এবারও হলো না দুই বাংলার মিলনমেলা, হতাশা নিয়ে ফিরলেন স্বজনরা
ভৌগলিক সীমারেখার বেড়াজালে বন্দি দুই বাংলার লোকজন চান স্বজনদের সান্নিধ্য। আত্মার সুতোয় বাঁধা ভারত-বাংলাদেশের বাঙালিরা সুযোগ পেলেই পরস্পর মিলে যান ৷ বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে প্রতি বছর পহেলা বৈশাখের প্রথম দিন উত্তরের সীমান্তবর্তী জেলা পঞ্চগড়ের বিভিন্ন সীমান্তে বসে মিলনমেলা। কিন্তু গত তিন বছর ধরে বাংলা নববর্ষে উপলক্ষে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে মিলনমেলা হচ্ছে না।
বিভিন্ন দিক থেকে দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে নিরুৎসাহিত করায় এবারও বসেনি কাঁটাতারের দুই পাশের এই মিলনমেলা। ফলে স্বজনদের সঙ্গে দেখা করতে না পেরে বুক ভরা কষ্ট আর হতাশা নিয়ে ফিরেছেন সীমান্ত আসা লোকজন।
বিজ্ঞাপন
বিজিবি সূত্রে জানা যায়, বিভিন্ন সমস্যার পাশাপাশি মহামারি করোনার কারণে গত ২০১৯-২১ সাল পর্যন্ত তিন বছর ধরে পঞ্চগড়ের সীমান্তের কাঁটাতারে দুই বাংলার মিলনমেলা হয়নি। সীমান্তে এই মেলা চালুর বিষয়ে এবার চিঠি পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশ-ভারত দুই দেশের মাঝে শতভাগ প্রস্তুতি না থাকায় এ বিষয়ে নিরুৎসাহিত করা হয়। তাই এবারও বসেনি এই মিলনমেলা।
জানা যায়, সাধারণত পহেলা বৈশাখ ও বৈশাখের দ্বিতীয় দিন জেলার সদর ও তেঁতুলিয়া উপজেলার অমরখানা, শুকানী, মাগুরমারী, ভূতিপুকুরসহ বিভিন্ন পয়েন্টের কাঁটাতারের পাশে প্রায় ১০-১৫ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে দুই বাংলার এ মিলনমেলা হয়। দুই দেশের নানা প্রান্ত থেকে হাজার হাজার মানুষ মিলনমেলায় ছুটে আসে এবং তাদের আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে কাঁটাতারের মাঝখান দিয়ে একে অপরের সঙ্গে ভাব বিনিময় করে।
সরেজমিনে দেখা যায়, সকাল থেকে জেলার বিভিন্ন এলাকাসহ রংপুর, দিনাজপুর, নীলফামারী ও ঠাকুরগাঁও জেলা থেকে মানুষ এসে জড়ো হয় অমরখানা,মাগুরমারিাহ বিভিন্ন সীমান্ত এলাকায়। দুপুর পর্যন্ত অপেক্ষা করে তারা। কিন্তু অনুমতি না মেলায় তারা বুক ভরা কষ্ট আর হতাশা নিয়ে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে নিজ নিজ বাড়ি ফিরে যান। এমন ঘটনা ঘটেছে ভারতেও। ভারতের বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ ভিড় করে সীমান্তে। তারাও স্বজনদের দেখা না পেয়ে ফিরে যান।
জানা গেছে, ভারত-পাকিস্তান বিভক্তির আগ পর্যন্ত পঞ্চগড় জেলা ভারতের জলপাইগুড়ির অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু দেশভাগের কারণ এখানে বসবাসরত আত্মীয়-স্বজনরা দুভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও দুই দেশের নাগরিকরা আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে যাতায়াতের সুযোগ পেতেন। কিন্তু সীমান্ত এলাকায় কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার পর থেকে সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন তারা। তবে উভয় দেশের নাগরিকদের অনুরোধে প্রায় এক যুগেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (বিজিবি) ও ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) সম্মতিতে নববর্ষের দিন কাঁটাতারের দুই ধারে এসে দেখা করার সুযোগ পায় দুই বাংলার মানুষেরা।
এ বিষয়ে কথা হয় জেলার তেঁতুলিয়া উপজেলার বুড়াবুড়ি নাওয়াপাড়া এলাকা থেকে আসা বৃদ্ধা হাসিনা খাতুনের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমার ছোট ভাই ও মামার বাড়ি ভারতে। দেশ ভাগের পর বিভক্ত হয়ে পড়ি। আমরা তো ভারতে যেতে পারি না, তাই প্রতি বছর নববর্ষের দিনে আমরা কাঁটাতারে দেখা করতাম। আজ সকাল বেলা এসে অপেক্ষা করেছি, কিন্তু এবারো নাকি মিলনমেলা বসবে না। টানা ৪ বছর ধরে এভাবে ফিরে যাচ্ছি আমরা।
একই কথা বলেন অমরখানা এলাকায় ঠাকুরগাঁও থেকে আসা হরিপদ রায়। তিনি বলেন, ভারতে আমার মামার বাড়ি। আমার অনেক আত্মীয়-স্বজন সেখানে রয়েছে। নববর্ষ এলেই আমরা সীমান্তে এসে দেখা করতাম। টানা চার বছর ধর পহেলা বৈশাখে পঞ্চগড়ের বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত অভিমুখে এবারো বসবে না দুই বাংলার মিলনমেলা। ফলে বুক ভরা কষ্ট নিয়ে বাড়ি ফিরে যাচ্ছি। এই মিলনমেলাটা আবারও চালু করলে আমাদের জন্য অনেক ভালো হতো।
পঞ্চগড় ১৮ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল গোলাম ফজলে রাব্বী জানান, বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে বাংলাদেশ-ভারত দুই দেশের সীমান্তে মিলনমেলা বসার বিষয়ে আমরা কোনো চিঠি কিংবা নির্দেশনা পাইনি। তাই এবারও সীমান্ত এলাকায় মিলনমেলা বসেনি।
রনি মিয়াজী/আরএআর