‘কিছু বুজি উঠার আগোতেই ঘরবাড়ি উড়ি যায়’
কৃষক আবু তালেব। পরিবার নিয়ে আছেন খোলা আকাশের নিচে। রাতের মতো দিনের বেলায়ও বিশাদময় তার মুখ। আবু তালেবের মতো বহু মানুষ খোলা আকাশের নিচে বসে ডুকরে ডুকরে কাঁদছেন। কালবৈশাখী ঝড় তাদের ঘরবাড়ি তছনছ করে দিয়েছে। কেড়ে নিয়েছে চোখের ঘুম। নষ্ট করে দিয়েছে শিশু-কিশোরদের ঈদপ্রস্তুতি।
কালবৈশাখীর তাণ্ডবের কথা বলতে গিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করেন কৃষক আবু তালেব। রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার বিষ্ণপুর ইউনিয়নের এই কৃষক বলেন, ‘বউ-ছাওয়া নিয়্যা ঘুমাবার জন্য রেডি হছনো। আইত তখন নয়টা হইবে। হঠাৎ করি খুব বাতাস শুরু হয়। বাড়ির বাইরের গাছগুল্যা ভাঙি ঘরের চালাত পড়ে। কিছু বুজি উঠার আগোতে নিমিষেই চোখের সামনে ঘরবাড়ি উড়ি যায়। আইতোত আর থাকার মতো ঘর ছিল না। খুব কষ্ট করি খোলা আকাশের নিচোত আইত কাটছে।’
আবু তালেবের মতো মঙ্গলবার (২৬ এপ্রিল) রাতের কালবৈশাখী ঝড়ের ঘটনায় খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছে হাজার হাজার পরিবার। রাত ৯টার পর থেকে থেমে থেমে কালবৈশাখী ঝড় ও শিলাবৃষ্টি আঘাত হানে। এতে লন্ডভন্ড হয়ে গেছে রংপুরের পাঁচটি উপজেলার কয়েকশ বাড়িঘর। ভেঙে গেছে হাজার হাজার গাছপালা। কিছু জায়গায় আধাপাকা বিল্ডিং ঘরও ভেঙে পড়েছে।
বিজ্ঞাপন
কৃষকরা বলছেন, শিলাবৃষ্টিতে ক্ষতি হয়েছে ভুট্টা, গম, ধানসহ শত শত একর আগাম উঠতি ফসলসহ শাক-সবজির। ক্ষতি হয়েছে হাড়িভাঙ্গা আমের মুকুলের গুটি। তীব্র বেগে আসা বৈশাখী ঝড়ে শত শত ঘরবাড়ি-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্ষতির পাশাপাশি উড়ে গেছে বহু স্থাপনা। তবে কৃষি বিভাগ ও আবহাওয়া অধিদপ্তর বুধবার (২৭ এপ্রিল) বিকেলেও ক্ষতির পরিমাণ জানাতে পারেনি।
রংপুর আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা গেছে, গত ২৪ ঘণ্টায় জেলায় ৭ দশমিক শূন্য মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। বৃষ্টির পরিমাণ কম হলেও ঝড়ে বাতাসের তীব্র বেগ ছিল। কোথাও কোথাও ভারী বজ্রপাতও হয়েছে।
রংপুর মহানগর ছাড়াও জেলার পীরগঞ্জ, বদরগঞ্জ, কাউনিয়া, গঙ্গাচড়া, মিঠাপুকুর উপজেলার অন্তত ৮ শতাধিক ঘরবাড়ির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে বেশি ক্ষতি হয়েছে পীরগঞ্জ, বদরগঞ্জ ও কাউনিয়া উপজেলায়। প্রায় এক ঘণ্টার ঝড় ও শিলাবৃষ্টির আঘাতের চিহ্ন এখন ক্ষতিগ্রস্তদের কাঁদাচ্ছে।
মিঠাপুকুরের বড়বালা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান তরিকুল ইসলাম সরকার স্বপন জানান, তার ইউনিয়নের কেশবপুর, তরফবাহাদী, নয়াপাড়াসহ ১০টি গ্রামের কয়েকশ বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মুহূর্তেই অনেক বাড়িঘরের টিনের ছাদ উড়ে চলে গেছে। অনেক বাসাবাড়ি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গাছ উপড়ে ঘর নষ্ট হয়েছে। বাতাসে ভেঙে গেছে গাছপালা, উড়ে গেছে ঘরের টিন। ঘরবাড়ির টিনের চালা, ইট এবং ভেঙে পড়া গাছপালার আঘাতে আহত হয়েছেন অন্তত ১০/১৫ জন। অনেকের শরীর টিনে কাটা গেছে। জরুরি ভিত্তিতে উপজেলা প্রশাসনের কাছে অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়ানোর দাবি জানান তিনি।
এ ঝড়ে বদরগঞ্জ উপজেলার বিষ্ণুপুর ও রামনাথপুর ইউনিয়নের মধ্যে ঘরবাড়ির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। গাছপালা উপড়ে পড়ে মাটির বাড়িঘর ভেঙে গেছে। এ দুটি ইউনিয়নের প্রায় পাঁচ শতাধিক ঘরবাড়ির ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছে উপজেলা প্রশাসন।
বিষ্ণপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শান্তু চৌধুরী বলেন, রাতে ঝড় থেমে যাওয়ার পর বিভিন্ন ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা ঘুরে দেখেছি। এই ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডে কয়েকশ বাড়িঘর ভেঙে গেছে। এতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তালিকা করে যতটুকু সম্ভব সহযোগিতা করা হবে।
