ভারী বৃষ্টিপাত ও উজানের ঢলে অসময়ে নির্মিত সুনামগঞ্জের অনেক বাঁধ ভেঙে গেছে। কোথাও নদীর পাড় উপচে বোরো খেত তলিয়ে গেছে। ডুবে যাওয়া আধাপাকা ফসল ঘরে তুলতে প্রাণান্তকর চেষ্টা করছেন কৃষকরা। তবে বাইরে থেকে আসা প্রায় ২১ হাজার শ্রমিকের সহযোগিতায় প্রতিবছরে মতো এবারও ধান গোলায় তুলতে পারছেন জেলার কৃষকরা।

সুনামগঞ্জের দিরাই, শাল্লা, শান্তিগঞ্জ, তাহিরপুর, ধর্মপাশা ও ছাতক উপজেলায় তলিয়ে গেছে কৃষকের আধাপাকা ধান। এখন পর্যন্ত ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ১৯টি হাওরে পানি প্রবেশ করে নষ্ট হয়েছে হাজারো কৃষকের ধান।

সর্বশেষ রোববার সকালে শাল্লা উপজেলার ছায়ার হাওরে বাঁধ ভেঙে পানি ঢোকে। দিরাই, শাল্লা, নেত্রকোনার খালিয়াজুড়ি, মদন, কিশোরগঞ্জের ইটনা ও মিঠামইন উপজেলার প্রায় চার লাখ কৃষক এই হাওরে জমি চাষাবাদ করেন। শাল্লার মাউতির বাঁধ (৮১ নম্বর পিআইসি) ভেঙে হাওরে পানি প্রবেশ শুরু হতে থাকলে হাওরজুড়ে উৎকণ্ঠা দেখা দেয়। কৃষকরা কাটা ধান, নাকি পাকা ধান, নাকি খড় রক্ষা করবেন, এ নিয়ে পড়েন মহাবিপাকে।

কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, পুরো জেলায় ২ লাখ ২২ হাজার ৮০৫ হেক্টর জমিতে বোরো ধান আবাদ করা হয়েছে। এই ধান গোলায় তুলতে হাওরে প্রায় সাড়ে তিন লাখ শ্রমিক কাজ করছেন। জেলার শ্রমিকদের সঙ্গে প্রায় ২১ হাজার শ্রমিক দ্রুত ধান কাটতে কাজ করছেন।

সোমবার (২৫ এপ্রিল) পর্যন্ত জেলায় ১৯টি হাওর ডুবে ৫ হাজার ৭০০ হেক্টর জমি পানির নিচে তলিয়ে গেছে। ধান কাটা হয়েছে ১ লাখ ৩৫ হাজার হেক্টর জমির। যা মোট জমির ৮০ ভাগ।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এসব শ্রমিক প্রতিবছর নির্দিষ্ট কৃষকের আওতাধীন এসে থাকেন। যাদের স্থানীয়ভাবে বেপারি বলে ডাকা হয়। নির্দিষ্ট কৃষকের ধান কাটা শেষ হলে অন্য কৃষকেরও ধান কেটে দেন এসব বেপারি। তারা ধানের ভাগ ও টাকার বিনিময়ে ধান কাটেন। সাধারণত, বাড়ির নিচে বা হাওরের কিনারে খড়, বাঁশ ও বেত দিয়ে নির্মিত একধরনের দোচালা ঘর নিমার্ণ করে থাকেন তারা। রান্নাবান্নাও করেন সেখানে।

সিরাজগঞ্জ জেলার চৌহালি থানার উমরপুর ইউনিয়নের দত্তকান্দি গ্রামের বাসিন্দা মো. রবিউল ইসলাম। সাত সদস্যের পরিবারে মা-বাবাসহ চার বোনের সংসার তার। প্রতিবছরের মতো এবার বৈশাখ মাসে সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরে ধান কাটতে এসেছেন তিনি। তার সঙ্গে এ প্রতিবেদকের নলুয়ার হাওর দেখা।

তিনি বলেন, প্রতি কেয়ারে দুই বস্তা ধরে ধান কাটছি। ধান ছাড়া দুই হাজার টাকা ধরে প্রতি কেয়ার জমির ধান কাটছি। এ রকম ২০ থেকে ২৫ দিন ধান কাটলে ১৮ থেকে ২০ মণ ধান পাওয়া যাবে। এ ছাড়া এই কয়েক দিন ধান কেটে যে টাকা পাওয়া যাবে, তা দিয়েও ধান কিনে বাড়ি নিয়ে যাব।

