হাফিজের মৃত্যুর ঘটনায় মানববন্ধন

নিখোঁজ হওয়ার ৯ দিন পর রোববার (২৩ মে) ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের মর্গে পাওয়া যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষার্থী হাফিজুর রহমানের লাশ। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। শোক প্রকাশের পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা মানববন্ধন করে সুষ্ঠু তদন্তপূর্বক হাফিজুর হত্যার বিচার দাবি করেন। একই সঙ্গে ক্যাম্পাস থেকে শিক্ষার্থী নিখোঁজ এবং মৃত্যুর ঘটনায় প্রশাসনের ‘নড়বড়ে ভূমিকার’ জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি এবং প্রক্টরের পদত্যাগ দাবি করেছেন তারা।

সোমবার (২৪ মে) সকালে হাফিজের মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনার প্রতিকার চেয়ে সন্ত্রাসবিরোধী রাজু ভাস্কর্যে মানববন্ধন করেন শিক্ষার্থীরা। এ সময় তারা বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি জায়গা থেকে একজন শিক্ষার্থীর এমন মৃত্যু কখনো কাম্য নয়। যেখানে একটা গাছ কাটলে সবাই জেগে ওঠে, সেখানে একজন শিক্ষার্থী মারা গেল- কারও ভ্রূক্ষেপ নেই। 

মানববন্ধনে শিক্ষার্থীরা বলেন, আমাদের ভাইয়ের মৃত্যু আমাদের ভীষণভাবে আহত করেছে। কয়েকটি ভিডিওচিত্র দেখেছি, সেখানেও যথেষ্ট প্রশ্ন থেকে যায়। যারা নিজ নিজ জায়গা থেকে দায়িত্ব পালন করেনি, যাদের কারণে আমাদের ভাই-বন্ধু হাফিজের প্রাণ চলে গেছে তাদের সবাইকে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। যদি আত্মহত্যাও হয়, তারও সন্তোষজনক একটা তথ্য আমরা চাই। সর্বোপরি এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত এবং জড়িতদের বিচার দাবি করছি। 

আরও পড়ুন : নিখোঁজ ঢাবি শিক্ষার্থী হাফিজের লাশ মিলল ঢামেক মর্গে

প্রশাসনকে অভিভাবকসুলভ আচরণ করার আহ্বান জানিয়ে শিক্ষার্থীরা বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দায়িত্বটা কী! আপনাদের দায়িত্ব আমাদের নিরাপত্তা দেওয়া। কিন্তু সেটাতে আপনারা সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ। আপনাদের বলব, প্লিজ আপনারা আরেকটু অভিভাবকসুলভ আচরণ করুন, আমাদের নিরাপত্তা দিন। যাতে আমরা স্বাধীনভাবে ক্যাম্পাসে চলাফেরা করতে পারি। 

হাফিজুর রহমান

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও শিক্ষার্থীরা এ ঘটনায় তীব্র ক্ষোভ জানিয়েছেন এবং দায়িত্বে অবহেলার জন্য ভিসি ও প্রক্টরের পদত্যাগ দাবি করেছেন।

আব্দুল ওয়াহেদ নামে এক শিক্ষার্থী লেখেন, হাফিজ ভাইকে হত্যা করা হয়েছে খুবই নৃশংসভাবে। কোনো প্রকার তদন্ত ছাড়াই এটা বলা যাচ্ছে। এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে অনেক বড় বড় কালসাপের সংযোগ থাকতে পারে। প্রমাণ, প্রত্যক্ষদর্শী, ডাবওয়ালা সব এক এক করে গায়েব হয়ে যেতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এত পঁচে গেছে আগে বুঝিনি, আমরা এর শেষ চাই। যে যেভাবে পারেন প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য রেকর্ড করে পাবলিশ করুন। হাফিজ হত্যার বিচার চাই, ভিসি আর প্রক্টরের পদত্যাগ চাই। 

