জাবির চারুকলায় আরবি ক্যালিগ্রাফি কর্মশালা অনুষ্ঠিত

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) চারুকলা বিভাগের ১৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে ‘আরবি ক্যালিগ্রাফি কর্মশালা-২০২৫’- এর আয়োজন করা হয়েছে। শিল্প ও আত্মিক চর্চার সমন্বয়ে আয়োজিত তিন দিনব্যাপী এই কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়েছে ১৭-১৯ মার্চ। ৫৫ জন শিক্ষার্থী অংশগ্রহণে কর্মশালাটি সকল বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য উন্মুক্ত ছিল।
কর্মশালার উদ্বোধন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ও মানবিক অনুষদের ডিন ড. মো. মোজাম্মেল হক। উদ্বোধনী বক্তব্যে তিনি ক্যালিগ্রাফির নান্দনিকতা ও আত্মিক গুরুত্ব তুলে ধরেন এবং শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল বিকাশে এ ধরনের উদ্যোগের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন।
বিজ্ঞাপন
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন চারুকলা বিভাগের সভাপতি শামীম রেজা, সহযোগী অধ্যাপক ড. এম এম ময়েজ উদ্দিন, সহকারী অধ্যাপক ধীমান সরকারসহ অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ।
কর্মশালার প্রধান প্রশিক্ষক ছিলেন বিশিষ্ট ক্যালিগ্রাফি শিল্পী ও গবেষক মো. আবু বকর সিদ্দীক। তিনি দীর্ঘদিন ধরে শিল্পোদ্যোগ ‘আর্ট কার্নিভাল’, ‘ভাস্ট’, ‘ক্রাফট’ এবং ‘ব্যাম্বো চিক’-এর সঙ্গে যুক্ত। সহ-প্রশিক্ষক হিসেবে ছিলেন ক্যালিগ্রাফি শিল্পী সুলতানা মিমি ও জামিল আহমেদ।
কর্মশালাটি দুটি ভাগে বিভক্ত ছিল—তত্ত্বীয় ও ব্যবহারিক। প্রথম অংশে আরবি ক্যালিগ্রাফির ঐতিহাসিক পটভূমি, শৈল্পিক বিবর্তন ও নান্দনিক বিশ্লেষণ নিয়ে আলোচনা করা হয়। দ্বিতীয় অংশে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন কলম ও ব্রাশের ব্যবহারে আরবি লিপি ও শিল্পকর্ম তৈরি শেখেন।
১৯ মার্চ সমাপনী দিনে প্রধান অতিথি ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মোহাম্মদ কামরুল আহসান। তিনি শিল্পচর্চায় বৈচিত্র্য ও অন্তর্ভুক্তির গুরুত্ব তুলে ধরে এ আয়োজনের প্রশংসা করেন।
বিশেষ অতিথি ছিলেন উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) ড. মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান, উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) ড. সোহেল আহমেদ ও কোষাধ্যক্ষ ড. মো. আবদুর রব। কর্মশালার সমাপ্তি হয় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে সনদ বিতরণের মাধ্যমে।
ক্যালিগ্রাফির উত্থান
নান্দনিকভাবে ভাষার লিখিতরূপকে ক্যালিগ্রাফি বলে। প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন ভাষায় ক্যালিগ্রাফি চর্চা হয়ে এসেছে যার প্রমাণ পুরাতাত্ত্বিক গবেষণায় দেখা যায়। প্রাচীন আরবে ক্যালিগ্রাফির চর্চা তেমন ছিল না কারণ জাতিগতভাবে তারা স্মৃতিশক্তির উপর নির্ভরশীল ছিলেন এবং মুখস্তবিদ্যায় তাদের ছিল বিশ্বব্যাপী সুনাম। কিন্তু ইসলামের আগমন পরবর্তীকালে ঐশীবাণী কোরআন সংরক্ষণ ও হাদিস লিপিবদ্ধকরণ এবং প্রশাসনিক কাজে লেখার প্রয়োজনীয়তা বেড়ে যাওয়ায় আনুষ্ঠানিকভাবেই ক্যালিগ্রাফি চর্চা শুরু হয়। আজও এটি ঐতিহাসিকভাবে একটি শিল্পের বিস্তৃত। আজও কোরআনের মুসহাফ বা পান্ডুলিপি এবং হাদিসের গ্রন্থসমূহ এর সাক্ষ্য বহন করে চলেছে।