শুধু রবিউল ইসলাম বেপারি নন, তার সঙ্গে একই দলে আরও ২০ জন বেপারি সিরাজগঞ্জ থেকে ধান কাটতে জগন্নাথপুরে এসেছেন। প্রতিবছরই ২১ জনের বেপারির দল এই উপজেলার নলুয়ার হাওরে ধান কাটতে আসেন।

একই এলাকা থেকে আসা বেপারি বাবুল মিয়া বললেন, আনসার ফটিক গেরস্তের ধান কাটতেছি। কোনো কেয়ারে (৩০ শতাংশে ১ কেয়ার) ২ বস্তা, আবার কোথাও টাকা দিয়ে কেটে দিচ্ছি। ধান ভালো হয়েছে। তাই টাকার থেকে ধানের ভাগে কাটলে ভাল বেশি বলে জানালেন তিনি।

পাবনার বেড়া উপজেলার নতুন ভারেঙ্গা ইউনিয়নের খড়গা বাজার গ্রাম থেকে আসা বেপারি মো. দাউদ হোসেন বলেন, অনেক দিন হলো নলুয়ার হাওরে ধান কাটছি। আরও সপ্তাহখানেক ধান কেটে বাড়ি চলে যাব। তার দলে আরও ২২ জন রয়েছেন। কদিন পরে দুই থেকে আড়াই শ বস্তা ধান নিয়ে যেতে পারবেন তারা। এতে জনে ১৫ থেকে ২০ মণ ধান পাবেন বলে জানান তিনি।

জগন্নাথপুরের বুড়াখালী গ্রামের কৃষক মাহবুব মিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, বেপারিদের আমরা নিজেরা খাওয়াব। পুরো মাস তারা আমাদের ধান কেটে দেবে। ধান কাটা শেষে বাড়ি যাওয়ার সময় আমরা ধান শুকিয়ে-উড়িয়ে কেয়ারে ২ বস্তা করে দেব। এ রকম চুক্তিতে নিজেদের জেলা থেকে আমাদের হাওরে ধান কাটতে এসেছে তারা। বাড়ি থেকে যাওয়া-আসার ভাড়াও দেব আমরা।

নলুয়ার হাওরের কৃষক মো. ইলা মিয়া বলেন, আমি ১৫ কেয়ার জমি করেছি। এই জমির ধান কাটতে বেপারিকে প্রায় ৩০ মণের উপর ধান দিতে হবে। এই বেপারিদের বাড়ি সিরাজগঞ্জ। বহু দূর থেকে আমাদের ধান কেটে দিতে এসেছেন। মাস শেষে তাদের বাচ্চা-কাচ্চার জন্য কিছু ধান নিতে পারবে। অন্য হাওর থেকে আমাদের হাওর অনেক ভালো রয়েছে। আমরা তাদের ভাগ দিই, আবার কেউ দেয় টাকা। কেউ দুই হাজার টাকা কেয়ার প্রতি, ভাগ দিলে দুই বস্তা করে দিতে হয়। জমিতে ভালো ধান হলে আড়াই বস্তাও দিই।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিমল চন্দ্র সোম ঢাকা পোস্টকে বলেন, সোমবার পর্যন্ত জেলার ১৯টি হাওরে পানি ঢুকে ৫ হাজার ৭০০ হেক্টর ফসলি জমি তলিয়ে গিয়েছিল। ২ লাখ ২২ হাজার ৮০৫ হেক্টর জমির ধান কাটতে স্থায়ী প্রায় তিন লাখ শ্রমিক কাজ করেছেন। এ ছাড়া বাইরের জেলা থেকে এসেছেন ২১ হাজার শ্রমিক। সবার সহযোগিতায় সোমবার পর্যন্ত জেলার ৮০ ভাগ ধান কাটা সম্ভব হয়েছে। কয়েক দিনের ভেতর হাওরে আবাদ করা জমির পুরো ধান কাটা শেষ হবে বলে জানান তিনি।

সাইদুর রহমান আসাদ/এনএ