আরও পড়ুন : বেঁচে থাকলে পড়াশোনা হবে, এখন ধৈর্য

বিশ্ববিদ্যালয়ের সুষ্ঠু পরিবেশ চাওয়া মানে বোকার স্বর্গে বাস করা উল্লেখ করে এক শিক্ষার্থী লেখেন, ঢাবির ভিসি ও প্রক্টরের কাজ হচ্ছে শিক্ষার্থীদের মুক্তচিন্তাকে গলা টিপে হত্যা করা, ঢাবির সংগ্রামী ইতিহাসকে ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়া, শিক্ষার্থীদের বিপ্লবী চিন্তাকে পিচঢালা রাস্তায় পিষে মারা! মনে রাখবেন- অযোগ্য, অপদার্থ, মেরুদণ্ডহীন, কাঠের পুতুল না হলে ওই চেয়ারে বসা যায় না। তাই যারা এদের কাছে বিচার চাইছেন, এদের কাছে শিক্ষার্থীর জীবনের নিরাপত্তা চাইছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সুষ্ঠু পরিবেশ চাইছেন তারা বোকার স্বর্গে বসবাস করছেন!

নিরাপদ ক্যাম্পাস দাবি করে মির সাদিক নামে আরেক শিক্ষার্থী বলেন, ক্যাম্পাসের ভেতর থেকে ছাত্র তুলে নিয়ে যাওয়া শুরু হয়েছে, এখন মৃত লাশ পাওয়া যাচ্ছে। কী ভীতিকর ব্যাপার! ক্যাম্পাসের এমন ঠুনকো নিরাপত্তাব্যবস্থা আমাদের আরও অনেক ভোগাবে।

লেখক ও চিন্তক আহমদ ছফা বেঁচে থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্তদের নিয়ে ‘গাধা বৃত্তান্ত’ লিখতেন মন্তব্য করে ফেসবুকে ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর লেখেন, এ ঘটনা ছাড়াও এফ রহমান হলে আবু বক্কর, এস. এম হলে হাফিজুর মোল্লা হত্যা, ডাকসু ভবনে হামলাসহ অসংখ্য ঘটনা ঘটছে। একটা ঘটনারও সুষ্ঠু তদন্ত কিংবা বিচার করতে পারেনি এই দলকানা অপদার্থ প্রশাসন। বারবার এসব ঘটনার প্রতিকার চাইতে গেলে খুব কাছ থেকেই দেখেছি ভিসি-প্রক্টরের ভূমিকা ছাত্রলীগের দুর্বৃত্তদের চেয়ে খুব ব্যতিক্রম ছিল না। এরা রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তিতে এতই ব্যস্ত যে, হলে ছাত্র খুন হয়, ভিসি অফিসের সামনে মেয়েদের বস্ত্রহরণের মতো ঘটনা ঘটে, ২৮ বছর পর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে শিক্ষকরা কারচুপি করে, নির্বাচিত ভিপির ওপর ডাকসু ভবনে হামলা হয়, শহীদ মিনারে শিক্ষক লাঞ্ছনা কিংবা শিক্ষার্থীর লাশ পড়ে থাকলেও এরা কোনো দায়বদ্ধতা অনুভব করেন না! আহমদ ছফা বেঁচে থাকলে এদেরকে নিয়ে হয়ত ‘গাধা বৃত্তান্ত’ লিখতেন!

এদিকে হাফিজুর রহমানের মৃত্যুর সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক এ কে এম গোলাম রব্বানীও। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, হাফিজের এই ঘটনায় আমরা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সবাই মর্মাহত। এই ঘটনার তদন্ত প্রয়োজন। তার (হাফিজ) সাথে কী ঘটেছে আমরা জানতে চাই।

‘ঘটনাটি ক্যাম্পাসে হওয়ায় অনেকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে দায় দিচ্ছে’- এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রক্টর বলেন, ক্যাম্পাস থেকে একজন শিক্ষার্থীর এমন মৃত্যু সবার জন্য কষ্টকর। এই কষ্টের অনুভূতি আমরা বুঝি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় তো এখন বন্ধ, আর পরিবারের পক্ষ থেকে আমাদের জানানো হয়নি। জানার পরেই আমরা খোঁজ-খবর নিয়েছি।

