ঢাকা কলেজে পড়ে তারা একই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক
একই প্রতিষ্ঠানে একই বিভাগে পড়াশোনার পর সেই বিভাগেরই শিক্ষক হয়েছেন এমন চিত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে খুবই স্বাভাবিক। তবে উচ্চশিক্ষায় সরকারি কলেজগুলোতে এমন সৌভাগ্যের দেখা পান খুব কম ব্যক্তি। বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভাগের সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়া শিক্ষার্থীরা সহজ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সরাসরি প্রভাষক হিসেবে যোগ দেওয়ার সুযোগ পেলেও কলেজগুলোতে নিয়োগের জন্য শুধুমাত্র পরীক্ষার ফল নয়, বরং বিসিএস নামক সোনার হরিণ শিকার করতে হয়।
এক সময় যে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী হয়ে শিক্ষকদের সহচার্যে পড়াশোনা করেছেন, সেই প্রতিষ্ঠানে আবার শিক্ষক হয়ে ফিরে আসার অনুভূতি কেমন? দেশের অন্যতম বিদ্যাপীঠ ঢাকা কলেজে বর্তমানে শিক্ষক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন ঢাকা কলেজেরই সাবেক পাঁচ জন শিক্ষার্থী। তারা এ কলেজ থেকেই স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর পাস করে বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আবার ফিরে এসেছেন চেনা ক্যাম্পাসে। তাদের সেই অনুভূতির কথা জানাচ্ছেন ঢাকা পোস্টের ঢাকা কলেজ প্রতিনিধি রাকিবুল হাসান তামিম।
বিজ্ঞাপন
ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী হিসেবে আমি গর্বিত
ঢাকা কলেজে ২০০২-০৩ শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থী হিসেবে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হই। শহরের প্রাণকেন্দ্র হওয়ায় কলেজে যাতায়াত ছিল নিয়মিত। ক্লাস-পরীক্ষার পাশাপাশি বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে জমিয়ে আড্ডা গানেই কেটেছে সবটা সময়। তবে কখনও এরকমটা ভাবিনি যে কর্মজীবনেও ঢাকা কলেজেই আবার ফিরে আসতে পারব। এ অনুভূতি বলে বোঝানোর মতো নয়। এটি আমার পরম পাওয়া। বলতে হয় তখন অন্যরকম একটি টানে ঢাকা কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম। এখনও উপমহাদেশের প্রথম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। স্নাতকোত্তর শেষ করে ৩১তম বিসিএসে উত্তীর্ণ হই। ফিরে আসি প্রাণের ক্যাম্পাস ঢাকা কলেজে। যে বিভাগে পড়েছি, সে বিভাগেই এখন পড়াচ্ছি। এ অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়।
মো. মুশফিকুর রহমান
প্রভাষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান
ঢাকা কলেজ, ঢাকা
৩১তম বিসিএস
রাগ করে বিজ্ঞান বিভাগ ছেড়ে মানবিক বিভাগে ভর্তি হই
