ঈদকেন্দ্রিক আকর্ষণ দৃষ্টিনন্দন তিস্তা পার্ক
এপার-ওপার বিস্তৃত তিস্তা। কোথাও জেগেছে বালুচর। কোথাও আবার কোমর বা হাঁটুসমান পানি। চারদিকে ছুটে বেড়াচ্ছে ছোট ছোট নৌকা। নদীর ওপর দিয়ে ছুটছে ট্রেন ও চলছে ভারী যানবাহন। সকাল-বিকেল আর সন্ধ্যা-রাতে নজর কাড়ে অন্য রকম প্রকৃতি।
এই নদীর অববাহিকায় রেল ও সড়ক সেতুকে ঘিরে গড়ে উঠেছে দৃষ্টিনন্দন তিস্তা পার্ক। যেন প্রাকৃতিক অপরূপ সৌন্দর্যে ঘেরা চারপাশ।
বিজ্ঞাপন
নদী ও প্রকৃতিকে সঙ্গে নিয়ে বিনোদনের জন্য নতুন এই সংযোজন ঘিরে বাড়ছে দর্শনার্থী ও পর্যটকদের আনাগোনা। শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণীসহ নানা বয়সী মানুষদের আকৃষ্ট করছে সম্ভাবনাময় এই পর্যটন শিল্প। সড়ক ও রেল সেতু ঘিরে তিস্তা নদীর কোলে এটি প্রথম পার্ক।
রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার উত্তর-পূর্ব প্রান্তে তিস্তা বাজার সড়কে দৃষ্টিনন্দন এই তিস্তা পার্কের অবস্থান। রংপুর থেকে কুড়িগ্রাম যেতে তিস্তা সড়ক সেতু পার হয়ে হাতের বাঁয়ে তাকালেই দেখা মিলবে বাঁধের কোলঘেঁষা সুসজ্জিত তিস্তা পার্কটি। আবার কুড়িগ্রাম থেকে রংপুরের দিকে আসার পথে সড়ক সেতুতে উঠতেই হাতের ডানে এই পার্কটি মনোরম পরিবেশে উঁকি দিচ্ছে। দেখতে যেমন আকর্ষণীয়, তেমনি বিনোদনের জন্য চমৎকার ও নজরকাড়া।
এবারের ঈদে শিশু-কিশোরদের নির্মল আনন্দের জন্য পার্কটিকে সাজানো হয়েছে নতুন রঙে। তাদের জন্য রয়েছে বিভিন্ন রাইড। আছে দর্শনার্থীদের জন্য নানা খাবারেরও ব্যবস্থা। পার্কটি দেখতে দূরদূরান্ত থেকে ছুটে আসছে ভ্রমণপিপাসু মানুষ। সুন্দর মুহূর্ত কাটানোর জন্য সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে দেখা যায় এই পার্কে। কেউ হেঁটে হেঁটে, কেউবা আবার ছুটে ছুটে দেখছেন পার্কের আশপাশ। ভালো লাগার মুহূর্তকে ক্যামেরাবন্দী করার দৃশ্য দেখা যায় এখানে।
পার্ক কর্তৃপক্ষ সূত্র জানিয়েছে, ২০২১ সালের মার্চে নদীর কোল ঘেঁষে শুরু হয় তিস্তা পার্ক নির্মাণকাজ। গেল এক বছরে শিশু-কিশোরদের আকৃষ্ট করতে বেশ কিছু আকর্ষণীয় রাইড সংযোজন ছাড়াও পার্কে জীবজন্তুর কৃত্রিম প্রতিকৃতি স্থাপন করা হয়েছে। উপজেলা পরিষদ থেকে রুহুল আমিন দুলু নামে স্থানীয় একজন তিন বছরের জন্য সরকারি এই জমিটি ইজারা নিয়েছেন। পরে সেখানে করিম ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের তত্ত্বাবধানে তিস্তা পার্ক গড়ে তোলার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয়।