এদিকে এ ঘটনায় শোক জানিয়েছেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান। এক শোকবার্তায় দ্রুততম সময়ের মধ্যে তদন্ত করে একটি পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট প্রদানের অনুরোধ জানিয়ে উপাচার্য বলেন, তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষার্থী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাইম অ্যাকশনের সাধারণ সম্পাদক হাফিজুর রহমানের অস্বাভাবিক মৃত্যুতে শোক জানাচ্ছি। দ্রুততম সময়ের মধ্যে তদন্ত করে একটি পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট প্রদানের জন্য সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি অনুরোধ জানাই। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ডিএমপি কমিশনারকে বিশেষভাবে অনুরোধ করছি।

এছাড়া, উপাচার্য বিষয়টি সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেওয়ার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরকে নির্দেশ দিয়েছেন।

প্রসঙ্গত, নিখোঁজের ৯ দিন পর গতকাল (২৩ মে) ঢামেকের মর্গে মেলে হাফিজের লাশ। তাকে চিহ্নিত করেন তার পরিবারের সদস্যরা। এর আগে গত ১৫ মে ঈদুল ফিতরের পরদিন দুপরে বন্ধুদের সাথে দেখা করতে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আসেন হাফিজুর। বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল এলাকায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেন তিনি। রাত ৮টার পর থেকে তার আর খোঁজ পাওয়া যায়নি।

হাফিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য বিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগের ২০১৫-১৬ সেশনের শিক্ষার্থী ছিলেন। তার গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা থানায়। হফিজ নিখোঁজের ঘটনায় তার মা সামছুন নাহার কসবা থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন। জিডি নম্বর ১২৮৩।

পুলিশ সূত্র বলছে, কয়েকদিন আগে তাকে যখন ঢাকা মেডিকেলের বহির্বিভাগের গেটের সামনে গলাকাটা অবস্থায় উদ্ধার করা হয়, তখন তিনি (হাফিজ) রক্তাক্ত অবস্থায় দৌড়াদৌড়ি করছিলেন। খবর পেয়ে পুলিশ লোকজনের সহায়তায় তাকে রিকশায় করে হাসপাতালে নেওয়ার পথে তিনি রিকশা থেকে লাফ দেন। এরপর তাকে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে যাওয়া হয়। অবস্থা খারাপ দেখে তাকে ওটিতেও নেওয়া হয়। এর মধ্যে তিনি রাত সোয়া ১০টার দিকে মারা যান। আর গতকাল (২৩ মে) তার (হাফিজের) বড় ভাই লাশটি শনাক্ত করেন।

পুলিশ প্রাথমিকভাবে ধারণা করছে, এটি আত্মহত্যা হতে পারে। বিষয়টি তারা তদন্ত করে সত্য উদঘাটন করবেন বলে জানান। তবে হাফিজের বড় ভাই মাসুম বলছেন, ‘এটি আত্মহত্যা হতে পারে না’। সুষ্ঠু তদন্ত এবং বিচার দাবি করেন তিনি।

প্রত্যক্ষদর্শী ডাব বিক্রেতা আনোয়ার হোসাইন বলেন, হঠাৎ এক লোক আমার দা টেনে নেন। তিনি নিজের গলায় দা বসিয়ে দেন। প্রথমে ভেবেছি তিনি ভয় দেখাচ্ছেন, পরে দেখি রক্ত বের হচ্ছে। তখন তিনি বলতে থাকেন, ‘আমাকে মাফ করে দাও, আমাকে মাফ করে দাও’। তারপর তিনি শহীদ মিনারের দিকে দৌড় দেন। ঘটনাটি ঘটে গত ১৫ মে রাত আটটার দিকে। তার পরনে ছিল একটা থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট, গা ছিল খালি।

এইচআর/এইচকে/জেএস