহেতু তাদের ফাঁকি দেওয়া বা মজুরি কম দেওয়া অমানবিক। স্থানীয়দের বৈষম্য না করার অনুরোধ জানাই।   

আরআই