পার্কটির জমির পরিমাণ প্রায় সাড়ে ছয় একর। এর নির্মাণকাজ শুরুর পর থেকেই স্থানীয়সহ রংপুর জেলা এবং পার্শ্ববর্তী জেলার বিভিন্ন এলাকার বিনোদনপ্রিয় মানুষের সাড়া মিলেছে। অল্প সময়ের মধ্যে পার্কের পরিচিতি ও দর্শনার্থীদের আস্থা অর্জনে কুড়িয়েছে প্রশংসা।
তিস্তা পার্কের ভেতরে প্রবেশ করতে লাগবে ১০ টাকা। আর রাইড প্রতি টিকিট করতে ২০ টাকা করে গুনতে হবে। এখানে শিশুভুবন ছাড়া রয়েছে তিস্তা সুপার এক্সপ্রেস, টয়ো মিনি ট্রেন, ফ্যামিলি ম্যারিগো রাউন্ড, ট্রেন ওভার ব্রিজ, মিনি ম্যারিগো রাউন্ড, সুইং চেয়ার, উড়োজাহাজ, স্লিপার, দোলনা, ডিজিটাল ঢেকিসহ বিভিন্ন রাইড। সঙ্গে দর্শনার্থীদের জন্য আড্ডা ও খাবার সুবিধা মেটাতে রয়েছে তিনটি ফুড কোর্ট। পার্কে ঘুরতে আসা বেশির ভাগ দর্শনার্থী বয়সে শিশু-কিশোর ও তরুণ-তরুণী।
এই পার্কে ঘুরতে এসেছিলেন বেতার ও টেলিভিশনের তালিকাভুক্ত সংগীতশিল্পী পল্লবী সরকার মালতি। তার বাড়ি থেকে বেশ কাছেই তিস্তা পার্কটি।
ঢাকা পোস্টকে পল্লবী সরকার বলেন, রমজানে বেশ কয়েকবার পার্কে ঘুরতে গিয়েছিলাম। তিস্তা নদীর কোল ঘেঁষে গড়ে ওঠা সুন্দর এই পার্কটি আমাদের প্রত্যন্ত জনপদের মানুষের বিনোদনের জন্য অসম্ভব সুন্দর জায়গা। এখানকার পরিবেশ মনোমুগ্ধকর। বিশেষ করে পার্কে দাঁড়িয়ে গোধূলী সন্ধ্যার দৃশ্য উপভোগ করা। আবার কখনো বাতাসের সঙ্গে নদীর স্রোত আর বালুচরে পানির লুকোচুরি দেখতে বেশ ভালো লাগে।
রংপুর নগর থেকে প্রায় ২৩ কিলোমিটার দূরে তিস্তা পার্ক। এখানে রংপুর থেকে বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে ঘুরতে এসেছেন বেশ কয়েকজন তরুণ। তাদেরই একজন বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থী ও স্বেচ্ছাসেবী জীবন ঘোষ।
ঢাকা পোস্টকে এই শিক্ষার্থী বলেন, অনেকগুলো রাইড, পিকনিক স্পট, আড্ডা জোনসহ তিস্তা পার্কটি বেশ পরিচ্ছন্ন ও আকর্ষণীয়। তিস্তা নদীকে ঘিরে রংপুরে এ ধরনের কোনো পার্ক নেই। আমাদের মতো দূরদূরান্ত থেকে অনেক মানুষ এখানে আসছে। পরিবেশটা বেশ উপভোগ্য। নদীর মনোরম দৃশ্য উপভোগের সঙ্গে পার্কের পরিবেশ আমাদের খুব ভালো লেগেছে।
সংবাদ ও সংস্কৃতিকর্মী রেজাউল করিম জীবন বলেন, তিস্তা নদীকে ঘিরে এখানে সব সময়ই বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষজন ঘুরতে আসেন। এখানে পাশাপাশি দুটি রেল ও সড়ক সেতু রয়েছে। এর মধ্যে ব্রিটিশ আমলে নির্মিত রেল সেতুটি ভ্রমণপিপাসুদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে। আগে ঘুরতে এসে কোথাও বসে সময় কাটানোর জন্য নিরিবিলি পরিবেশ ছিল না। এখন তিস্তা পার্কটি সেই অভাব পূরণ করছে।
