রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) সিনেটে প্যানেল নির্বাচনের মাধ্যমে উপাচার্য নিয়োগের বিধান থাকলেও দীর্ঘ সময় ধরে সেসব কাগজে কলমেই রয়ে গেছে। প্যানেলের জায়গায় কার্যকর হয়ে উঠেছে তদবির। তাই উপাচার্যের পদ শূন্য হওয়ার পর থেকেই অন্তত ডজনখানেক শিক্ষক এই পদে আসীন হতে জোর লবিং ও তদবির শুরু করছেন। 

খোদ রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্যকেই ধোঁকা দিয়ে দায়িত্ব নেওয়াসহ মেয়াদের পুরো সময় জুড়ে নানান অভিযোগে অভিযুক্ত অধ্যাপক এম আবদুস সোবহানের মেয়াদ শেষ হয়েছে গত ৬ মে। তবে এখনো উপাচার্য নিয়োগে ‘সিনেটের উপাচার্য প্যানেল’ হয়নি । ফলে সংশ্লিষ্টদের ধারণা এবারও প্যানেলের পরিবর্তে তদবিরই মুখ্য ভূমিকা পালন করবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে ক্ষমতাধর এ পদে নিয়োগে। যদিও ৬ মে থেকে রুটিন উপাচার্যের দায়িত্বে আছেন উপ-উপাচার্য অধ্যাপক আনন্দ কুমার সাহা। 

বিশ্ববিদ্যালয়ে সূত্রে জানা গেছে, সদ্য সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এম আবদুস সোবহান তার লোক হিসেবে পরিচিত অধ্যাপক রকীব আহমেদ, অধ্যাপক হাবিবুর রহমান অথবা অধ্যাপক এম. শহীদুল্লাহ এই তিনজনের একজনকে নিয়োগ পাইয়ে দিতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। অপরদিকে দুর্নীতিবিরোধী শিক্ষক সমাজের দিক থেকে নিয়োগের দৌড়ে এগিয়ে আছেন আরও অন্তত ৪ থেকে ৫ জন শিক্ষক। 

অধ্যাপক রকীব আহমেদ : উপাচার্য হওয়ার দৌড়ে বেশ এগিয়ে আছেন বলে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক রকীব আহমেদ। সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এম আবদুস সোবহানের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে বেশ পরিচিত তিনি। সর্বশেষ ২০১৭ সালে যখন দ্বিতীয় মেয়াদে উপাচার্যের দায়িত্ব পান অধ্যাপক এম আবদুস সোবহান, সেবারও উপাচার্য হওয়ার জন্য বেশ দৌড়ঝাঁপ করেছিলেন অধ্যাপক রকীব আহমেদ। কিন্তু সে সময় দায়িত্ব পাননি তিনি।

অধ্যাপক রকীব আহমেদ বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজের আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করেছেন অনেকটা সময়জুড়ে। 

তবে আলোচিত এক-এগারোর সময় পাকিস্তানের বাহাওয়ালপুরের ইসলামিয়া ইউনিভার্সিটিতে পুরো এক বছর ভূগোল বিভাগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। দায়িত্ব পালন করেন ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। এর আগে ২০০৭ সালের মার্চ মাসে বাহাওয়ালপুর ইসলামিয়া ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের আয়োজনে এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে সেশন সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। সে সংক্রান্ত নথিপত্র ঢাকা পোস্টের কাছে রয়েছে। 

অধ্যাপক রকীব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসরে যাবেন আগামী ৩০ জুন। সদ্য বিদায়ী উপাচার্য অধ্যাপক এম আবদুস সোবহানের ঘনিষ্ঠ বলেই ক্যাম্পাসে পরিচিত তিনি। অধ্যাপক এম আবদুস সোবহান প্রথম মেয়াদে (২০০৯-২০১৩) উপাচার্য থাকা অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের (আইইএস) পরিচালকও করেছিলেন রকীব আহমেদকে। ওই সময় আরও বেশ কয়েকটি দায়িত্বে তাকে রেখেছিলেন আবদুস সোবহান। উপাচার্যের দায়িত্ব না পেয়ে তিনি জার্মানিতে চলে যান। পরে দেশে আসলে অধ্যাপক আবদুস সোবহান তাকে আলোচিত ক্যাম্পাসের সৌন্দর্যবর্ধনের কাজের দায়িত্ব দেন। 

অধ্যাপক চৌধুরী সারওয়ার জাহান : উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার ক্ষেত্রে তার নাম জোরেশোরেই শোনা যাচ্ছে। ভূতত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের এই অধ্যাপক এর আগে ২০১৩-২০১৭ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। গবেষক হিসেবে নাম ডাক আছে তার। বরেন্দ্র অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানি নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছেন প্রায় ৩৪ বছর ধরে। রাজশাহী  বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়টির সর্বকালের সেরা ৫০ জন বিজ্ঞানীর তালিকা করা হয়, সেখানে তার নাম উঠে এসেছে ৪৩ নম্বরে। অধ্যাপক অধ্যাপক চৌধুরী সারওয়ার জাহান বিভিন্ন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের জীব ও ভূবিজ্ঞান অনুষদের ডিন, ছাত্র উপদেষ্টা এবং ভূতত্ত্ব ও খনি বিভাগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন।

