হাফিজুরের সেই তিন বন্ধুকে নিয়ে সন্দেহ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষার্থী হাফিজুর রহমানের মৃত্যুর রহস্যের জট খোলেনি এখনো। নিখোঁজ হওয়ার ৯ দিন পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের মর্গে তার লাশের খোঁজ মিললেও কীভাবে তার মৃত্যু হলো সে সম্পর্কে পরিষ্কার কোনো ধারণা পাওয়া যাচ্ছে না।
হাফিজুরকে হত্যা করা হয়েছে বলে সন্দেহ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক-শিক্ষার্থীর। এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য মতে হাফিজুরের সাথে শেষ আড্ডা দিয়েছিলেন তার যে তিন বন্ধু, তাদের সন্দেহের তালিকায় রাখছেন স্বজন ও সহপাঠীরা। ওই তিনজনকে পুলিশ ইতোমধ্যে জিজ্ঞাসাবাদও করেছে।
বিজ্ঞাপন
হাফিজের এই তিন বন্ধু হলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের শিক্ষার্থী আসিফ বাপ্পী, পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী অন্তু ঠাকুর এবং ঢাকা কলেজের ২০১৫-১৬ সেশনের শিক্ষার্থী রাফসান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য, বিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগের ২০১৫-১৬ সেশনের শিক্ষার্থী হাফিজুরের গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবায়। ১৫ মে ঈদের পরদিন ঢাকায় এসেছিলেন হাফিজুর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কার্জন হল এলাকায় ১৫ মে দুপুরে আসিফ, অন্তু ও রাফসানের সঙ্গে আড্ডা দেন তিনি। ওই দিন রাত ৮টার পর থেকে তার আর খোঁজ পাওয়া যায়নি।
হাফিজুরের মৃত্যুর ঘটনায় এই তিনজনকে এরইমধ্যে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ। এ বিষয়ে শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মামুন অর রশিদ বলেন, সন্দেহ থেকে হাফিজের তিন বন্ধুকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও জানা গেছে। সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে ঘটনাটি তদন্ত করা হচ্ছে। যার সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যাবে তাকেই আইনের আওতায় আনা হবে।
হাফিজের সহপাঠীরা বলছেন, গত বছর করোনা শুরুর পর এই তিনজনের সঙ্গে হাফিজের পরিচয় ও সখ্যতা গড়ে ওঠে। করোনাকালে ক্যাম্পাস বন্ধ থাকলেও তাদের প্রায়ই টিএসসিসহ বিভিন্ন জায়গায় আড্ডা দিতে দেখা যেত। ওই তিনজন মাদকাসক্ত ছিলেন বলেও দাবি তাদের। এদের মধ্যে আসিফের বিবাহবিচ্ছেদ হওয়ার পর তার আচরণে অস্বাভাবিকতা ছিল বলে দাবি হাফিজুরের সহপাঠীদের। ক্যাম্পাস বন্ধ থাকাকালে হাফিজুর মাঝে মধ্যে আসিফের চানখাঁরপুলের বাসায় থাকতেন।
পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, হাফিজের বাবা বাড়ির পাশে একটি মসজিদে ইমামতি করতেন। আর মা শামছুন্নাহার গৃহিণী। বড় ভাই হাবিবুর রহমান একটি ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী এবং বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে হাফিজুরের এই তিন বন্ধুকে আইনের আওতায় আনার দাবি জানানো হয়েছে।
ঢাকা ইউনিভার্সিটি মাইম অ্যাকশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সানোয়ারুল হক সনি বলেন, হাফিজের সাথে যারা ওই রাতে ছিলেন তাদের ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করা হোক।
আইন বিভাগের শিক্ষার্থী আরাফাত চৌধুরী বলেন, আমার কাছে তার কিছু বন্ধুর আচরণ সন্দেহজনক মনে হয়েছে। ঘটনার পর থেকে তারা আত্মগোপনে আছেন এবং তাদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তারা একেক বার একেক জায়গার নাম বলছেন। এমনকি ঘটনার বর্ণনাও তারা বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে উপস্থাপন করছেন। তাদের নিবিড়ভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করলে সত্য উন্মোচিত হবে।
