অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য ফারুক হোসেন তালুকদার চেয়েছিলেন ছেলেকে ইসলামী শিক্ষায় স্নাতকোত্তর (মাওলানা) করাবেন। কিন্তু ব্যর্থ হলেন। এরপরে চেয়েছিলেন সেনা বাহিনীর বড় কর্মকর্তা হবে। কিন্তু ছেলের অনিহা। শেষে চেষ্টা চালালেন মেরিন ইঞ্জিনিয়ার পড়াতে। বাবার তাগিদ থাকলেও ছেলে আবেদনই করেনি। 

অতঃপর টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে গড়ে তুলতে আপ্রাণ চেষ্টা। কথামতো বুটিক্স সাবজেক্টে চান্স পেলেও ভর্তি হননি। বাবার মতের বিপরীতে গিয়ে শুরু থেকেই ধীমান ছিলেন কম্পিউটার সাইয়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে পড়ার। এক পর্যায়ে পরিবারের সকলের সমন্বিত চেষ্টাও ব্যর্থ হয়ে যায়। তবে জীবনের নির্ধারিত লক্ষ্য অনুসারে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাওয়ায় হাতছাড়া করেনি। 

কম্পিউটার সাইয়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে পড়তে গিয়ে শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ে থেমে থাকেননি, এবার ডাক পড়েছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ সার্চ ইঞ্চিন কোম্পানি গুগল লিমিটেড লায়াবেলিটিতে। সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার পদে চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে যোগদানের কথা রয়েছে।

গল্পটি বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের কম্পিউটার সাইয়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র আবু সায়েম সেফাতুল্লাহর। ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলার সূর্যপাশা গ্রামের বাসিন্দা তিনি। তিন ভাই-বোনের মধ্যে মেঝ সে। বড় বোন ঢাকা মেডিকেল কলেজের শেষ বর্ষের ছাত্রী। আর ছোট ভাই বরিশালের একটি স্কুলে মাধ্যমিকের ছাত্র। পুরো পরিবার নিয়ে বরিশাল শহরে ভাড়া থাকেন।

গত শুক্রবার (৮ এপ্রিল) ই-মেইলে পোল্যান্ডের গুগল কার্যালয়ে যোগ দেওয়ার জন্য তাকে সংযুক্ত পত্র পাঠানো হয়। আর এ খবর ছড়িয়ে পড়ার পরে আনন্দে ভাসছে সেফাতুল্লার পরিবার, স্বজন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সহপাঠীরা।

রোববার (১০ এপ্রিল) সুসংবাদ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগে শিক্ষকদের সঙ্গে দেখা করতে গেলে আনন্দে আপ্লুত হয়ে পড়েন শিক্ষকরা।

আবু সায়েম সেফাতুল্লাহ বলেন, এএইচএসসিতে ভর্তি হওয়ার পরই কম্পিউটার সাইয়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে পড়ার আগ্রহ জন্ম নেয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় চিন্তা ছিল যেখানে এ বিষয় পাব সেখানে ভর্তি হবো। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়ে ভর্তি হয়ে যাই। এরপরই নিজেই গবেষণা শুরু করি, সন্ধান শুরু করি। যেহেতু নিজের আগ্রহে এ বিষয়ে ভর্তি হয়েছি এজন্য সফল হতেই হবে।

তিনি বলেন, অনলাইনে বিভিন্ন ব্লগ পড়ে জানতে পারি ইন্টারনেট ভিত্তিক সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভালো করতে হলে কি কি করতে হবে। অনেককে দেখে আমিও চেষ্টা করলাম গুগলে। গুগল ৮ ধাপে ইন্টারভিউ নিয়ে ৮ এপ্রিল চাকরির জন্য প্রস্তাব পাঠায়। আগামী এক বছরের মধ্যে আমি পোল্যান্ডে গুগলের অফিসে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে যোগ দিতে পারব।

আবু সায়েম সেফাতুল্লাহ বলেন, সেখানে গিয়ে সুযোগ-সুবিধা ভালো পেলে থাকব। নয়তো তার চেয়ে ভালো সুযোগ পেলে আবার দেশে ফিরে দেশের জন্য কাজ করব।

