ফ্ল্যাটে ঢুকে মা ও অন্তঃসত্ত্বা মেয়েকে হত্যা করেন জুবায়ের
নারায়ণগঞ্জের নিতাইগঞ্জের ডাইলপট্টি এলাকায় মা ও অন্তঃসত্ত্বা মেয়েকে ছুরিকাঘাতে হত্যার ঘটনায় জোবায়ের (৩৫) নামে এক যুবককে আটক করেছে পুলিশ। মঙ্গলবার (০১ মার্চ) বিকেল ৩টার দিকে রক্তমাখা ছুরিসহ ঘটনাস্থল থেকে তাকে আটক করা হয়। যে ফ্ল্যাটে হত্যাকাণ্ড ঘটে সেটির একটি কক্ষের দরজা ভেঙে পুলিশ তাকে আটক করে। আটককৃত জোবায়ের নগরীর পাইকপাড়া এলাকার বাসিন্দা।
এর আগে ওই ফ্ল্যাটে হত্যার শিকার হন এক অন্তঃসত্ত্বা নারী ও তার মা। নিহতরা হলেন- রিতু চক্রবর্তী (২২) ও তার মা রুমা চক্রবর্তী। রিতু চক্রবর্তী সাড়ে ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন বলে জানিয়েছেন তার বাবা রাম প্রসাদ চক্রবর্তী।
বিজ্ঞাপন
ঘটনাস্থলে গিয়ে জানা গেছে, নিহত রুমার স্বামী রাম প্রাসাদ চক্রবর্তী স্থানীয় একটি পাইকারি ডালের আড়তে ম্যানেজারের চাকরি করেন। কর্মস্থলের ঠিক পাশেই স্বপন দাসের ৭ তলা বাড়ির ৬ষ্ঠ তলার একটি ফ্ল্যাটে তিনি ভাড়া থাকেন। মঙ্গলবার বিকেল পৌনে ৩টার দিকে হত্যাকারী জোবায়ের ভবনটিতে প্রবেশ করেন।
৬ষ্ঠ তলার অপর পাশের ফ্ল্যাটের বাসিন্দা সন্ধ্যা নন্দী জানান, পৌনে ৩টার দিকে আমার ফ্ল্যাটের দরজায় সজোরে ধাক্কার শব্দ শুনে আমি দরজার ফুটো (ম্যাজিক আই) দিয়ে দেখার চেষ্টা করি। এ সময় বাইরে কাউকেই দেখা যাচ্ছিল না। পরিচয় জানতে চাইলে দরজার অপরপ্রান্ত থেকে কোনো শব্দই করছিলেন না কেউ। আমি তখন বুঝতে পারি কেউ দরজার ফুটো আঙুল দিয়ে ঢেকে রেখেছে। সন্দেহ হলে আমি আর দরজা খুলিনি। এর মিনিট খানেক পরেই শুনতে পাই পাশের ফ্ল্যাটে টোকা দিচ্ছে কেউ। আমি পুনরায় ওই ফুটো দিয়ে দেখি লোকটাকে।
দেখলাম রুমা বৌদি দরজা খুলতেই তার গলা চেপে ধরে ভেতরে নিয়ে যায় লোকটা। বিষয়টি আমার ছেলে হৃদয় নন্দীকে বললে সেও তখন ভয়ে ওই ফুটো দিয়ে দেখার চেষ্টা করছিল। ১০ মিনিট পরেই আমরা চিৎকার ও গোঙানির শব্দ শুনে বের হই এবং রুমা বৌদির ফ্ল্যাটের দরজায় ধাক্কা দিতে থাকি। কিছুক্ষণ পর দরজার সামান্য অংশ খুললে জোবায়ের নামে লোকটিকে আমরা রক্তমাখা অবস্থায় হাতে চাকুসহ দেখতে পাই। এ সময় সে আমার ছেলেকে বলে ‘এখান থেকে যা না হলে তোকেও মেরে ফেলব’। সঙ্গে সঙ্গে আমরা নিজেদের ফ্ল্যাটে ঢুকে পড়ি এবং আমার ছেলে ৯৯৯ এ ফোন দিয়ে ঘটনাটি জানায়। এরপর বারান্দা দিয়ে নিচের লোকজনকে চিৎকার করে বিষয়টি বলার চেষ্টা করে এবং নিচের মূল ফটক বন্ধ করে দিতে বলে।
স্থানীয় খোকন নামে এক যুবক বলেন, নিচের তলায় রক্তমাখা বটি নিয়ে এক নারীকে দেখে পাশের দোকানের এক কর্মচারী ওই নারীকে নিচেই আটকে রাখে। ততক্ষণে মূল ফটকে আমরা তালা লাগিয়ে দিয়ে পুলিশের অপেক্ষা করতে থাকি। কিছুক্ষণ পর সদর থানার ওসি শাহ জামানসহ আমরা ওই নারীকে নিচে একজন পুলিশসহ বসিয়ে রেখে উপরে যাই। তখন ৬ষ্ঠ তলার ওই ফ্ল্যাটটি বন্ধ ছিল ভেতর থেকে। আমরা দরজা ভেঙে প্রবেশ করলে সেখানে নিহতদের মরদেহ মেঝেতে পরে থাকতে দেখি। এরপর ফ্ল্যাটের একটি রুমের দরজা লাগানো দেখে সেটি ভেঙে জোবায়ের নামে ওই যুবককে হাতে গ্লাভস পরিহিত অবস্থায় রক্তাক্ত ছুরিসহ আটক করে পুলিশ।