হাফিজুরের গ্রামের বাড়ির পাশের এলাকা ও ঢাবি ছাত্র পলাশ জানান, ঈদের পরদিন হাফিজকে কল করলে তিনি মোবাইল ফোন বন্ধ পান। এর একদিন পর হাফিজের বোনের মাধ্যমে তিনি জানতে পারেন, হাফিজ ঈদের পরদিন ঢাকায় গেলেও তার কোনো খোঁজ পাচ্ছেন না। পরে তিনি হাফিজের কথিত তিন বন্ধু আসিফ, রাফসান ও অন্তুর সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা হাফিজের বিষয়ে একেক সময় একেক রকম তথ্য দেন। আসিফ, রাফসান ও অন্তুকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে প্রকৃত ঘটনা জানা যাবে বলেও মনে করেন তিনি।
ঢাবির অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, হাফিজুর রহমান আত্মহত্যা করেছে কি না সেটি একটি বড় প্রশ্ন। আমরা শুধুমাত্র পুলিশের পক্ষ থেকে শুনেছি এটি আত্মহত্যা। আমি মনে করি তার পরিবারকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তারা হয়তো বলতে পারবে তার কেমন অবস্থা ছিল, হতাশা ছিল কি না। তার বন্ধুবান্ধবকেও জিজ্ঞেস করলে আমরা জানতে পারতাম। সত্য উদঘাটনে পরিবার এবং বন্ধুবান্ধবের জবানবন্দি খুবই প্রয়োজন।
সন্দেহের তালিকায় থাকা হাফিজের বন্ধু অন্তু ঠাকুর ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়ে তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন। স্ট্যাটাসে তিনি লিখেছেন বিনা প্রমাণে আমাদের (আমরা যারা যারা ছিলাম ১৫ তারিখ সন্ধ্যা পর্যন্ত তার সাথে) দোষী বলাটা কতটা যৌক্তিক তা আমার জানা নেই। বিনা প্রমাণে আমাদের ভাইরাল করে আমাদের মানহানি করাটা কতটা যৌক্তিক? আমাদেরও তো পরিবার-পরিজন আছে।
তিনি আরও লেখেন, ঘটনার দিন (১৫ মে) কার্জনে গান শুনতে শুনতে বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা নামার আগেই বৃষ্টি শুরু। দৌড়ে সবাই কেমিস্ট্রির বারান্দায় আশ্রয় নিলাম। আরও অনেকেই (বহিরাগত) সেখানে আসলো। দীর্ঘ দেড় দুই ঘণ্টার বৃষ্টির পর হঠাৎ হাফিজ বলে উঠল সে নাকি ব্রাহ্মণবাড়িয়া চলে যাবে। হাফিজ সবসময় এক কথার মানুষ। সে বলেছে মানে বলেছে। তাকে আর কে আটকে রাখে। আমরা তাকে বিদায় দিলাম। সে চলেও গেল। কিন্তু কিছুক্ষণ পর শুনি হাফিজ নাকি দৌড়াচ্ছে। একবার কার্জনের ভিতরে ঢুকল আবার দৌড়ে বের হয়ে গেল। তার পিছে পিছে কয়েকজন গিয়েও তাকে আর পেল না। আমরা তখন সবাই কার্জনে আর হাফিজ দৌড়ে কই গেছে কেউই জানি না। এখন একটা ছেলে ৪-৫ বছর ক্যাম্পাসে। তার পরিচিত লোকজনের অভাব নেই। হাফিজকে সবাই মোটামুটি চেনেন। আমরা চিন্তিত হয়েও চিন্তিত হতে পারিনি। ক্যাম্পাসে তো অন্ততপক্ষে তার কোনো ভয় নেই। আর হাফিজ মারা যাবে- এই কথা আমরা স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারিনি। বিশ্বাস করেন আপনারা, এর লেশমাত্র বুঝতে পারলেও আমি হাফিজকে ‘বাইন্ধা’ রাখতাম কার্জনে। যাইতে দিতাম না জীবনেও।
এদিকে হাফিজের মৃত্যুর ঘটনায় ২৪ মে সহকারী প্রক্টর লিটন কুমার সাহাকে প্রধান করে চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। কমিটির বাকি সদস্যরা হলেন, ক্লিনিক্যাল ফার্মেসি ও ফার্মাকোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. আব্দুল মুহিত, ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. এম এল পলাশ ও মৎস্য বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. এ কে এম গোলাম রব্বানী ঢাকা পোস্টকে বলেন, উপাচার্যের নির্দেশে আমাদের শিক্ষার্থী হাফিজের মৃত্যুর পূর্ণাঙ্গ তদন্ত প্রতিবেদন তৈরিতে সহকারী প্রক্টর লিটন কুমার সাহাকে প্রধান করে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কী ঘটেছিল সেদিন তা বের করার জন্য কাজ করছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
২৩ মে ঢামেক মর্গে হাফিজুরের লাশ শনাক্ত করেন তার বড় ভাই ও বন্ধুরা। সেদিন শাহবাগ খানার ওসি (তদন্ত) আরিফুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেছিলেন, কয়েকদিন আগে আমরা একটি লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ গেটের সামনে পাই। পরিচয় জানতে না পেরে লাশটি আমরা মর্গে রাখি। হাফিজের বড় ভাই লাশটি শনাক্ত করেছেন। আমরা প্রাথমিকভাবে ধারণা করছি, এটি আত্মহত্যা হতে পারে। সে দা দিয়ে নিজের গলায় নিজে আঘাত করেছে। বিষয়টি আমরা তদন্ত করে নিশ্চিত হতে পারব। তদন্তের কাজ শুরু করেছি।
এইচআর/এনএফ/জেএস