রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়
২৮ নভেম্বর পর্যন্ত সময় নিল কর্তৃপক্ষ, আন্দোলন স্থগিত
সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৪ শিক্ষার্থীর মাথার চুল কেটে দেওয়ার ঘটনায় অভিযুক্ত শিক্ষিকা ফারহানা ইয়াসমিন বাতেনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত জানাতে আগামী ২৮ নভেম্বর পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে সময় নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ওই সময় পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা আন্দোলন স্থগিত রাখবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
মঙ্গলবার (২৬ অক্টোবর) বিকেল ৪টা থেকে সাড়ে ৫টা পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপচার্য আবদুল লতিফ, রেজিস্ট্রার সোহরাব আলী ও শাহজাদপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শাহ মো. শামসুজ্জোহার হওয়া বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
বিজ্ঞাপন
বৈঠকে উপস্থিত শাহজাদপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শাহ মো. শামসুজ্জোহা ঢাকা পোস্টকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
তিনি বলেন, মঙ্গলবার (২৬ অক্টোবর) বিকেল ৪টায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত ট্রেজারার আব্দুল লতিফ এবং রেজিস্ট্রার মো. সোহরাব আলীর বৈঠক হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সুন্দর পরিবেশ ফিরিয়ে আনার স্বার্থে বৈঠকে আমি নিজেই মধ্যস্থতা করেছি এবং সেখানে উপস্থিতও ছিলাম। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিষয়টি সমাধানে আগামী ২৮ নভেম্বর পর্যন্ত সময় নিয়েছেন। শিক্ষার্থীরাও সেটা মেনে নিয়ে আন্দোলন স্থগিত রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু জাফর হোসাইন ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আগামী ২৮ নভেম্বর পর্যন্ত সময় নিয়েছে। আমরা সেই পর্যন্ত আন্দোলন স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি এবং এর মাঝে অনুষ্ঠিত সব পরীক্ষাতেও আমরা অংশগ্রহণ করব।
তিনি আরও বলেন, আমাদেরকে বলা হয়েছে যে তদন্তে এ ঘটনার সত্যতা পাওয়া গেছে। সেই শিক্ষিকার বিরুদ্ধে স্থায়ীভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য যে আইন দরকার সেটি এখনো আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে হয়নি। তাই আইন প্রণয়ন করতে সময় দরকার।
এ বিষয়ে শাহজাদপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শাহ মো. শামসুজ্জোহা ঢাকা পোস্টকে বলেন, আগামীকাল (বুধবার) বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) একটি প্রতিনিধি দল এ ঘটনা তদন্ত করতে আসবে। এটি নতুন বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ায় এখনো কিছু নিয়ম ও আইন প্রণয়ন হয়নি। তাই সেগুলোও করতে হবে।
অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি মৌখিকভাবে এটা শুনেছি। এর চেয়ে বেশি কিছু বলতে পারব না। তবে আবারও সিন্ডিকেট সভা বসবে।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপচার্য আবদুল লতিফ ও রেজিস্ট্রার সোহরাব আলীর মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করলেও তাদের সাড়া পাওয়া যায়নি।
জানা গেছে, সম্প্রতি রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও বাংলাদেশ অধ্যয়ন বিভাগের চেয়ারম্যান ফারহানা ইয়াসমিন বাতেন ক্লাস চলাকালে চুল বড় রাখায় ছাত্রদের বকাঝকা করেন। পরে গত ২৫ সেপ্টেম্বর পরীক্ষার হলের দরজার সামনে কাঁচি হাতে দাঁড়িয়ে কক্ষে ঢোকার সময় শিক্ষার্থীদের মধ্যে যাদের চুল মুঠোর মধ্যে ধরা গেছে, তাদের মাথার সামনের কিছু চুল জোর করে কেটে দেন।
