মুহসীন হলের দৃষ্টিহীন খাবার বিক্রেতা রহিম মামার আকুতি
আব্দুর রহিম, দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তিনি সবার কাছে রহিম মামা নামেই পরিচিত। তিনি হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের খাবার বিক্রেতা; বয়স ৫০ এর খানিক বেশি হবে। অন্য দশজনের মতো রহিম মামার দুচোখ স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু জন্মের দুবছরের মাথায় হঠাৎ জলবসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে ডান চোখের দৃষ্টি শক্তি হারান। বাম চোখে ঝাপসা দেখলেও আঘাত পাওয়ার কারণে এখন একেবারেই দেখতে পান না।
দৃষ্টিহীন এ মানুষটি সব প্রতিবন্ধকতা জয় করে জীবনযুদ্ধে লড়ে গেছেন। স্বাবলম্বী হয়ে প্রমাণ করে দিয়েছেন যে, শারীরিক কোনো প্রতিবন্ধকতাই জীবনে চলার পথে বাধা হতে পারে না। নিজের শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে পুঁজি করে অন্যের কাছে হাত পাতেননি তিনি, নামেননি ভিক্ষাবৃত্তিতে। বরং নিজেই নিজের ভরসা হয়ে দাঁড়িয়েছেন। অনেক চেষ্টা এবং পরিশ্রম করে পরিবারের ভরণপোষণ নিজেই করেন।
বিজ্ঞাপন
কসমেটিক আইটেম বিক্রির মাধ্যমে ঢাবি ক্যাম্পাসে তিনি ব্যবসা শুরু করেন ১৯৯৬ সালে। ফেরি করে কসমেটিক আইটেম বিক্রি করতেন তিনি। বাজার প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে রহিম মামা ২০০৮ সাল থেকে মুহসিন হলে খাবার বিক্রি শুরু করেন। বাসা থেকে খাবার বানিয়ে বক্সে করে প্রতিদিন সকালে হলে নিয়ে আসেন তিনি। বাসায় রান্নার কাজে সহযোগিতা করেন স্ত্রী সফুরা বেগম।
করোনা প্রাদুর্ভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব কার্যক্রমের পাশাপাশি হলগুলোও বন্ধ; ফলে মুহসীন হলের সেই রহিম মামাও ভালো নেই। এবার চোখের পাশাপাশি হারাতে বসেছেন নিজের পা’টাও। সবার সহযোগিতা পেতে শনিবার (২০ জুন) রাতে হাজির হন ঢাবি সাংবাদিক সমিতির কার্যালয়ে। সেখানে তিনি তুলে ধরেছেন নিজের বর্তমান অবস্থা এবং চেয়েছেন সহযোগিতা।
বর্তমান অবস্থা তুলে ধরে রহিম মামা বলেন, ২০০৮ সাল থেকে মুহসীন হলে খাবার বিক্রি করে আমার দিনকাল ভালোই কাটছিল। কিন্তু হটাৎ করে বছর দুয়েক আগে আমার ডান পায়ে ব্যথা অনুভব শুরু হয়। তারপর পরীক্ষা করে জানা যায় যে, আমার ডান পায়ের প্রধান রক্তনালী অকেজো হয়ে গেছে। পায়ে রিং লাগাতে হবে, রিং লাগালে হয়ত ব্যথাটা কমে যাবে। নতুবা যদি কোনো আঘাতজনিত কারণে পায়ে ক্ষতের সৃষ্টি হয় তাহলে পা পচে যাবে, কেটে ফেলতে হবে। এরমধ্যে আবার করোনার কারণে হল বন্ধ হয়ে যাওয়ায়, এখন আমি সম্পূর্ণ বেকার। আয় রোজগার নেই।
