নারায়ণগঞ্জে মা-মেয়ে খুন, রহস্যে ঘেরা ২ চরিত্র
নারায়ণগঞ্জে মা ও অন্তঃসত্ত্বা মেয়েকে হত্যার ঘটনায় গ্রেফতার যুবক জোবায়ের ও নিহতের পুত্রবধূ ফারজানা শিলাকে নিয়ে রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে। খুনের সময় একই ফ্ল্যাটে অবস্থানকারী ফারজানার অক্ষত অবস্থায় ফ্ল্যাট থেকে বটি নিয়ে বের হয়ে আসার যে গল্প শোনা যাচ্ছে তা মানতে নারাজ অনেকেই। এছাড়াও এলাকায় ভদ্র ও নামাজি বলে পরিচিত জোবায়ের এমন কাজ করতে পারেন- তা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেছেন কেউ কেউ।
তবে পুলিশ বলছে- টাকার অভাব মেটাতেই জোবায়ের এই খুন করেছেন বলে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন। রহস্যে ঘেরা ফারজানা শিলা এখন কোথায় অবস্থান করছেন তা জানাতে পারছেন তার শ্বশুর রাম প্রসাদ।
বিজ্ঞাপন
এই লোমহর্ষক হত্যার ঘটনায় নিহত রুমা চক্রবর্তীর স্বামী রাম প্রসাদ চক্রবর্তী বাদী হয়ে মামলা করেছেন। বুধবার (০২ মার্চ) সকালে নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় গ্রেপ্তার জোবায়েরকে একমাত্র আসামি করে এই মামলা করা হয়। পুলিশ গ্রেপ্তার জোবায়েরকে দুপুরে নারায়ণগঞ্জ আদালতে হাজির করে অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করলে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট নূর মোহসীন শুনানি শেষে তিনদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। মামলাটির তদন্তভার দেওয়া হয়েছে শহরের টানবাজার পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক সাইদুজ্জামানকে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, রাম প্রসাদ চক্রবর্তী তার ভাড়া বাড়ির পাশেই ‘মেসার্স ইসলাম ট্রেডার্স’ নামে একটি পাইকারি আড়তে ম্যানেজারের চাকরি করছেন বহু বছর ধরেই। তার ছেলে হৃদয় চক্রবর্তী কয়েক মাস আগে ফারজানা শিলা নামে এক মুসলিম মেয়েকে বিয়ে করেন। হৃদয় শহরের মাসদাইর কবরস্থানের পাশে একটি কোম্পানিতে চাকরি করেন। তিনি ভালোবেসে ওই মেয়েকে বিয়ে করার আগে ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলিম হয়েছেন। এ নিয়ে রাম প্রসাদের সঙ্গে হৃদয়ের মনোমালিন্য চলছিল। বিয়ের পর থেকে হৃদয় তার স্ত্রী ফারজানাকে নিয়ে আলাদা থাকতেন, তবে কোথায় থাকতেন তা ঠিক বলতে পারেননি কেউই। ৩/৪ দিন আগে হৃদয় ও তার স্ত্রী রাম প্রসাদের ভাড়া ফ্ল্যাটে থাকতে আসেন বলে জানিয়েছেন নিচ তলার আশপাশের দোকানিরা।
এদিকে রাম প্রসাদ বলছেন, তার স্ত্রী নিহত রুমা চক্রবর্তী ছেলের বিচ্ছেদ সইতে পারেননি বলে তিনি হৃদয় ও ফারজানাকে এসে থাকতে বলেছিলেন। তবে ফারজানার স্থায়ী বাড়ি কোথায় বা এখানে কোথায় ভাড়া থাকতো সে ব্যাপারে কোনো তথ্য নেই রাম প্রসাদের কাছে। এমনকি ঘটনার পর পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের পর ফারজানাকে তার জিম্মায় ছেড়ে দেওয়ার পর থেকে তিনি কোথায় আছেন তাও জানেন না বলে দাবি করেছেন রাম প্রসাদ। পাশাপাশি ছেলে হৃদয় কোথায় আছে সেই প্রশ্নেরও উত্তর রহস্যজনক কারণে এড়িয়ে যাচ্ছেন তিনি।
অপরদিকে গ্রেপ্তার জোবায়েরের নিজ বাড়ি পাইকপাড়া এলাকায় গিয়ে জানা গেছে, জোবায়েরের বাবা আলাউদ্দিন মিয়া একজন লবণ ব্যবসায়ী। নিজেদের ছোট্ট দোতলা বাড়ির ওপরের একটি কক্ষে থাকতেন জোবায়ের। নিচ তলায় আলাউদ্দিন তার স্ত্রীকে নিয়ে থাকতেন।
