শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী থেকে পরিকল্পনা ও উন্নয়ন দপ্তরের পরিচালক
তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী থেকে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) ২০০ কোটি ৩৮ লাখ টাকার প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে দীর্ঘদিন নিয়ম বহির্ভূতভাবে দায়িত্ব পালন করে গেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন দপ্তরের সাবেক পরিচালক একেএম ফেরদৌস। ‘শাবিপ্রবি অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্প’ শীর্ষক প্রকল্পের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদের ঘনিষ্ঠজন এবং নিজ এলাকার হওয়ায় যোগ্য কর্মকর্তাদের বাদ দিয়ে তিনি একেএম ফেরদৌসকে অবসরের পরও প্রায় ৬ বছর এ পদে বহাল রাখেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এতো বছর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের নজির নেই বলে জানিয়েছেন শিক্ষক-কর্মকর্তারা। নিয়মবহির্ভূত এ নিয়োগে অবসরের পর একেএম ফেরদৌস প্রতি মাসে লক্ষাধিক টাকাসহ ৬ বছরে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেতন নিয়েছেন প্রায় ৭০ লক্ষাধিক টাকা। যেটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বিরাট আর্থিক ক্ষতি বলেও উল্লেখ করেছেন শিক্ষকরা।
বিজ্ঞাপন
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী পরিকল্পনা ও উন্নয়ন দপ্তরের পরিচালক বা অতিরিক্ত পরিচালক হতে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং বা পদার্থবিজ্ঞান, গণিত, অর্থনীতি বা বাণিজ্য বিভাগে অনার্স পাস লাগে। তবে একেএম ফেরদৌস রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮৯ সালে ২য় বিভাগে বিএসএস পাস করেন এবং ১৯৯৩ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় শ্রেণিতে এমএসএস পাস করেন। শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকলেও তাকে এ পদে দীর্ঘদিন নিয়ম বহির্ভূতভাবে পরিচালক বা অতিরিক্ত পরিচালক পদে বসিয়ে রাখা হয়।
অভিযোগ রয়েছে, একেএম ফেরদৌসের একমাত্র যোগ্যতা তার বাড়ি কুমিল্লা জেলায়। সেই যোগ্যতার বলেই যোগ্য ব্যক্তিদের সরিয়ে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন দপ্তরের পরিচালক পদে বসেন। তাছাড়াও উপাচার্য ফরিদ উদ্দিনের খুব কাছের ব্যক্তি হওয়ায় সেই ক্ষমতার জোরে তিনি দপ্তরের কর্মকর্তা এবং কর্মচারীদের সঙ্গেও খারাপ ব্যবহার করতেন। তাছাড়াও অন্য কর্মকর্তাদের রেখে বারবার তার চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধি করায় দাবি উঠেছে প্রায় আড়াইশত কোটি টাকার প্রকল্পে আর্থিক দুর্নীতির কোনো ঘটনা ঘটেছে কিনা তা খতিয়ে দেখার।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, একেএম ফেরদৌস তৃতীয় শ্রেণির সাধারণ কর্মচারী পদে যোগদান করেন ১৯৯০ সালের ডিসেম্বর মাসে। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯২তম সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্তে ২০১৫ সালে অতিরিক্ত পরিচালক পদে পদোন্নতি লাভ করেন। যদিও এ পদে নিয়োগ লাভে তার শিক্ষাগত যোগ্যতা ছিল না। শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকলেও তাকে বিশেষ বিবেচনায় সেসময় নিয়োগ দেওয়া হয়।
এরপর পরিকল্পনা ও উন্নয়ন দপ্তরের পরিচালক মোল্লা আকবর হোসেন ২০১৮ সালের ২২ অক্টোবর মৃত্যুবরণ করলে একই সালের ৩০ অক্টোবর অতিরিক্ত পরিচালক একেএম ফেরদৌসকে পুনরাদেশ না দেওয়া পর্যন্ত পরিকল্পনা ও উন্নয়ন দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত পরিচালকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। একই সাথে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট সেলের প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন পদত্যাগের দিন পর্যন্ত। ২০১৯ সালের ৩ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের ২১৪ তম সিন্ডিকেটে আবারও আরও ৬ মাস সময় বৃদ্ধি করে তাকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেন উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন।
২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর একেএম ফেরদৌসের বয়স ৬০ বছর পূর্ণ হওয়ায় ও চাকরির মেয়াদ শেষ হলেও ভূতাপেক্ষিকভাবে অবসর প্রদানের নোটিশ ইস্যু করা হয় ২০২০ সালের ১ মার্চ।
এরপর তার ‘পিআরএল’ কালীন ছুটি বাতিল করে ২০২০ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ২১৫তম সিন্ডিকেটে ১ জানুয়ারি ২০১৯ থেকে ২ বছরের জন্য তার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপত্র ইস্যু করা হয়। ২০২০ সালের ১ মার্চ সে নিয়োগপত্র ইস্যু করা হয় বলে জানা যায়। এরপর ১৩ ডিসেম্বর ২০২০ সালে অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ২১৯তম সিন্ডিকেটে ১ জানুয়ারি ২০২১ থেকে একই বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত তার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বৃদ্ধি করেন উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন। পরে পরিকল্পনা ও উন্নয়ন দপ্তরের পরিচালক নিয়োগ না হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব চালিয়ে যাওয়ার জন্য ২০২১ সালের ২৯ জুন আবারও একেএম ফেরদৌসকে চিঠি দেন ফরিদ উদ্দিন আহমেদ। তাছাড়া অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের মেয়াদ এ বছরের ৩০ জুন শেষ হওয়ার পরও বেআইনিভাবে আগস্ট মাস পর্যন্ত তাকে এ পদে বসিয়ে রাখা হয়।
