টং দোকানে রঙের ছোঁয়া, বদলে গেছে টিএসসি
ক্লাস শেষে শিক্ষার্থীদের আড্ডা, রাজনৈতিক দলের কর্মীদের স্লোগান কিংবা দর্শনার্থীদের পদচারণায় সকাল থেকে রাত পর্যন্ত মুখরিত থাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি চত্বর। টিএসসির এ কোলাহলের অন্যতম অনুষঙ্গ সেখানকার ছোট ছোট চায়ের দোকান।
চায়ের কাপে চুমুক দিদে দিতে এখানে চলে রাজনীতি, অর্থনীতি, সাহিত্য-সংস্কৃতি ও সমাজ জীবনের আলাপ। সম্প্রতি টিএসসির চায়ের দোকানগুলো সেজেছে ভিন্ন আঙ্গিকে। নানা রঙে রিকশাচিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে দোকানগুলোর ছোট ছোট দেয়াল, বেঞ্চ, টেবিল এমনকি পাশের ডাস্টবিনেও।
বিজ্ঞাপন
রিকশাচিত্র আর চায়ের দোকান- ভিন্ন দুই ধারণাকে এক সুতোয় গেঁথেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই কয়েকজন শিক্ষার্থী। তারা সবাই ২০১৬-১৭ সেশনের। মূলত এ চিন্তা আসে শিরিন আক্তার শিলার মাথায়। তিনি পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী।
ঠাকুরগাঁওয়ের মেয়ে শিলার আরেকটি পরিচয় হলো, তিনি মিস ইউনিভার্স বাংলাদেশ ২০১৯ এবং ফেস অব বাংলাদেশ ২০১৯ বিজয়ী। সঙ্গী শেরপুরের মেয়ে জেরিন সিন্থী। তিনি চারুকলা অনুষদের অঙ্কন ও চিত্রায়ন বিভাগের শিক্ষার্থী। পাশাপাশি তিনি ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার উপ-গ্রন্থনা ও প্রকাশনা সম্পাদকও। আরও আছেন ময়মনসিংহের ছেলে সীমান্ত সাহা; তিনি পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী।
টিএসসির সবকটি ভাসমান চায়ের দোকানের টং, টেবিল, টুল, ডাস্টবিন, এমনকি কেটলিও তারা সাজিয়েছেন সুনিপুণ শৈল্পিক ঢঙে। রিকশা পেইন্টে টিএসসিজুড়ে অনিন্দ্য সুন্দর এক আবহ তৈরি হয়েছে। তাদের হাতের ছোঁয়ায় রং পেয়েছে পূর্ণতা। ফিতা দিয়ে সাজানো হয়েছে চত্বরের গাছগুলোকেও।
ব্যতিক্রমী এ শিল্পকর্ম চা বিক্রেতা থেকে শুরু করে শিক্ষার্থী ও দর্শনার্থী সবার প্রশংসা কুড়িয়েছে। ‘স্বপন মামা’ নামে খ্যাত টিএসসির একজন চা বিক্রেতার সঙ্গে আলাপ হয় ঢাকা পোস্টের। তিনি বলেন, আমার দোকান আমি নিজেই চিনতে পারছি না। দেখতে ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে আগের চেয়ে কাস্টমার বেশি আসছে। দুদিন ধরে না ঘুমিয়ে তারা কাজ করেছেন। আল্লাহ তাদের ভালো করুক।
টিএসসিতে আসা দর্শন বিভাগের শিক্ষার্থী তাসনিয়া সুলতানা বলেন, রিকশাচিত্রে টিএসসি ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। মনে হচ্ছে পুরো দৃশ্যপটই বদলে গেছে। রিকশা আর্টের ঐতিহ্য ধরে রাখতে এটি ভালো উদ্যোগ। টিএসসিতে প্রতিদিন অনেকে ঘুরতে আসেন। তারাও এ সম্পর্কে আরও জানতে পারবেন।
ব্যতিক্রমী এ উদ্যোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে শিরিন আক্তার শিলা বলেন, মিস ইউনিভার্সের মঞ্চে আমি লাল জামদানি শাড়ি এবং রিকশাহুড ব্যবহার করেছিলাম। সেখান থেকেই রিকশার প্রতি মায়া-মমতা, রিকশা আর্ট, পেইন্টিং এসবের প্রতি ভালো লাগা কাজ করে। বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী হলেও আর্ট-কালচারের প্রতি আমার বিশাল একটা দুর্বলতা কাজ করে।
তিনি বলেন, স্ক্রিন প্রিন্টিং এবং এ জাতীয় প্রযুক্তির কারণে হ্যান্ড পেইন্ট হারিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে রিকশাকেও লাল-হলুদ বানিয়ে ফেলা হচ্ছে। মূল যে সত্তাটি ছিল, তা আর থাকছে না। সেসবকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য আমরা এ উদ্যোগ নিয়েছি।
চায়ের টং দোকানকেই কেন বেছে নেওয়া- জানতে চাইলে তিনি বলেন, এমন কোনো রাস্তা নেই যেখানে চায়ের দোকান নেই। আমরা যদি পশ্চিম-ইউরোপীয় দেশগুলো কিংবা ভারতের রাজস্থানের কথা চিন্তা করি, তারা তাদের রাস্তা-বাড়িঘর নিজেদের সংস্কৃতি দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছে। চায়ের টং সবখানেই পাওয়া যায়। এসব ভেবেই আসলে এই চিন্তা মাথায় আসে।
প্রাথমিকভাবে টিএসসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই শুরুর পরিকল্পনা ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, টিএসসিকে অনেকে ঢাকার প্রাণকেন্দ্র বলে থাকেন। সাংস্কৃতিক ও স্বাধীনতা সংগ্রামসহ অতীতের নানা আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ এখান থেকেই শুরু। তাই, আমরা যদি টিএসসির রং পরিবর্তন করতে পারি, তবে আমরা আমাদের সমাজের রং পরিবর্তন করতে পারব।
এইচআর/আরএইচ