বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে সবগুলো ক্লাসে উপস্থিত থাকা সম্ভব? কেউ চমকে বলবে, এটা অসম্ভব। মাথা নেড়ে হয়তো কেউ উল্টো প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে বলবে; এটা কোনো কথা! আবার কারো মুখের হাসিতেই প্রকাশ পাবে তার উত্তর। তবে এমন অবাস্তবকে সম্ভব করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) জিন প্রকৌশল ও জৈবপ্রযুক্তি বিভাগের শিক্ষার্থী আবদুল্লাহ আল-মামুন। 

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের পাঁচ বছরে একটি ক্লাসও মিস হয়নি তার। শুধু উপস্থিতিই নয় স্নাতকের ফলাফলে বিভাগের সেরা তিনজনের একজন তিনি। পেয়েছেন শিক্ষামন্ত্রণালয় থেকে বৃত্তিও। 

কীভাবে সম্ভব শতভাগ উপস্থিতি এমন প্রশ্নে আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেন, আসলেই এই শতভাগ উপস্থিতি নিয়ে অসংখ্যবার অনেকের কাছে বলতে হয়েছে। মাঝেমধ্যে আমার নিজেরই অবাক লাগে। নিজেই প্রশ্ন করি কীভাবে সম্ভব হলো! যখন ভর্তি হলাম সেদিন ওরিয়েন্টেশন ক্লাস করে আমার খুবই ভালো লেগেছিল। বিভাগের শিক্ষকমণ্ডলীর কথা শুনে অনুপ্রাণিত হয়েছি। উনারা বিশ্বের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে এসেছেন। এত এত গবেষণা করেছেন। উনাদের অভিজ্ঞতাগুলো আমাদের মাঝে শেয়ার করবেন আমি সেটা মিস করতে চাইনি, তাই প্রথম দিন থেকেই মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলাম আমি সবগুলো ক্লাসই করব। 

নিয়মিত ক্লাস আর বন্ধুদের সঙ্গে মেলামেশায় আত্মীক টান চলে আসে বিভাগের প্রতি। এর ফলে অন্য কোথাও মন টিকতো না মামুনের। 

বললেন, প্রথম বর্ষ শেষে নিজের নামের শেষে ১০০% লেখাটা দেখে খুবই ভালো লাগল। খুবই আনন্দিত হয়েছিলাম। সবাই অভিনন্দন জানাচ্ছিল। স্যাররাও প্রশংসা করেছিলেন। তারপর দ্বিতীয় বর্ষে ক্লাস প্রতিনিধি (সি.আর) নির্বাচিত হওয়ার পর দায়িত্ব আরো বেড়ে যায়। সি.আর হিসেবে যদি নিয়মিত ক্লাসে না আসি ব্যাপারটা কেমন দেখায় না! বাকি বর্ষগুলোতেও সেটা ধরে রাখার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে ক্লাস করতে থাকলাম। পর্যায়ক্রমে ৩য় ও ৪র্থ বর্ষেও শতভাগ উপস্থিতি। তারপর তারই ধারাবাহিকতায় মাস্টার্সেও সবগুলো ক্লাস করি। কোভিড পরিস্থিতিতে যখন অনলাইনে ক্লাস হচ্ছিল তখনও সবগুলো ক্লাসেই উপস্থিত ছিলাম। 

আবদুল্লাহ আল-মামুনের জন্ম ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলায়। ব্যবসায়ী বাবা আর গৃহিণী মায়ের সন্তান মামুন ৪ ভাই-বোনের মধ্যে সবার বড়। কসবা সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়ে উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজে। সেখান থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। গত বছরের ডিসেম্বর মাসে শেষ হয়েছে তার স্নাতকোত্তর পরীক্ষা।

ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনার প্রতি ভীষণ অনুরাগী মামুন। শিক্ষক এবং সহপাঠীদের কাছেও ছিলেন প্রিয়। সব ক্লাসে প্রথম হতেন তিনি। তবে অসুস্থতার কারণে চতুর্থ শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষায় প্রথম হতে পারেননি। নতুনভাবে নিজেকে তৈরি করে সমাপনী পরীক্ষায় গোল্ডেন জিপিএ ফাইভ সেইসঙ্গে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি অর্জন করেন। অষ্টম শ্রেণিতেও পান বৃত্তি। 

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলে তার অর্জনের ঝুলি আরও দীর্ঘ হয়। স্নাতকে ভালো ফলাফলের জন্য শিক্ষামন্ত্রণালয় থেকে বৃত্তি, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে বৃত্তি এবং স্নাতকোত্তর থিসিস গবেষণার জন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় থেকে ফেলোশিপ পান মামুন।

সবসময়ই পড়াশোনায় পড়ে থাকতেন? না। পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলা এবং সৃজনশীল নানা কাজেও সমানভাবে নিজের উপস্থিতি জানান দিয়েছেন মামুন। তৃতীয় শ্রেণি থেকে স্কাউটের সঙ্গে যুক্ত হন। রচনা, উপস্থিত বক্তৃতা, বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ ছাড়াও গান গেয়ে জিতেছেন বহু পুরস্কার। 

বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত ক্লাস করলে সৃজনশীল কাজের সঙ্গে  জড়িত থাকা যাবে না সেটা ঠিক নয় বলে মন্তব্য করেন মামুন। বলেন, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে নিয়মিত ক্লাস করেও বিভিন্ন কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলাম। অনেক সার্টিফিকেট এবং পুরস্কারও জিতেছি।  ফটোগ্রাফি প্রতিযোগিতা, বিজনেস আইডিয়া কম্পিটিশন, পোস্টার প্রেজেন্টেশন, সেমিনার ওয়ার্কশপ, অনলাইন কোর্স ইত্যাদিতে অংশগ্রহণ করেছি। এক্ষেত্রে সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে টাইম ম্যানেজমেন্ট। সময়ের যথাযথ মূল্যায়ন করতে জানলে নিয়মিত ক্লাস করার পাশাপাশি সৃজনশীল কাজের মাধ্যমে নিজেকে এবং সিভিকেও উন্নত করা যায়।

ভালো ফলাফলের বিষয়ে মামুন বলেন, ভালো ফলাফলের জন্য যেটা আমি সবসময় করেছি সেটা হচ্ছে নিয়মিত পড়াশোনা। প্রতিদিন অল্প অল্প করে হলেও পড়া। একদিন খুব বেশি পড়ে বাকি কয়েকদিন অবসরে কাটালে সেটা ফলপ্রসূ হয় না। নিয়মিত ক্লাস করে পড়াগুলো গুছিয়ে রাখতাম। 

স্বপ্নের কথা জানালেন মামুন। একজন ভালো গবেষক হওয়ার স্বপ্ন তো আছেই। তবে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করার স্বপ্ন আমাকে প্রতিনিয়ত নাড়া দেয়। আমি চাই আমার মৌলিক গবেষণা বিশ্বের সকল মানুষের কল্যাণে আসবে। বিশ্বের দরবারে আমার দেশকে গবেষণার মাধ্যমে তুলে ধরতে চাই।

জিন প্রকৌশল ও জৈবপ্রযুক্তি বিভাগের সভাপতি ড. নাজনীন নাহার ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, মামুন অত্যন্ত মেধাবী এবং ভালো ছেলে। শুরু থেকেই সে নিয়মিত ক্লাস করছে। কোভিড পরিস্থিতিতে অনলাইন ক্লাসেও আমরা নিয়মিত উপস্থিতি কাউন্ট করছি। সেখানেও মামুনকে নিয়মিত পেয়েছি। এখন আমার সঙ্গেই সে একটা গবেষণা প্রজেক্টে কাজ করছে। মামুনের বড় স্বপ্ন রয়েছে। আমি আশাবাদী সে তার লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে। তার জন্য অনেক শুভ কামনা। 

এমএএস