তিনি আরও বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি নিরাপদে খাবার বিক্রি করেছি। চাইলে আমি অন্য জায়গায় এভাবে খাবার বিক্রি করতে পারি না। তাই খুব কষ্টে আমার দিনকাল কাটছে। ডায়াবেটিস, পা এবং হার্টের সমস্যার কারণে প্রতিমাসে আমার চার হাজার টাকার ওষুধ লাগে। এখন আমি কোনো কাজ করতে পারি না। মুহসীন হলের কয়েকজন ছাত্র ভাইয়ের সহযোগিতায় আল্লাহ আমাকে কোনোরকম চালিয়ে নিচ্ছেন। আমি আপনাদের ওপর বিশ্বাস রাখি, আপনারা আমার পাশে দাঁড়াবেন, যাতে আমার জীবিকা নির্বাহের একটা পথ হয় এবং আমার চিকিৎসার ব্যবস্থাটা করতে পারি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিকট আর্থিক সহযোগিতা কামনা করে রহিম চাচা বলেন, ডাক্তার বলেছে আমার পায়ে রিং লাগাতে হলে চার লাখ টাকা লাগবে। কিন্তু আমার তো এত টাকা নেই। ১৯৯৬ থেকে এই ক্যাম্পাসে কাজ করছি। আমি কখনো আশা করিনি আমাকে এভাবে হাত পাততে হবে। এখন যেহেতু আমি বিপদে পড়েছি, সেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাই-বোনদের নিকট আমার আবেদন, আপনারা আগেও আমাকে সহযোগিতা করেছেন, আমাকে আরেকটু সহযোগিতা করুন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩৮ হাজার শিক্ষার্থী আছেন। সবাই যদি ১০ টাকা করেও দেন, তাহলে কয়েক লাখ টাকা হয়ে যাবে।
স্বাভাবিকভাবে বাঁচার আকুতি জানিয়ে রহিম মামা বলেন, সবার কাছে আমার একটি আকুল আবেদন। আমার দুটি চোখ নষ্ট, আমি চোখে দেখি না। তার মধ্যে যদি আমার পায়ের সমস্যা থেকে যায়, তাহলে তো আমার জীবনটাই অন্ধকার হয়ে যাবে। আজ চোখে দেখি না, আপনাদের কাছে সাহায্য চাইলে, আপনারা হাত ধরে রাস্তাটা পার করে দেবেন। এখন যদি আমার পা’টাও নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে আমি কী নিয়ে জীবন-যাপন করব!
দেশবাসী ও সরকারের কাছে সহযোগিতা চেয়ে তিনি বলেন, চোখ তো চলে গেছে, এটার জন্য আমার আক্ষেপ নেই। আমার চাওয়া, আমি যেন সুস্থভাবে সন্তানদের নিয়ে বেঁচে থাকতে পারি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ভাই-বোনদের কাছে, দেশবাসীর কাছে এবং সর্বোপরি সরকারের কাছে আমার আবেদন। আপনারা যদি আমার পাশে দাঁড়ান, ইনশাআল্লাহ পরিবার নিয়ে স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকতে পারব এবং আপনাদের জন্য দোয়া করতে পারব। আমাকে সহযোগিতা করতে চাইলে ০১৯২৯-৬২৭৩৫৩ ও ০১৭৭২-৭৮২০৯৯ যোগাযোগ করতে পারেন।
আব্দুর রহিম ওরফে রহিম মামার জন্ম মুন্সিগঞ্জ সদর থানার মামাশার গ্রামে। তার যখন বয়স দেড় বছর, তখন তার পরিবার জীবিকার তাগিদে রাজধানীতে পাড়ি জমায়। বর্তমানে তারা থাকেন ঢাকার কামরাঙ্গীর চর এলাকায়। তিনি রাজধানীর অস্থায়ী প্রতিবন্ধী স্কুল থেকে পঞ্চম শ্রেণি পাস করেন। পরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৮৮ সালে ব্রেইল পদ্ধতিতে পড়াশোনা করে এসএসসি পাস করেন। বর্তমানে তিনি দুই কন্যার জনক, যাদের বয়স যথাক্রমে নয় ও পাঁচ। দুইজনই মাদরাসায় পড়াশোনা করছে।
এইচআর/আরএইচ