উচ্চমাধ্যমিকের পাঠ চুকিয়ে ঢাকায় আসি উচ্চশিক্ষা নেওয়ার জন্য। আমি বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলাম। মেডিকেল কলেজে পড়ার প্রচন্ড আগ্রহ নিয়ে প্রস্তুতি নিলেও দুর্ভাগ্যবশত মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ পাইনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও সুযোগ হয়নি ভর্তির। পরে সুযোগ হলো শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু ঢাকার বাইরে যাওয়ার ইচ্ছা আমার ছিল না। তাই সিদ্ধান্ত নিই ঢাকার মধ্যেই ভালো একটি কলেজে ভর্তি হব। সে অনুযায়ী তৎকালীন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ঢাকা কলেজে স্নাতক ২০০৩-০৪ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হলাম। একপ্রকার রাগ করেই বিজ্ঞান বিভাগ ছেড়ে মানবিকের অর্থনীতি বিষয়ে ভর্তি হই। শিক্ষকদের আন্তরিকতা, সহযোগিতা এবং আমার চেষ্টায় খুব অল্প সময়ের মধ্যেই নিজেকে গুছিয়ে নিলাম। পরবর্তীতে স্নাতকোত্তর শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে ২০১১ সালের জুলাই মাসে পুলিশের উপ-পরিদর্শক হিসেবে চাকরিতে যোগ দেই। চাকরিরত অবস্থায়ই ২০১২ সালের জুন মাসে বিসিএস প্রিলিতে অংশ নিই এবং পরবর্তীতে লিখিত এবং ভাইভা পরীক্ষা দিয়ে ২০১৪ সালের ৭ আগস্ট ৩৩তম বিসিএসে সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তা হিসেবে যুক্ত হই। আমি নিজেকে খুবই সৌভাগ্যবান মনে করি। কেননা, ঢাকা কলেজে পড়ে আবার ঢাকা কলেজেই শিক্ষকতা করার সুযোগ পেয়েছি। অনুভূতি বলে বোঝানোর মতো নয়। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো যাদের শিক্ষক হিসেবে পেয়েছি এ বিভাগে আসার পর তাদের সহকর্মী হিসেবে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছি। এ ঐতিহ্যবাহী কলেজের শিক্ষার্থী এবং শিক্ষক দুটো হওয়ার সৌভাগ্যই আমার হয়েছে।
মো. মাহমুদুল হাসান
প্রভাষক, অর্থনীতি
ঢাকা কলেজ, ঢাকা
৩৩তম বিসিএস
ঢাকার বাইরে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষাও দেইনি
আমি ২০০৪-০৫ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা কলেজে রসায়ন বিভাগে ভর্তি হই। অবশ্য আমার ইচ্ছা ছিল মেডিকেলে ভর্তি হওয়ার। তবে সরকারি মেডিকেলে সুযোগ পাইনি। বেসরকারি মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ থাকলেও মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হিসেবে তা সম্ভব হয়নি। দ্বিতীয় পছন্দ ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু সেখানেও ক ও ঘ ইউনিটে সিরিয়াল পেছনে থাকায় ভালো সাবজেক্ট পাব না- এমন আশঙ্কায় ঢাকা কলেজেই ভর্তি হওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। তাছাড়া ঢাকার বাইরে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি ভর্তি পরীক্ষাও দেইনি। মূলত ঢাকা কলেজের ভালোবাসায় প্রথম থেকেই আবদ্ধ ছিলাম। ঢাকা কলেজে পড়াশোনা করেই স্নাতকে বাংলাদেশে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েছি।
শুধু তাই নয়, আমি রেকর্ডসংখ্যক নম্বর পেয়েছি। যা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ছিল। স্নাতকোত্তরেও আমি বাংলাদেশে ফার্স্ট ক্লাস সেকেন্ড হলাম। মাস্টার্সের রেজাল্ট হওয়ার আগেই জনতা ব্যাংকে সিনিয়র অফিসার পদে চাকরি পাই। সেখানে চাকরিরত অবস্থাতেই পরবর্তীতে বিসিএস শিক্ষায় যোগ দেই। দুই বছর অন্য কলেজে চাকরির পর আবারও আপন ঠিকানায় ফিরে আসতে পেরেছি। আসলে নিজের প্রতিষ্ঠানে নিজেই আবার শিক্ষক হয়ে ফিরে আসার অনুভূতিটা কখনো বলে বোঝানো যাবে না। আমি গর্বিত আমি ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী, আমি গর্বিত আমি ঢাকা কলেজের শিক্ষক।