কুড়িগ্রামের চিলমারী থেকে আসা রাকিবুল ইসলাম বলেন, এখানে একটি পার্ক হয়েছে শুনেছি। জরুরি কাজে রংপুরে গিয়েছিলাম। বাড়ি ফেরার পথে পার্কে ঘুরতে এলাম। নদীর বুকে দাঁড়িয়ে থাকা ব্রিটিশ আমলের রেল সেতুতে হেঁটেছি। আবার সড়ক সেতুর ওপর থেকে নদীর দুই পাড়ের মনোরম দৃশ্য আর পার্কের পরিবেশটা দেখে সব মিলিয়ে খুব ভালো লাগছে।
তিস্তা পার্কটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহমুদুন্নবী মামুন ঢাকা পোস্টকে বলেন, মানুষজন যেন একটু আনন্দ পায়, সে জন্যই নদীর পূর্ব প্রান্তে পার্কটি তৈরি করা হয়েছে। পার্কে শিশুদের চিত্তবিনোদনের বিষয়টি বেশি গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়েছে। এখানে কৃত্রিম পাহাড়, লেক, সুইমিংপুল ছাড়া বিভিন্ন রাইড রয়েছে। শুধু শিশু-কিশোরই নন, এখানে সব বয়সী মানুষ আনন্দে সময় কাটাতে পারবে। শুধু তা-ই নয়, দক্ষিণে থাকা তিস্তা নদীর মনোরম দৃশ্য দেখতে বাঁধের ওপর দাঁড়ালে মন জুড়িয়ে আসবে। এখানে একসঙ্গে পার্ক ও নদীময় প্রকৃতির দৃশ্য উপভোগ করা সম্ভব।
নদীকেন্দ্রিক পর্যটনশিল্প গড়ে তোলার প্রয়াস থেকে পার্কটিকে ভবিষ্যতে আরও দৃষ্টিনন্দন করার পরিকল্পনার কথা জানান তিস্তা পার্কের চেয়ারম্যান সেরাফুল হোসেন হিমেল।
তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিনোদনপ্রিয় মানুষের চাহিদাকে আমরা বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। একই সঙ্গে কোমলমতি শিশু-কিশোরদের জন্য পার্কে রয়েছে আকর্ষণীয় স্থাপনা। সাড়ে ছয় একর জমির ওপর গড়ে তোলা এই পার্ক ঘিরে আমাদের অনেক পরিকল্পনা রয়েছে। রংপুর অঞ্চলে নদীকেন্দ্রিক এ রকম বিনোদন কেন্দ্র বা পার্ক আরও বেশি করে গড়ে তোলা সম্ভব হলে ভবিষ্যতে উত্তরের পর্যটনশিল্প বেশ সমৃদ্ধ হবে বলে জানান তিনি।
এদিকে তিস্তা নদীর কাউনিয়াপ্রান্তে গড়ে ওঠা তিস্তা পার্কের মতো রংপুরের পীরগাছা ও গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ মোহনায় তিস্তা ঘেঁষে তৈরি করা হয়েছে আলী বাবা থিম পার্ক নামে বৃহৎ একটি বিনোদন কেন্দ্র। এ ছাড়া রংপুরের গঙ্গাচড়ায় মহিপুরে শেখ হাসিনা তিস্তা সড়ক সেতুর নিচে একটি ভাসমান ও অভিজাত রেস্টুরেন্ট রয়েছে। রংপুর নগরীর নিসবেতগঞ্জে ঘাঘট নদীর অংশ বিশেষসহ পার্শ্ববর্তী বিস্তৃত নিচু এলাকায় সবুজে সাজানো কোলাহলমুক্ত পরিবেশে রয়েছে প্রয়াস সেনা বিনোদন।
সেনাসদস্যদের নিখুঁত কারিগরি পরিকল্পনায় বাঁশ ব্যবহার করে এই পার্কটি সাজানো হয়েছে। ঈদকে ঘিরে নদীকেন্দ্রিক বিনোদনপ্রিয় মানুষেরা বরাবরই পরিবার-পরিজনকে সঙ্গে নিয়ে এসব পার্কে ঘুরতে আসেন।
এনএ