প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর পেয়ে বদলে গেছে তাদের জীবন
মাত্র ১৪ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল তহুরা খাতুনের। কিন্তু কিছুদিন পরেই সন্তান গর্ভে আসলে তহুরাকে ছেড়ে অন্যত্র চলে যান স্বামী। তারপর স্বামীর বাড়িতে আর জায়গা হয়নি তার। শেষে হতদরিদ্র বাবার বাড়িতে এসে আশ্রয় নেন তিনি। থাকতেন ভাইয়ের ঘরের বারান্দার একটি অংশে। সেখানেই কিছু দিন পর তার কোলজুড়ে আসে ফুটফুটে কন্যাসন্তান।
পরের বাড়িতে কাজ করে অনেক কষ্টে সেই মেয়েকে বড় করে তোলেন তহুরা বেগম। মেয়ে কমলা বানুকে বিয়েও দিয়েছেন তিনি। সারাদিন পরের বাড়িতে কাজ করে রাতে এসে ভাইয়ের ঘরের বারান্দায় ঠাঁই হতো তহুরার। তবে দীর্ঘ ৫৫ বছর পরে সরকারি আশ্রয়ণ প্রকল্পে নিজের একটি ঘর পেয়ে এখন শান্তিতে রাতে ঘুমাতে পারছেন তহুরা। শুধু তাই নয় ৯২ বছর বয়সী নিজের মাকে এনে রেখেছেন তার নামে বরাদ্দকৃত আশ্রয়ণ প্রকল্পের এই ঘরে। এখানে তিনি লাগিয়েছেন লাউ, পেঁপে, আম আর কলা গাছ। সেসব গাছে ফলও ধরেছে।
বিজ্ঞাপন
প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া উপহারের একটি ঘর পেয়ে জীবনের গল্পটাই যেন বদলে গেছে তহুরার। সম্প্রতি ঢাকা পোস্টের কাছে নিজের জীবন পরিবর্তনের কথা জানিয়েছেন ৭০ বছর বয়সী এই নারী। শুধু তহুরাই নয়, তার মতো অনেকেরই আগের মতো আর দুঃখমাখা গল্প নেই জীবনে। জীবনের গতিপথ পরিবর্তিত হয়ে এখন সুখের ছোঁয়া লেগেছে।
মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার কুপড়িয়া আশ্রয়ণ প্রকল্পে সরকারি ঘর বরাদ্দ পেয়েছেন তহুরা বেগম। এই আশ্রয়ণ প্রকল্পে তার মতো ঠাঁই হয়েছে ১০-১২টি পরিবারের, যাদের পূর্বে ভিটেমাটি কিছুই ছিল না। অথচ জায়গাসহ সরকারি ঘর পেয়ে সেখানে গাছপালা লাগিয়ে তারা এখন নতুন স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন।
সরেজমিনে কুপড়িয়া আশ্রয়ণ প্রকল্পে বসবাসকারী লোকজনের সঙ্গে কথা বলে তাদের জীবনের গতিপথ পরিবর্তনের গল্প জানা গেছে। এখন তারা সোনালী দিনের স্বপ্ন দেখছেন।
কথা হয় কুপড়িয়া আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দা ৪৫ বছর বয়সী এলাচি বেগমের সঙ্গে। তিনি জানান, অনেক আগেই তাকে ছেড়ে চলে গেছেন স্বামী ইউসুফ আলী শেখ। এক ছেলে আর এক মেয়েকে নিয়ে অনেক কষ্টে দিনাতিপাত করছিলেন। উপায়ান্তর না দেখে মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার ৬ নং কাদিরপাড়া ইউনিয়নের রাধানগর বাজারের পাশে একটি চাতালে কাজ নেন তিনি। ঘাম ঝরানো অর্থে ছেলে-মেয়েদের বড় করেন। কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস ছেলে আমির শেখ ও মেয়ে রহিমা খাতুন এখন আর তার কোনো খোঁজখবর নেয় না।
স্বামী পরিত্যাক্তা এলাচি চাতালের পাশে একটি ছাপড়া ঘরে রাত্রিযাপন করতেন। অবশেষে কাদিরপাড়া ইউনিয়নের কুপড়িয়া আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় ২ শতাংশ জায়গার ওপরে একটি সেমিপাকা ঘর পান এলাচি বেগম। সেখানে ঘরের পাশে বেগুন, মিষ্টি কুমড়া, আর লাউ গাছ লাগিয়েছেন তিনি। এখন চাতালে কাজ করলেও শান্তিতে নিজের ঘরে ঘুমাতে পারছেন এলাচি।
এলাচি বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই ঘরটি দেছে বুলেই আজ আমি সুখির খোঁজ পায়চি।’