ত্রিনাথ সিংহ
প্রভাষক, রসায়ন
ঢাকা কলেজ, ঢাকা
৩৩তম বিসিএস
ঢাকা কলেজ আমার প্রাণের স্পন্দন
আমি ঢাকা কলেজের ভালোবাসায় সিক্ত। কেননা, আমি এ প্রতিষ্ঠানের আবাসিক শিক্ষার্থী ছিলাম। দক্ষিণায়ন ছাত্রাবাসের ৩০৫ নম্বর রুমে থাকতাম। দীর্ঘসময় ধরে ঢাকা কলেজ আমার চিন্তা চেতনায় মিশে আছে। আমরা যখন ভর্তি হই তখন জগন্নাথ কলেজ ছিল। আমি জগন্নাথ কলেজ এবং ঢাকা কলেজ দুটোই ঘুরে ঢাকা কলেজে ভর্তির সিদ্ধান্ত নিই এবং ঢাকা কলেজের ইতিহাস, ঐতিহ্য, অবস্থান পড়াশোনা সবকিছু দেখেশুনেই ভর্তি হয়ে যাই। আমি প্রথম বর্ষ থেকে আবাসিক শিক্ষার্থী ছিলাম। এ ক্যাম্পাসের পুকুরপাড়, মাঠ-ঘাট সবকিছুই আমার কাছে অনেক বেশি চেনা। যখন ছাত্রাবাসে থাকতাম তখন বড় ভাইদের পড়াশোনা দেখে বিসিএসের জন্য উদ্বুদ্ধ হই। ওই সময়ে ছাত্রাবাস থেকেই বিসিএস পুলিশ, প্রশাসনসহ বিভিন্ন জায়গায় বড় ভাইরা নিজের জায়গা করে নিয়েছিলেন। তাদের দেখেই অনুপ্রাণিত হয়ে বিসিএসের জন্য পড়াশোনা করে আজকের এ অবস্থায় আছি। এখন আমি শেখ কামাল ছাত্রাবাসের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছি। আসলে এমন অনুভূতি, যা বলে প্রকাশ করার মতো নয়। এ প্রতিষ্ঠানে পড়েছি, এ প্রতিষ্ঠানে আবাসিক ছাত্র ছিলাম আবার এ প্রতিষ্ঠানেই শিক্ষকতা করছি এবং এখানকার ছাত্রাবাসের তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব পালন করছি। এটি আমার পরম পাওয়া।
মো. রফিকুল ইসলাম
প্রভাষক, ব্যবস্থাপনা বিভাগ
ঢাকা কলেজ, ঢাকা
৩৩তম বিসিএস
আশাহত হয়ে ঢাকা কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম
আমি উচ্চ মাধ্যমিকে নটরডেম কলেজের শিক্ষার্থী ছিলাম। কলেজের ছয় বন্ধু মিলে আমাদের একটি গ্রুপ ছিল, যাদের তীব্র স্বপ্ন ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার। প্রস্তুতিও অনেক ভালো থাকায় ভর্তির ব্যাপারে প্রচন্ড আত্মবিশ্বাসী ছিলাম। কিন্তু আমার পাঁচ বন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেলেও আমি বাদ পড়ে যাই। ফলে বিভিন্ন কারণে আমার একটি সেশন পিছিয়ে পড়তে হয়। এরপর চিন্তা করলাম একটি ভালো অবস্থানে যেতে হবে এবং আমার সে সুযোগ রয়েছে। পরের বছর আমি ঢাকা কলেজে ভর্তি হই এবং পড়াশোনায় অন্যভাবে মনোনিবেশ করি। শিক্ষকদের সহযোগিতা এবং ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় একপর্যায়ে আমিও সফলতার দেখা পাই। আমি ৩৪তম বিসিএস-এ সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের উত্তীর্ণ হই। চাকরিজীবনে আবারও ঢাকা কলেজে ফিরে আসার সুযোগ হয়েছে। যে কলেজে পড়াশোনা করেছি, সেই কলেজেই আবার ফিরে এসেছি এটি ভাগ্যের বিষয়। আমি আশাহত হয়ে ঢাকা কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম কিন্তু ঢাকা কলেজ থেকেই সফলতার দেখা পেয়েছি।
মো. সামাদ খান
প্রভাষক, হিসাববিজ্ঞান
ঢাকা কলেজ, ঢাকা।
৩৪তম বিসিএস
আরএইচটি/এসএসএইচ