শাবির সাবেক উপাচার্যের পিএসের একাধিক বাড়ি, চাকরি দিয়েছেন স্বজনদের

ইনসেটে অভিযুক্ত কবির উদ্দিন

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদের সাবেক একান্ত সচিব (পিএস) মো. কবির উদ্দিনের বিরুদ্ধে সীমাহীন আর্থিক দুর্নীতি এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ পাওয়া গেছে। অনুসন্ধানে এসব অভিযোগের সত্যতাও মিলেছে। 

দীর্ঘ অনুসন্ধানের পর জানা যায়, সাবেক উপাচার্য ফরিদ উদ্দিনের সাবেক পিএস মো. কবির উদ্দিনের সিলেট শহরের বিভিন্ন স্থানে একাধিক বাড়ি রয়েছে। এলাকাতেও রয়েছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সম্পদ। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন দপ্তরে নিজের স্ত্রী, শ্যালক, ভাতিজা, ভাগিনা এবং নিকটাত্মীয়সহ নিয়োগ দিয়েছেন ২০ জনের অধিক লোক।

জানা যায়, অভিযুক্ত কবির উদ্দিন বিশ্ববিদ্যালয়ে তার চাকরি জীবনে উপাচার্যের পিএ এবং পিএস হিসেবে ২০০১ সাল থেকে দায়িত্ব পালন করেছেন প্রায় ২৫ বছর। এর মাঝে সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. এম আমিনুল ইসলামের সময় তাকে এ পদ থেকে সরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে স্থানান্তর করা হয় বিভিন্ন অভিযোগের প্রেক্ষিতে। এরপর উপাচার্য আমিনুল ইসলাম চলে গেলে বিভিন্ন জায়গায় লবিং করে আবারো তিনি উপাচার্যের পিএ হিসেবে যোগ দেন বলে জানা গেছে। 

অভিযোগ রয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন নিয়োগ, বিভিন্ন দপ্তর থেকে চাঁদাবাজি এবং অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন লাখ লাখ টাকা। এমনকি পদোন্নতির যোগ্যতা না থাকলেও উপাচার্যকে হাত করে বাগিয়ে নিয়েছেন একাধিক পদোন্নতি।

দীর্ঘ অনুসন্ধানের পর এসব অভিযোগের তথ্য-প্রমাণ এই প্রতিবেদকের হাতে এসেছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৪ সালের বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ ও আপগ্রেডেশন নীতিমালা অনুযায়ী অফিস সহকারী পদে যোগদান করে সর্বোচ্চ দুটি আপগ্রেডেশন পাওয়ার কথা। ২০২৪ সালের মার্চ মাসের আগ পর্যন্ত সে পদোন্নতি বাগিয়ে নেন তিনি। এরপর সে বছরের মার্চ মাসে নীতিমালা ভেঙে তড়িঘড়ি করে আরও একটি আপগ্রেডেশন দিয়ে ডেপুটি রেজিস্ট্রার পদে পদন্নোতি দেওয়ার সব আয়োজন সম্পন্ন করেন উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন। সর্বশেষ ওই মাসে অনুষ্ঠিত সিন্ডিকেট সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাকে পদোন্নতি দেওয়াও হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৯৯৪ সালে অফিস সহকারী হিসেবে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন উপাচার্যের ব্যক্তিগত সচিব মো. কবির উদ্দিন। ২০০৮ সালে সহকারী প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসাবে আপগ্রেডেশন লাভ করেন। ২০১০ সালে তিনি প্রশাসনিক কর্মকর্তার স্থায়ী পদে স্থানান্তরিত হয়ে প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে নিয়োগ লাভ করেন।

এর আগে উপাচার্যের সই জাল করে একসাথে একাধিক কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। সেসময় এর পেছনে আর্থিক লেনদেনের বিষয়টিও আলোচনায় আসে বলে জানা গেছে।

এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পদে নিয়োগে তার বিরুদ্ধে বড় অংকের অর্থ লেনদেনেরও অভিযোগ রয়েছে। সে সংক্রান্ত তথ্য -প্রমাণ এবং স্বীকারোক্তির মাধ্যমে তার ঘনিষ্ঠতার তথ্যও এ প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। দীর্ঘদিন খোঁজ নিয়ে কবির হোসেন নিজের স্ত্রী, শ্যালক, ভাতিজা, ভাগিনা এবং নিকটাত্মীয়সহ ২০ জনের বেশি আত্মীয়-স্বজন বা পরিচিতদের চাকরি দিয়েছেন বলেও জানা গেছে। নিকটাত্মীয়, পরিচিত, নিজ এলাকায় সম্পর্কে ভাতিজা, ভাগিনা, তাদের স্ত্রী এবং তাদের ভাইবোনদেরও চাকরি দিয়েছেন তিনি। এতসব নিয়োগে বড় অংকের অর্থিক লেনদেনের অভিযোগ রয়েছে।

গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন উপাচার্য নিয়োগ হলে একাধিক অভিযোগের প্রেক্ষিতে কবির উদ্দিনের একাধিক আত্মীয়কে বিভিন্ন দপ্তর ও বিভাগে বদলিও করা হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ পরিদর্শক কার্যালয়ে প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে স্ত্রীকে, রেজিস্ট্রার দপ্তর, উপাচার্যের দপ্তর, উপাচার্যের বাসভবন, বিভিন্ন বিভাগীয় দপ্তর, আবাসিক হল থেকে শুরু করে নিরাপত্তা শাখায় ভাতিজা, ভাগিনা, তাদের ভাই-বোন, স্ত্রী থেকে শুরু করে এলাকার পরিচিতিদেরও চাকরি দিয়েছেন কবির উদ্দিন। অভিযোগ রয়েছে সেসব আত্মীয়-স্বজনও তার ক্ষমতা ব্যবহার করে অনেক অনিয়মের সঙ্গে জড়িয়েছেন বিভিন্ন সময়ে। 

অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের গার্ড নিয়োগে অর্থিক লেনদেনের বড় অংশ দিতে হতো কবির উদ্দিনকে। বিনিময়ে সেসব সুপারভাইজারদের বিরুদ্ধে নিরাপত্তারক্ষীদের গুরুতর অভিযোগগুলো উপাচার্যের সাথে তদারকি করে সমাধান করে দিতেন তিনি।

জানা যায়, একাধিকবার বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তারক্ষীরা তাদের সুপারভাইজারের বিরুদ্ধে বিনা অপরাধে ডিউটি কর্তন, অতিরিক্ত ডিউটি পেতে অর্থ প্রদান, টাকা না দিলে ডিউটি না দেওয়া, বিনা অপরাধে চাকরিচ্যুতি থেকে শুরু করে নানা অনিয়মের বিরুদ্ধে উপাচার্যের কাছে লিখিত অভিযোগ দেন। তবে এ লিখিত অভিযোগগুলো উপাচার্যের কাছে উপস্থাপন করতেন না পিএস কবির উদ্দিন। এসব অভিযোগ সেখানে উপস্থাপন না করে নিরাপত্তারক্ষীদের সাথে আপস করে নিজে নিজে তাদের শান্ত রেখে তা সমাধান করতেন।

দীর্ঘ অনুসন্ধানের পর ওইসব সুপারভাইজারের একাধিক ব্যাংক অ্যাকাউন্টে প্রায় কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য পাওয়া যায়। যার প্রায় সবই ছিলো এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে ফাঁকি দিয়ে অবৈধভাবে হাতিয়ে নেওয়া অর্থ। যার পেছনে জড়িত ছিলেন উপাচার্যের পিএস কবির হোসেন। এমনকি সুপারভাইজার সৈয়দ হাবিবুর রহমানের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আসলে তিনি তার তোয়াক্কা না করে তার ‘ওপরে লোক আছে’ বলে ভয়ভীতি প্রদর্শন করতেন। আর তার সে ‘ওপরের লোক’ হিসেবে তাকে সকল অন্যায় কাজে পেছন থেকে সহযোগিতা করতেন।

সাবেক পিএস কবির উদ্দিনের বিষয়ে খোঁজ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ইনস্টিটিউশন থেকে দীর্ঘ বছর চাঁদা নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউশনাল কোয়ালিটি অ্যাস্যুরেন্স সেল (আইকিউএসি) থেকে দীর্ঘ বছর তার চাঁদা নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। ওই ইনস্টিটিউটের একাধিক কর্মকর্তা, কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিভিন্ন ওয়ার্কশপ এবং বিভিন্ন প্রোগ্রামে শুধুমাত্র ওই ইনস্টিটিউটটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য নির্দিষ্ট অর্থ বরাদ্দ থাকে। কিন্তু তাদের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ থেকে টাকা কম নিয়ে কবির উদ্দিনকে টাকা দিতে হতো।

তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মানুযায়ী উপাচার্যের পিএস কোনো গাড়ি বরাদ্দ পান না। তবে জোর খাটিয়ে তিনি নিজের এবং পরিবারের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গাড়ি ব্যবহার করতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা যাওয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন ব্যক্তিগত কাজেও গাড়ি ব্যবহার করতেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