এলাচি বেগমের পাশের ঘরেই বসবাস করেন সোহাগ বিশ্বাস। তার বাড়ি ঝালকাঠির নলছিটি থানার খাওকিল গ্রামে। সোহাগ বিশ্বাস ঢাকা পোস্টকে বলেন, গার্মেন্টসসে কাজ করার সুবাদে পরিচয় ঘটে রোকসানা খাতুনের সঙ্গে। এরপর পরিণয় থেকে বিয়ে। করোনার কারণে চাকরি চলে যাওয়ায় স্ত্রীর হাত ধরে চলে আসেন মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার কাদিরপাড়া ইউনিয়নের কুপড়িয়া গ্রামে। এই গ্রামে আশ্রয়ণ প্রকল্পের একটি ঘর পেয়ে যান স্ত্রী রোকসানা। এখন স্ত্রীকে নিয়ে সুখের সংসার তার। তিনি এখন অন্যের জমিতে চাষাবাদ করেন। স্ত্রী আশ্রয়ণ প্রকল্পের পাশেই একটি বাড়িতে কাজ করেন। সংসারে এক ছেলে ও এক মেয়ে সোহাগ বিশ্বাসের। দুইজন মিলে যা আয় রোজগার করেন, তা দিয়ে মোটামুটি ভালোভাবেই চলছে তাদের সংসার। দুই শতাংশ জায়গাসহ বর্তমানে একটি সেমি পাকা ঘরে বসবাস করছেন তিনি।
আশ্রয়ণ প্রকল্পের আরেক বাসিন্দা রাজিয়া বেগম। স্বামী হুকুম আলী শেখ মারা যাওয়ার পর তিনি তার ভাইয়ের বাড়িতে থাকতেন। অন্যের বাড়িতে কাজ করে জীবন চলছিল তার। এক বছর হয়েছে তিনি আশ্রয়ণ প্রকল্পে একটি ঘর পেয়েছেন। চোখে ঠিকমতো দেখতে পান না রাজিয়া বেগম। বয়স প্রায় ৭০। তাই কোনো কাজকর্ম করতে পারেন না তিনি, নেই কোনো উপার্জন। তবে আশ্রয়ণ প্রকল্পে পাওয়া ঘরের পাশ দিয়ে প্রতিবেশীদের সহযোগিতায় সবজি এবং ফলের গাছ লাগিয়েছেন তিনি।
প্রায় প্রতিদিনই নিজের লাগানো সবজি বাগান থেকে শাকপাতা দিয়ে কোনো মতে দুমুঠো ভাত রান্না করে খেয়ে বেঁচে আছেন রাজিয়া বেগম। তবে আশ্রয়ণ প্রকল্পের অন্য অধিবাসীরা তাকে সহযোগিতা করে থাকেন। উপার্জন না থাকলেও সবমিলিয়ে ভালোই আছেন রাজিয়া বেগম। কারণ দিনশেষে আশ্রয়ণ প্রকল্পের এই ঘরে শান্তিতে একটু ঘুমাতে পারছেন তিনি।
একই আশ্রয়ণ প্রকল্পে একটি ঘর পেয়েছেন হাসান বিশ্বাস। তার বয়স এখন ৩৫। পেশায় ভ্যানচালক। হাসান বিশ্বাস ঢাকা পোস্টকে জানান, তার বাবা কাদিরপাড়া ইউনিয়নের মাউনডাঙ্গা গ্রামের মো. মঈনউদ্দীন বিশ্বাস ছিলেন খুবই দরিদ্র। বাবার ছোট্ট একখণ্ড জমিতে তিন ভাইয়ের সংসার পৃথক হয়ে যাওয়াই আলাদাভাবে ঘর করার কোনো জায়গা ছিল না হাসানের।
অবশেষে কুপড়িয়া আশ্রয়ণ কেন্দ্রে একটি ঘর পেয়ে যান হাসান বিশ্বাস। সেখানে শাকসবজি এবং বিভিন্ন ফলের গাছের পাশাপাশি পাতাবাহার ফুল গাছও লাগিয়েছেন তিনি। ভ্যান চালিয়ে এখন যা রোজগার করছেন তাতে স্ত্রী ও এক সন্তান নিয়ে খুব ভালোভাবেই চলছে তার সংসার।
ভ্যান চালাতে পরিশ্রম হলেও দিন শেষে নিজের থাকার একটি ঘর থাকায় মানসিকভাবে খুবই প্রশান্তিতে রয়েছেন হাসান বিশ্বাস। পূর্বে নিজের কোনো ঘর না থাকলেও বর্তমানে আশ্রয়ণ প্রকল্পে দুই শতাংশ জায়গাসহ সেমি পাকা একটি ঘরের মালিক হাসান বিশ্বাস।
শ্রীপুর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিসের উপ-সহকারী প্রকৌশলী অমিতাভ সরকার বলেন, উপজেলার আশ্রয়ণ প্রকল্পগুলোতে এ পর্যন্ত প্রথম ধাপে ২০টি, দ্বিতীয় ধাপে ৪০টি এবং তৃতীয় ধাপে ২২টি মিলিয়ে মোট ৮২টি ঘর নির্মাণ করা হয়েছে।
শ্রীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) লিউজা উজ জান্নাহ্ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আশ্রয়ণ প্রকল্পে নির্মিত প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘরগুলোতে ভূমিহীন এবং হতদরিদ্র মানুষেরা এখন সুখে-শান্তিতে বসবাস করছেন। কুপড়িয়া আশ্রয়ণ প্রকল্প পরিদর্শনে গেলে যে কারো মন ভরে যাবে। বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি ও ফলমূলের গাছ দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। সবুজ শ্যামল গাছপালায় ছায়া ঘেরা এই আশ্রয়ণ প্রকল্পে বসবাসকারী মানুষের জীবনের গতিপথ এখন বদলে গেছে। তারা এখন সুখের স্বপ্ন দেখছেন।
আরএআর