২৭ সেপ্টেম্বর দুপুরে ওই বিভাগের বাংলাদেশের ইতিহাস বিষয়ে পরীক্ষা শুরুর আগে লাঞ্ছিত শিক্ষার্থী ও তাদের সহপাঠীরা এ ঘটনার প্রতিবাদে পরীক্ষা বর্জন করেন। তারা বিক্ষোভ ও মানববন্ধনের জন্য বিসিক বাসস্ট্যান্ড এলাকার রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থায়ী ক্যাম্পাস-১ এর ফটকে জমায়েত হন। এ সময় একটি পক্ষ তাদের পরীক্ষায় ফেল করিয়ে দেওয়ার ভয়ভীতি দেখিয়ে ও চাপ দিয়ে সবাইকে পরীক্ষার হলে যেতে বাধ্য করেন। পরে রাত সাড়ে ৮টার দিকে নাজমুল নামে প্রথম বর্ষের এক শিক্ষার্থী লজ্জায় ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করলে ঘটনা জানাজানি হয়।
এ ঘটনায় শিক্ষার্থীরা ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ করে আন্দোলন শুরু করলে ২৮ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় অভিযুক্ত শিক্ষিকা ফারহানা ইয়াসমিন বাতেন তার দায়িত্বে থাকা তিনটি পদ (সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও বাংলাদেশ অধ্যায়ন বিভাগের চেয়ারম্যান, সহকারী প্রক্টর ও প্রক্টরিয়াল বডির সদস্য) থেকে স্থায়ীভাবে পদত্যাগ করেন। কিন্তু তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক পদ থেকে স্থায়ীভাবে বরখাস্তের দাবিতে আমরণ অনশনসহ আন্দোলন করেন শিক্ষার্থীরা। পরে ফারহানা ইয়াসমিন বাতেনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
এ ঘটনায় (২৯ সেপ্টেম্বর) বিশ্ববিদ্যালয়ের রবীন্দ্র অধ্যায়ন বিভাগের চেয়ারম্যান লায়লা ফেরদৌস হিমেলকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিকে যত দ্রুত সম্ভব তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়।
এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীসহ অর্ধশতাধিক শিক্ষক-কর্মচারীর সঙ্গে কথা বলে। তবে অভিযুক্ত শিক্ষিকাকে দুই দফা সময় দিলেও তিনি উপস্থিত হয়ে বক্তব্য না দেওয়ায় ২১ দিন পর বৃহস্পতিবার (২১ অক্টোবর) বিকেল ৫টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মো. সোহরাব আলীর নিকট তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় কমিটি। সেখানে ওই শিক্ষিকাকে অভিযুক্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়।
পরেদিন শুক্রবার (২২ অক্টোবর) বিকেল ৪টায় রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ঢাকার ধানমন্ডিস্থ আবাসন ভবন অফিসে তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সিন্ডিকেট সভা অনুষ্ঠিত হয়। টানা তিন ঘণ্টা সভার চলার পরও কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই রাত সাড়ে ৭টার দিকে শেষ হয়। বিষয়টি শিক্ষার্থীদের জানানো হলে তারা অভিযুক্ত শিক্ষিকা ফারহানা ইয়াসমিনের স্থায়ী বহিষ্কার চেয়ে ২২ অক্টোবর রাত ৮টা থেকে দ্বিতীয় দফায় আন্দোলন ও আমরণ অনশন শুরু করেন।
অভিযুক্ত শিক্ষিকা ফারহানা ইয়াসমিন বাতেনের স্থায়ী বহিষ্কার চেয়ে চলমান আন্দোলন থেকে বক্তব্য দেওয়ার সময় রোববার (২৪ অক্টোবর) দুপুর সাড়ে ১২টা দিকে প্রকাশ্যে বিষপান করে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন শামীম হাসান (২৪) নামে এক শিক্ষার্থী। পরবর্তীতে তাকে শাহজাদপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। এরপর রোববার (২৪ অক্টোবর) বিকেল ৪টা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ও তদন্ত কমিটির প্রধানসহ ৩৩ জন শিক্ষক কর্মকর্তাকে ১১ ঘণ্টা অবরুদ্ধ করে রাখেন বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা।
শুভ কুমার ঘোষ/আরএআর