মিঠাপুকুরের খোড়াগাছ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক জানান, শিলাবৃষ্টি এবং কালবৈশাখী ঝড়ে সব থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে হাড়িভাঙ্গা আমের বাগান। বাগানে গুটি গুটি আম। প্রায় সব বাগানেরই একটি বড় অংশের গুটি শিলা বৃষ্টিতে ঝরে মাটিতে পড়ে গেছে। এতে আম চাষিরা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন।
পীরগঞ্জের বড় আলমপুর ইউনিয়নে মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে শ্যামদাসের পাড়া, ষোলঘড়িয়া ও তামালপুর গ্রামে ঝড়ে গাছপালা উপড়ে পড়ে মাটির বাড়িঘর ভেঙে যায়। কারো কারো ঘরের চালা উড়ে গেছে। ধসে পড়েছে বাড়ির দেয়ালও। ক্ষতি হয়েছে ধান, ভুট্টা, আম ও কলাগাছের।
ষোল ঘড়িয়া গ্রামের নুরু মিয়া বলেন, সারা দিন আকাশে মেঘ ছিল না। হঠাৎ রাতে যখন ঘুমানোর প্রস্তুতি চলছিল, তখন ঝড়-বৃষ্টি শুরু হয়। ঝড়ে বাতাসের খুব বেগ ছিল। আমার নিজের ঘর-বাড়িসহ আশপাশের অনেকের বাড়ি ভেঙে তছনছ হয়েছে।
ঝড়ের তাণ্ডবে কাউনিয়া উপজেলার হারাগাছ পৌরসভা এলাকার টাংরির বাজার, মিলন বাজার, হরিণচড়া আদর্শ বাজার, বাঁশদহসহ আশপাশের বিভিন্ন গ্রামে অসংখ্য ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। হারাগাছ ফায়ার সার্ভিস রাতে বিভিন্ন এলাকা থেকে ঝড়ে আহত সাত শিশুসহ আটজনকে স্থানীয় ৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে ভর্তি করেছে। এই উপজেলার শহীদবাগ ইউনিয়ন, সারাই ইউনিয়ন এবং হারাগাছ পৌর এলাকাসহ তিস্তার চরাঞ্চলে অনেক বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উঠতি ভুট্টা আগাম আমনসহ শাকসবজির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে শিলাবৃষ্টিতে।
অন্যদিকে রংপুর-মীরবাগ ও কাউনিয়া ব্রিজসংলগ্ন এলাকায় ঝড়ে রেললাইনের ওপর গাছ ভেঙে পড়ায় সকালে কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস আটকা পরে ট্রেন চলাচলে বিঘ্ন ঘটে। পরে গাছ অপসারণ করে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক করা হয়।
কাউনিয়া উপজেলার বালাপাড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আনসার আলী জানান, মঙ্গলবার রাতে কালবৈশাখীতে তার ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের মৌলভীবাজার এলাকায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বাড়িঘরের টিন উড়ে গেছে। গাছপালা ভেঙে বাড়িঘর এবং রাস্তায় পড়েছে। বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। শত শত মানুষ খোলা আকাশের নিচে অবস্থান করছে।
এছাড়াও শিলাবৃষ্টি ও কালবৈশাখীতে গঙ্গাচড়ার খলেয়া, নোহালি, আলমবিদিতর, রংপুর সদর উপজেলার পাগলাপীর, সদ্যপুস্করনী, বদরগঞ্জের লোহানীপাড়া, কুতুবপুর ইউনিয়নসহ রংপুর বিভাগের বিভিন্ন উপজেলার কয়েক হাজার পরিবারের বাড়িঘর ভেঙে পড়েছে।
বদরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবু সাঈদ জানান, কালবৈশাখী ঝড়ে উপজেলার অন্তত ৫ শতাধিক ঘরবাড়ির ক্ষতি হয়েছে। এলাকার সংসদ সদস্য ও উপজেলা চেয়ারম্যানের সহযোগিতায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় শুকনো খাবার, নগদ টাকা প্রদানের জন্য ইতোমধ্যে তালিকা করে বিতরণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বিকেলের মধ্যে সংসদ সদস্য ও উপজেলা চেয়ারম্যান সেগুলো বিতরণ করবেন।
এদিকে রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ওবায়দুর রহমান মন্ডল জানান, এবারের কালবৈশাখী ঝরে ফসলের তেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। তবে গাছপালার ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। আমরা উপজেলা কৃষি অফিসের মাধ্যমে ফসলের ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপারে খোঁজখবর নিচ্ছি। ক্ষতির পরিমাণ বেশি হলে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরি করা হবে।
রংপুর আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা একেএম কামরুল হাসান জানান, মঙ্গলবার রাত ৯টা ৫ মিনিট থেকে রাত ৯টা ৫৫ মিনিট পর্যন্ত রংপুর বিভাগের বিভিন্ন স্থানসহ প্রত্যন্ত এলাকায় ঘণ্টায় ৩০ থেকে ৪৫ কিলোমিটার বেগে ঘূর্ণিঝড় ও শিলাবৃষ্টি হয়েছে। ঝড়ের স্থায়িত্ব ছিল ৫০ মিনিট। এই সময় ৭ দশমিক শূন্য মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। আগামী দুই-একদিন রংপুর অঞ্চলে ঝড়-বৃষ্টি হতে পারে বলেও জানান তিনি।
ফরহাদুজ্জামান ফারুক/আরএআর