আরবি ক্যালিগ্রাফি হলো নান্দনিকতা ও আধ্যাত্মিকতার অপূর্ব সংমিশ্রণ, যেখানে প্রতিটি হরফ কেবল ভাষা প্রকাশের মাধ্যম নয়, বরং সৌন্দর্য ও ভাবের বহিঃপ্রকাশ। ইসলামের সূচনালগ্ন থেকেই আরবি হস্তলিপি বিকশিত হয়েছে, বিশেষত কোরআন লেখার মাধ্যমে, যা এই শিল্পকে এক পবিত্র ও মর্যাদাপূর্ণ রূপ দিয়েছে। কুফি, নাসখ, থুলুথ, দিওয়ানি, রুকা ও নাস্তালিক সহ বিভিন্ন শৈলীতে আরবি ক্যালিগ্রাফির অসাধারণ সৌন্দর্য ফুটে ওঠে, যেখানে প্রতিটি স্ট্রোক এক গভীর অর্থ বহন করে।
সাধারণত বাঁশের কলম, বিশেষ ধরনের কালি, ক্যানভাস কিংবা আধুনিক ডিজিটাল টুলের মাধ্যমে এই শিল্প নতুন রূপ পেয়েছে, তবে এর মূল আবেদন সেই ঐতিহ্য ও বিশুদ্ধতা, যা যুগ যুগ ধরে সংরক্ষিত আছে। আজকের বিশ্বে আরবি ক্যালিগ্রাফি শুধু ধর্মীয় গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ নয়, বরং স্থাপত্য, চিত্রকলা, ফ্যাশন ও ডিজাইনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এই শিল্পের প্রতি ক্রমবর্ধমান আগ্রহ প্রমাণ করে, এটি কেবল অতীতের ঐতিহ্য নয়, বরং ভবিষ্যতের সৃজনশীলতার এক উজ্জ্বল অধ্যায়, যেখানে প্রতিটি হরফ এক জীবন্ত শিল্পকর্ম হয়ে ওঠে শিল্পীর হাতের জাদুতে।
বাংলাদেশে ক্যালিগ্রাফির উত্থান ও ‘ক্যালিগ্রাফিতি’ বিপ্লব
বাংলাদেশে মধ্যযুগ থেকেই ক্যালিগ্রাফি শিল্পের প্রচলন রয়েছে, বিশেষ করে ইসলামিক স্থাপত্য ও মসজিদ অলংকরণে। তবে ২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানের পর দেশজুড়ে ক্যালিগ্রাফির নতুন এক রূপ বিকাশ লাভ করে, যা পরিচিতি পেয়েছে ‘ক্যালিগ্রাফিতি’ নামে।
এই সময় শহরের দেয়ালজুড়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে ক্যালিগ্রাফি ও গ্রাফিতির সংমিশ্রণে। শিল্পীরা বাংলা, ইংরেজি ও আরবি হরফের মাধ্যমে দেয়ালচিত্রে প্রতিবাদী বার্তা, ন্যায়বিচারের আহ্বান এবং সমতাভিত্তিক সমাজের স্বপ্ন তুলে ধরেন। এই নতুন ধারার ক্যালিগ্রাফি শুধু শৈল্পিক প্রকাশ নয়, বরং তা সামাজিক আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হয়ে ওঠে।
জাবিতে নতুন বিভাগ চালুর ঘোষণা
বাংলাদেশে ক্যালিগ্রাফির ক্রমবর্ধমান গুরুত্ব উপলব্ধি করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সম্প্রতি ‘ক্যালিগ্রাফি অ্যান্ড টাইপোগ্রাফি’ এবং ‘ইসলামিক আর্ট অ্যান্ড আর্কিটেকচার’ নামে দুটি নতুন বিভাগ চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ১৭ মার্চ রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় উপাচার্য ড. মোহাম্মদ কামরুল আহসান এ ঘোষণা দেন।
মেহেরব হোসেন/ এনটি