নিহত রুমা চক্রবর্তীর স্বামী রাম প্রসাদ চক্রবর্তী বলেন, আমার সঙ্গে কারো শত্রুতা নেই বা ছিলও না। কেন এই হত্যাকাণ্ড ঘটল আমি জানি না। আমি খবর পেয়ে এসে দেখি আমার বাড়ির নিচে ও ফ্ল্যাটে পুলিশ।
তিনি বলেন, আমার এক ছেলে ও এক মেয়ে। ছেলে হৃদয় চক্রবর্তী কয়েক মাস আগে মুসলিম হয়েছে এবং ফারজানা নামে একটি মেয়েকে বিয়ে করেছে। আমরা প্রথমে বিষয়টি মেনে নেইনি। কিন্তু পরে মেনে নিয়েছি। গত কয়েক দিন থেকে পুত্রবধূ ফারজানা এই ফ্ল্যাটেই থাকছে। আমার মেয়ে অন্তঃসত্ত্বা থাকায় সে আমার বাড়িতে এসেছিল। তার স্বামী শ্যামল চক্রবর্তী চট্টগ্রামে পুরোনো গাড়ির ব্যবসা করে।
রাম প্রসাদ চক্রবর্তী বলেন, বাড়ির সামনে পুলিশ ও এলাকাবাসীর জটলা দেখে স্ত্রীর মোবাইল ফোনে (নিহত রুমা চক্রবর্তী) ৩/৪বার ফোন দিলে অপরপ্রান্ত থেকে ঘাতক জোবায়ের বারবার টাকা ও স্বর্ণালংকার কোথায় আছে তা জানতে চাচ্ছিল। টাকা ও স্বর্ণালংকার দিলে খুন করবে না বলেও জানাচ্ছিল জোবায়ের। আমি বলেছিলাম- তোমাকে টাকা দেব ওদের মেরো না। কিন্তু এর আগেই মনে হয় যা ঘটবার ঘটে গেছে।
নিহত রুমা চক্রবর্তীর পুত্রবধূ ফারজানা বলেন, জোবায়ের ফ্ল্যাটে প্রবেশ করেই প্রথমে আমার শাশুড়ির পেটে ছুরিকাঘাত করে। এরপর রিতু চক্রবর্তী চিৎকার করলে তার হাতে চুরিকাঘাত করে। আমি বাচঁতে পাশের রুমে প্রবেশ করে ভেতর থেকে দরজা লাগিয়ে দেই। পরে সে দরজা ভেঙে ফেলতে উদ্যত হয় এবং দরজা না খুললে আমাকে মেরে ফেলবে বলে হুমকি দেয়। আমি দরজা খুলতেই সে বটি দিয়ে আমাকে কোপ দেয়। কিন্তু তার হাতে গ্লাভস থাকায় সেটি পিছলে পড়ে যায়। আমি ওই বটি নিয়েই মেইন দরজা খুলে নিচে দৌড় দেই। এ সময় জোবায়েরও পেছন পেছন নিচে নামে। কিন্তু আমি বলি সামনে আসলে কোপ দেব। তখন সে আবারো ওপরে উঠে যায়।
ফারজানা বলেন, আমি বটি নিয়ে দৌড় না দিলে সে ওই বটি দিয়ে আমাকে কোপ দিতো। আমাকে রক্তমাখা বটি নিয়ে নিচে দেখে লোকজন সন্দেহ করে আমাকে আটকে রেখেছিল।
নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ শাহ জামান বলেন, খবর পেয়ে আমরা দ্রুত ঘটনাস্থলে এসে একটি রুমের দরজা ভেঙে জোবায়েরকে আটক করি। নিহতদের শরীরে ছুরির আঘাতের অনেক চিহ্ন রয়েছে। নিহত অন্তঃসত্ত্বা রিতুর শরীরের তিনটি স্থানে ছুরি দিয়ে আঘাত করা হয়েছে এবং দুটি স্থানে ছুরি ডুকে ছিল। সেখানে আমরা ছুরির ভেঙে যাওয়া বাট পড়ে থাকতে দেখেছি। নিহত রুমা চক্রবর্তীর পেটে পুরো ছুরি ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে।
ওসি বলেন, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে ডাকাতির উদ্দেশ্যেই জোবায়ের সেখানে গিয়েছিল। তার বাবা আলাউদ্দিন মিয়া একজন ব্যবসায়ী। তিনি আমাদের জানিয়েছেন- তার ছেলে জোবায়েরের মানসিক সমস্যা রয়েছে। তবে প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছি, নিহত রুমা চক্রবর্তীর ছেলে হৃদয় সম্প্রতি হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে মুসলমান হয় এবং ফারজানাকে বিয়ে করেন। এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ওই ঘটনার কোনো সম্পৃক্ততা আছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
রাজু আহমেদ/আরএআর