আলাউদ্দিন মিয়া জানান, জোবায়ের তাদের একমাত্র সন্তান। তার ছেলে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ভর্তি হয়। তবে আর্থিক অবস্থা ভালো না হওয়ায় পড়ালেখা চালাতে পারেনি। গত এক দেড় মাস ধরে তার ছেলে অস্বাভাবিক আচরণ করছিল। তাকে মানসিক ডাক্তার দেখানোরও পরিকল্পনা ছিল। দোতলার ঘরেই থাকতো বেশির ভাগ সময়। শুধু নামাজ ও খাবারের সময় সে নিচে নেমে আসত। জোবায়ের পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ত এবং অবসরে বিভিন্ন ইসলামিক বই পড়ত।
তিনি বলেন, শুনেছি জোবায়ের স্বীকার করেছে সে খুন করেছে, এখন আর কি বলার আছে। যদি সে অপরাধ করে থাকে তবে শাস্তি হবে। তবে কারো সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল কিনা কিংবা কেউ ওকে নিয়ে গিয়েছিল কিনা তা সুষ্ঠু তদন্ত করা উচিত।
অন্যদিকে জোবায়েরকে ভদ্র ও নামাজি বলেই আখ্যা দিচ্ছেন এলাকাবাসী। স্থানীয়রা জানান, জোবায়েরকে কখনও কারো সঙ্গে ঝগড়া করতে দেখেননি তারা। লেখাপড়ায় খুব ভালো তিনি। জোবায়ের খুন করতে পারেন এমনটা বিশ্বাস করতে পারছেন না তারা।
এদিকে মঙ্গলবার রাতেই গ্রেপ্তার জোবায়েরকে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট ও জেলা গোয়েন্দা পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করে। নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) আমির খসরু বলেন, জুবায়েরকে আমরা ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। তিনি স্বীকার করেছেন- তার নিজের চলার জন্য টাকার দরকার। এ কারণে বড় বাড়িটি তিনি টার্গেট করেন। ছয়তলা ভবনের একটি ফ্ল্যাটে কলবেল বাজিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ওই ফ্ল্যাটের কেউ দরজা খোলেননি। তখন পাশের রাম প্রসাদ চক্রবর্তীর ফ্ল্যাটে কলবেল চাপেন তিনি। ওই ফ্ল্যাটের দরজা খুললে ভেতরে ঢুকে রুমা চক্রবর্তীর গলা চেপে ধরেন জোবায়ের। এ সময় রুমার গলার মালা তিনি ছিনিয়ে নেন। এরপর ছুরি মেরে রুমাকে হত্যা করেন। রুমার মেয়ে অন্তঃসত্ত্বা ঋতু চক্রবর্তী এগিয়ে এলে তাকেও ছুরি মেরে হত্যা করেন।
মামলার এজাহারে যা আছে
রাম প্রসাদ ‘মেসার্স ইসলাম ট্রেডার্সে’ চাকরি করেন। মঙ্গলবার দুপুর আড়াইটায় বাড়ির মালিকের ভাগনে জানান- তাদের ফ্ল্যাট যে ভবনে, সেটির নিচে অনেক লোক জড়ো হয়েছেন। তিনি গিয়ে দেখেন, ভবনের ফটক বাইরে থেকে তালা দেওয়া। ভেতর থেকে তার ছেলে হৃদয়ের স্ত্রী শিলা কান্নাকাটি করছে। শিলা জানান- তাদের ফ্ল্যাটে ঢুকে এক যুবক রুমা ও ঋতুকে ছুরি দিয়ে এলোপাতাড়ি কুপিয়েছে। শিলাকে হত্যার জন্য রান্নাঘরে বটি হাতে নেন হামলাকারী। তবে শিলা কৌশলে সেই বটি ছিনিয়ে নিয়ে ফ্ল্যাট থেকে বের হয়ে নিচে নামেন।
হামলাকারী যুবক তাকে ধাওয়া করে নিচে নামে, তবে ততক্ষণে ভবনের অন্য লোকজন এসব টের পেয়ে বাইরে থেকে ফটক আটকে দেয়। ওই যুবক ফের ছয় তলার ফ্ল্যাটটিতে ফিরে যায়। শিলার থেকে শুনে তিনি স্ত্রী রুমার মোবাইল ফোনে কল করলে তা রিসিভ করেন ওই যুবক। টাকা-গয়না কোথায় আছে জানতে চান। পরিচয় জানতে চাইলে তিনি ফোন কেটে দেন। ততক্ষণে পুলিশ সেখানে উপস্থিত হয়। পুলিশসহ তিনি ফ্ল্যাটে গিয়ে ওই যুবককে আটক করেন। উদ্ধার করেন মরদেহ।
রাজু আহমেদ/আরএআর