বিভাগীয় চেয়ারম্যান মো. ইরফান বলেন, জায়ান্ট টেক গুগলে সেফাতুল্লাহর জয়েনিং প্রপোজাল আসার পরে এতো ভালো লেগেছে যে চোখের জল আটকে রাখা যায়নি। আমরা এতটা খুশি হয়েছি যে বোঝানো যাবে না। আমার ছেলে-মেয়ে নেই। কিন্তু ওর সুসংবাদে বাবার মতো একটি অনুভব কাজ করেছে নিজের মধ্যে।

তিনি বলেন, সেফাতুল্লাহর মতো সফল হতে হলে অন্য শিক্ষার্থীদের প্রতি আমার আহ্বান থাকবে আত্মবিশ্বাস নিয়ে কাজ করা। সেফাতুল্লাহ শুরু থেকেই অত্যান্ত মনোযোগী ছিলেন। এজন্যই আজ সে গুগলে চাকরি পেয়েছে। ওর প্রতি আমার পরামর্শ হচ্ছে, বিদেশে গিয়ে যেন বাংলাদেশের জন্য কাজ করে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. খোরশেদ আলম বলেন, তুলনামূলক নতুন বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। তারপরও আমাদের সমসাময়িক বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় শিক্ষা, গবেষণা ও সংস্কৃতি চর্চায় অনেক এগিয়ে। সর্বশেষ আবু সায়েম সেফাতুল্লাহ তার প্রমাণ যে সে গুগলে চাকরির প্রস্তাব পেয়েছেন। আমি বিশ্বাস করি এ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে দেশ এবং আর্ন্তজাতিক অঙ্গণে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করার সক্ষমতা অর্জন করেছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী রেজিস্ট্রার বাহাউদ্দিন গোলাপ বলেন, দক্ষিণ জনপদের সাধারণ মানুষের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশার প্রতিষ্ঠান বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর গুগলে ডাক পাওয়ার মধ্য দিয়ে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্ন্তজাতিক অঙ্গণে স্বীকৃতি মিলল। আমরা প্রত্যাশা করি এর ধারাবাহিকতা বজায় রেখে অন্যান্য শিক্ষার্থীরা দেশীয় এবং আর্ন্তজাতিক অঙ্গণে এর ধারাবাহিকতা বজায় রাখবে।

আবু সায়েম সেফাতুল্লাহর জন্য শুধু গুগলই সুখবর দেননি পরিবার থেকেও চিন্তা করা হয়েছে নতুন জীবনের। তার বাবা ফারুক হোসেন তালুকদার বলেন, সকল অভিভাবকদের প্রতি আমার অনুরোধ থাকবে সন্তানদের ওপর কোনো কিছু চাপিয়ে দেবেন না। তারা যে বিষয়টি পছন্দ করে সেটি পড়তে দিন। দেখবেন তাহলে তার ওপরে দায়িত্ব বর্তাবে এবং সে সফল হবে।

সন্তানের বিদেশ যাওয়ার প্রশ্নে বলেন, ও (আবু সায়েম সেফাতুল্লাহ) ঘরকুনো খুব। মা-বাবা ছাড়া বাইরে থাকতে পারে না। তাছাড়া ওর গন্ডি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাসা পর্যন্ত। যেহেতু পোল্যান্ডে যেতে হবে আমরা পারিবারিকভাবে চিন্তা করেছি ওই সময়ের মধ্যে ওকে বিয়ে করিয়ে পুত্রবধূসহ কর্মস্থলে যোগ দেবে।

ওদিকে বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে দেখা গেছে আবু সায়েম সেফাতুল্লাহর নতুন চাকরির খবর সকলের মুখে মুখে আলোচনার বিষয়। একই বিভাগের শিক্ষার্থীরা আসছেন তার সঙ্গে দেখা করতে। খোশগল্প, সেলফি তোলায় ব্যস্ত সময় পার করছেন আবু সায়েম সেফাতুল্লাহ।

এমএএস