অধ্যাপক জিনাত আরা : উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পেলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে সর্বপ্রথম নারী উপাচার্যের হওয়ার কৃতিত্ব হতে পারে তারই। সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এম আবদুস সোবহানের অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে তারই রাজনৈতিক সাথীদের যে অবস্থান, সেখানে নানা সময়ে উচ্চকণ্ঠ ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের এই অধ্যাপকের। 

পারিবারিকভাবে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্ক থাকায় নিয়োগ পাওয়ার দৌড়ে তার সম্ভাবনা উড়িয়ে দিতে পারছেন না সংশ্লিষ্টরা। তার বাবা আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পেয়ে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করেছিলেন বলে জানা গেছে। তার বাবা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে শিক্ষকতার পাশাপাশি সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ছিলেন।

অধ্যাপক মো. হাবিবুর রহমান : অধ্যাপক হাবিবুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজের বর্তমান আহ্বায়কের দায়িত্বে রয়েছেন। তবে অধ্যাপক আবদুস সোবহানের মেয়াদের শেষ দিনে দেওয়া বিতর্কিত নিয়োগ নিয়ে কমিটির ১৬ সদস্য উচ্চকণ্ঠে প্রতিবাদ করলেও নীরব ছিলেন অধ্যাপক হাবিবুর। এ নিয়ে দলের বিভাজন স্পষ্ট হয়ে ওঠে। শিক্ষকদের কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন নিয়োগের গোপন ফলভোগী হওয়াতে কথা বলতে পারেননি তিনিসহ আরও চার সদস্য। 

জানা গেছে, অধ্যাপক এম আবদুস সোবহান তাকে সহায়ক কর্মচারী নিয়োগ কমিটির সদস্য, বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টারের উপদেষ্টা কমিটির সদস্য করেছিলেন। সাবেক উপাচার্যের আশীর্বাদেই তিনি দলের স্টিয়ারিং কমিটির নির্বাচনে আহ্বায়ক পদে জয়লাভ করেছেন।

তিনি ১৯৯০ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ রসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। পরে ১৯৯৬ সালে জাপানের ওকাইমা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মলিকুলার বায়োলজির ওপর পিএইচডি করেন।

অধ্যাপক মো. আবুল কাশেম : চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকায় আলোচনায় আছেন অধ্যাপক আবুল কাশেম। ইতিহাস বিভাগের এই অধ্যাপক রাজশাহী জেলা বঙ্গবন্ধু পরিষদের সাধারণ সম্পাদক। প্রতিষ্ঠাতা সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের। 

অধ্যাপক কাশেম ২০১৯ সাল থেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্ডিলের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এ ছাড়া ২০২০ সাল থেকে তিনি পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিলের সদস্য। 

অধ্যাপক এম. শহীদুল্লাহ : সাবেক উপাচার্য এম আবদুস সোবহানের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। অধ্যাপক  আবদুস সোবহানের দেওয়া ইনস্টিটিউট অব ইংলিশ অ্যান্ড আদার ল্যাংগুয়েজেজ-এর পরিচালকের দায়িত্বে রয়েছেন। অধ্যাপক সোবহানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির নানা অভিযোগ প্রমাণ পাওয়ার পরে শিক্ষা মন্ত্রণালয় যখন বিশ্ববিদ্যালয়টিতে সবধরনের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্থগিতাদেশ দেয় তখনো তার স্বাক্ষরে নিয়োগ হয়েছে। গত বছরের ১৩ ডিসেম্বর তারই স্বাক্ষরিত একটি অফিস আদেশে একজনকে সেকশন অফিসার পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ইংরেজি বিভাগের এই অধ্যাপক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতির দায়িত্বও পালন করেছিলেন।

অধ্যাপক সফিকুন্নবী সামাদী : বাংলা বিভাগের এই অধ্যাপক বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের প্রশাসক ছিলেন। সদ্য বিদায়ী উপাচার্যের অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাকে আন্দোলন করতে দেখা যায়। আওয়ামীপন্থী দলীয় শিক্ষকদের স্টিয়ারিং কমিটির নির্বাচনে জয়লাভ করে তিনি কনভেনিং কমিটির একজন সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

এছাড়াও উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার চেষ্টায় কিংবা নিয়োগের দৌড়ে এগিয়ে আছেন বর্তমান উপ-উপাচার্য অধ্যাপক আনন্দ কুমার সাহা, হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য-ব্যবস্থা বিভাগের অধ্যাপক সাইয়েদুজ্জামান মিলন এবং ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক মলয় কুমার ভৌমিক। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষার্থীদের প্রতি সবচেয়ে দায়বদ্ধ, প্রাজ্ঞ, মেধাবী ও সর্বজন গ্রহণযোগ্য কাউকে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার প্রত্যাশা তাদের। যার হাত ধরে বিগত দিনের গ্লানি মুছে এক অন্যন্য উচ্চতায় পৌঁছে যাবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। 

মেশকাত মিশু/আরএআর