এদিকে সাবেক পিএস কবির উদ্দিনের নিজ এলাকায় এবং সিলেট শহরে খোঁজ নিয়ে তার বিপুল অর্থ-সম্পদের খোঁজ পাওয়া গেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিলেট শহরে বিশ্ববিদ্যালয়ের অদূরে সুরমা আবাসিক এলাকায় মারলিন টাউয়ার নামক বাড়িতে তার একটি ফ্ল্যাট রয়েছে। এছাড়াও শহরের বাগবাড়ি সংলগ্ন এলাকার বর্ণমালা পয়েন্টে নির্মাণাধীন বহুতল ভবনের একটি অংশে শেয়ার রয়েছে তার। তাছাড়া তিনি মদিনা মার্কেট এলাকায় একটি বাড়িতে থাকছেন বলেও খোঁজ রয়েছে। অন্যদিকে সিলেট শহরের বাইরে তার গ্রামের বাড়িতেও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সম্পত্তির কথা জানা গেছে। 

উপাচার্যের সঙ্গে সখ্যতা থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন দপ্তরে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়োগ, পদোন্নতি আটকে দেওয়া থেকে শুরু করে শোকজ এবং বিভিন্ন দপ্তরে প্রভাব খাটাতেন কবির উদ্দিন। তার ব্যক্তিগত অপছন্দের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উপাচার্যের সঙ্গে বিভিন্ন অজুহাতে দেখা করতে না দেওয়াসহ নানা অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন জিনিসপত্র বিশ্ববিদ্যালয়কে অবহিত না করে বাসায় নিয়ে যাওয়া বা বিক্রি করে দেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে। তবে এসব অভিযোগের বিষয়ে উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদ জানলেও তার ঘনিষ্ঠজন হওয়ায় কোনো ব্যবস্থা নেননি বরং তাকে অবৈধভাবে পদোন্নতিও দিয়েছেন ।

নাম উল্লেখ না করে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার দপ্তরের এক কর্মকর্তা জানান, তার (কবির উদ্দিন) বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলেও এসবের তোয়াক্কা করতেন না উপাচার্য। উপাচার্যের ঘনিষ্ঠজন হওয়ায় কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যেন ছিল তার অধীন। এমনকি উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করতে গেলেও বিভিন্ন অজুহাতে সময় ক্ষেপণ করে দেখা করার সুযোগ দিতেন না তিনি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য দপ্তরের একাধিক কর্মচারী বলেন, পিএস কবির উদ্দিনের আত্মীয় ও কাছের মানুষ হওয়ায় আমাদের সাথেরই একজন কর্মচারী কর্তৃত্ব দেখাতেন আমাদের ওপর। আমরাও ভয়ে কিছু বলতাম না।

এসব অভিযোগের বিষয়ে কবির উদ্দিন বলেন, আমার এতো আত্মীয়-স্বজনের কথা মিথ্যা। তারা বিভিন্ন সময়ে চাকরি পেয়েছেন। এতে আমার কোনো হাত ছিল না।

নিয়োগে লেনদেনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, গার্ড সুপারভাইজার হাবিব সরাসরি  উপাচার্যের সঙ্গে এসব বিষয় ডিল করতো। আমি পিএস হিসেবে উপাচার্যের সঙ্গে থাকতাম। এর বাইরে আমি আর কিছু জানি না। 

ওই সুপারভাইজারের ব্যাংক লেনদেনে প্রায় কোটি টাকার হিসাব পাওয়া গেছে, যেহেতু তিনি সরাসরি উপাচার্যের সঙ্গে এসব ডিল করতেন এতো লেনদেনে আপনার সঙ্গে উপাচার্যও জড়িত ছিলেন কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে কবির উদ্দিন বলেন, এ বিষয়ে আমি কিছু জানি না, আমি কিছু বলতে পারব না তাদের বিষয়।

একাধিক বাড়ির বিষয়ে তিনি বলেন, একটি বাড়ির কাজ চলমান, সেটা আমি লোন নিয়ে করছি। আরেকটি বাড়ির এখনো রেজিস্ট্রেশন হয়নি, ওটা আমার স্ত্রীর অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা যায়। এছাড়াও অন্যান্য সম্পদ এবং অভিযোগের বিষয়ে তিনি কিছু স্পষ্ট করেননি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. সাজেদুল করীম বলেন, এ ধরনের অভিযোগ আমরা পেলে বা এমন কোনো অভিযোগ আসলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। বর্তমান প্রশাসন এ বিষয়ে সতর্ক রয়েছে। যে কোনো লিখিত অভিযোগ পেলেই আমরা তার সুষ্ঠু তদন্ত করে এর প্রেক্ষিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

আরএআর