এরপর থেকে ২০২৪ সালের জুলাই গণবিপ্লবের পর ছাত্রদের দাবির প্রেক্ষিতে ১৩ আগস্ট একেএম ফেরদৌস পদত্যাগ করেন।
সেপ্টেম্বর মাসের শুরুতে পরিকল্পনা ও উন্নয়ন দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক এবং সিপিসি এর প্রধান (ভারপ্রাপ্ত) হিসেবে একই দপ্তরের উপ-রেজিস্ট্রার আহমদ মাহবুব ফেরদৌসীকে নিয়োগ দেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর আরও প্রায় ৬ বছর একেএম ফেরদৌসকে পরিচালক পদে বসিয়ে রাখেন উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদ। তাছাড়া ২০২০ সালের এক সিন্ডিকেট সভায় নিয়মবহির্ভূতভাবে তাকে ২০১৯ সাল থেকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেখানো হয়। যা আইনবিরোধী বলে জানান শিক্ষক কর্মকর্তারা। গত বছর মন্ত্রণালয়ের অডিট টিম এতো বছর এমন চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ব্যাপারে প্রশ্ন তুললে তা ফরিদ উদ্দিনের পরামর্শে অর্থ দিয়ে মিটিয়ে ফেলারও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এমনকি একেএম ফেরদৌসের সন্তানকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য পোষ্য কোটাতেও পরিবর্তন আনেন তিনি। যে পরিবর্তনের ফলে তার সন্তান বিশ্ববিদ্যালয়ের সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ভর্তির সুযোগ পায়। এমনকি সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য কর্মচারীরা এর প্রতিবাদ করলে তাতেও কর্ণপাত করেননি ফরিদ উদ্দিন।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কর্মচারী বলেন, আমার ছেলেকে আমি এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করাতে পারিনি। আগের নিয়মে যোগ্যতা থাকা স্বত্ত্বেও একেএম ফেরদৌসের মেয়েকে ভর্তি করানোর জন্য উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন ওই সময় নিয়ম পরিবর্তন করেন। যার ফলে আমাদের অনেক কর্মচারীর সন্তানরা এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারেনি।
শিক্ষক-কর্মকর্তাদের প্রশ্ন- ওই দপ্তরে যোগ্য কর্মকর্তারা থাকার পরও কেন নিয়মবহির্ভূতভাবে তাকেই দপ্তরের প্রধান হিসেবে বসিয়ে রেখে এতো সুযোগ-সুবিধা দিয়েছেন ফরিদ উদ্দিন আহমেদ। তাকে সেই দপ্তরের প্রধান হিসেবে বসিয়ে রাখার পেছনে আর্থিক দুর্নীতির শঙ্কা করছেন তারা। তার তত্ত্বাবধানে প্রায় আড়াইশ কোটি টাকার প্রকল্পে কোনো দুর্নীতি হয়েছে কিনা তাও খতিয়ে দেখার আহ্বান জানান তারা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই দপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাথে খারাপ ব্যবহার করা থেকে শুরু করে সাবেক উপাচার্য ফরিদ উদ্দিনের ক্ষমতা দেখাতেন তিনি। আমরা এতোদিন এ নিয়ে কথা বলার সুযোগ পাইনি। এসব নিয়ে কথা তুললেই আমাদের বিভিন্ন অতিরিক্ত কাজের চাপে রাখতেন তিনি। দক্ষতা আর শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগের ঘাটতি তৈরি হয় তার। যার ফলে আমাদের প্রজেক্টগুলোর কাজ অনেক দেরিতে শেষ হতো। ফলশ্রুতিতে আমাদের ২০১৭ সালের একটি প্রজেক্ট শেষ হয় ২০২৪ সালে। আমরা আশা করছি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নতুন করে তদন্ত করে বিষয়গুলো খতিয়ে দেখবে।
নাম উল্লেখ না করা শর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের এক শিক্ষক বলেন, অবসরের পরও এত বছর একটি পদে একজনকে বসিয়ে রাখা নজিরবিহীন। এতে করে অন্য যোগ্য কর্মকর্তাদের সাথে যেমন অবিচার করা হয়েছে তেমনি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে এ পদের গ্রহণযোগ্যতাও কমেছে। এমন উদাহরণ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য কখনোই মঙ্গলজনক নেই।
এসব অভিযোগের বিষয়ে একেএম ফেরদৌস বলেন, আমাকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিয়োগ দিয়েছে, এতে আমার কোনো হাত নেই। তারা আমাকে যোগ্য মনে করেছে সেজন্য আমাকে এ পদে বারবার নিয়োগ দিয়েছে। আর আর্থিক কোনো দুর্নীতি এখানে হয়নি। আমার কোনো হাত ছিল না।
মেয়েকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় পোষ্য কোটার পরিবর্তনের বিষয়ে তিনি বলেন, এখানে আমি কিছু জানি না। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এসব নিয়ম পরিবর্তন করতে পারে। শিক্ষকরা চাইলে নিয়ম পরিবর্তন করাতে পারে, কিন্তু এখানে আমার কোনো হাত ছিল না।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. সাজেদুল করিম বলেন, আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের যেখানে যেখানে দুর্নীতি হয়েছে বা দুর্নীতির সন্দেহ আছে সে বিষয়ে অভিযোগ পেলেই তা তদন্ত করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
আরএআর