পড়ার টেবিল থেকে রাজপথ, বাংলার শত শত বছরের অর্জন আর বিজয়গাথার মিলিত নাম এ দেশের ছাত্রসমাজ। সরকারি চাকরিতে বৈষম্য মোচনের দাবি নিয়ে শুরু হওয়া আন্দোলন পূর্ণতা পায় স্বৈরাচার সরকার পতনের মধ্য দিয়ে। এর মাঝে ঝরে গেছে শত শত ছাত্র-জনতার তাজা প্রাণ। বন্দুকের নলের সামনে বুক পেতে দিয়ে তারা লিখে গেছেন বছরের পর বছর চলা বঞ্চনা আর আক্ষেপের অবসানের লড়াইয়ে অকুতোভয় সৈনিকের গল্প।

আন্দোলন চলাকালীন সময় থেকেই রাজপথ আর দেয়ালে চিত্রাঙ্কন ও ক্যালিওগ্রাফি হয়ে ওঠে সংগ্রামের অবিচ্ছেদ্য অংশ। শিক্ষার্থীদের হাতে আঁকা তেমনই কিছু ক্যালিগ্রাফি শোভা পাচ্ছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) বিভিন্ন দেয়ালে, যা সহসাই আকর্ষণ করছে শিক্ষক শিক্ষার্থীসহ সবাইকে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের কে আর মার্কেট, এনিম্যাল হাজবেন্ড্রি অনুষদীয় করিডোর, নদের পাড়, কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার ও আব্দুল জব্বারের মোড় সংলগ্ন দেয়ালগুলো এখন একেকটি দ্রোহ আর বিজয়ের প্রতীক। রং-তুলির আঁকড়ে তারা এঁকেছেন বুকের ভেতর জমে থাকা ক্ষোভ, বিজয়ের গল্প আর দেশ সংস্কারের বিভিন্ন বিপ্লবী স্লোগান। আর তাতেই রঙিন হয়ে উঠেছে জীর্ণ, রংচটা নোংরা দেয়ালগুলো।

কিছুদিন আগেও দেয়ালগুলো ছিল অপরিচ্ছন্ন আর পোস্টারে সয়লাব। কিন্তু এখন সেসব দেয়াল ঘষা-মাজা করে ফুল, পাখি, সাম্য, প্রতিবাদ, বিপ্লবী স্লোগান ও সূর্যোদয়ের মতো ছবি এঁকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে জৌলুস। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সৌন্দর্য বেড়েছে কয়েকগুণ।

শেখ হাসিনার দেশ দেশ ছেড়ে পালানোর দিনটি স্মরণীয় করে রাখতে এসব দেয়ালে লেখা হয়েছে, ‘৩৬শে জুলাই’। সেখানে আরও আঁকা হয়েছে, ‘আমার বাংলায়, সাম্প্রদায়িকতার ঠাঁই নাই’, মীর মুগ্ধের স্মৃতিময় ‘পানি লাগবে? পানি?’, ঐক্যের গ্রাফিতি ‘আমরা সবাই বুধ’, মুষ্টিবদ্ধ হাতের চারপাশে লেখা ‘৫২ দেখিনি, ২৪ দেখেছি’, দ্রোহের প্রতীক হিসেবে ‘শিকল ভাঙার গ্রাফিতি’, একজন পু‌লিশ জনতার দিকে গু‌লি ছোড়ার ভঙ্গিতে আঁকা ছবি যার পাশে লেখা ‘গু‌লি ক‌রি মরে একটা, একটাই যায় স‌্যার, বা‌কি‌ডি যায় না’। এছাড়া সূর্যোদয়ের বাংলাদেশ, আবু সাইদের সাহসী বুক, হেলিকপ্টার থেকে গুলি করার দৃশ্য, আহত ছাত্রের মায়ের আকুতি, চিরসবুজ বাংলায় শহীদ মিনারের পেছন দিয়ে উদীয়মান নতুন সূর্যের সাক্ষী হতে সুউচ্চ স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের পতাকা হাতে এক যুবক, তার পাশে ছয়জন বিবেকবান শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীর লাল ফিতায় বাঁধা চোখ, স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা, মানচিত্র, সাথে বিভিন্ন দাবি ও সাহসী স্লোগানে ভরে গেছে এসব দেয়াল।

ক্যালিওগ্রাফি ও গ্রাফিতি আঁকার সঙ্গে সম্পৃক্ত শিক্ষার্থীরা জানান, আমরা নিজ উদ্যোগেই এসব করছি। নিজেদের টাকায় রং, তুলি কিনেছি। এ ধরনের চিত্রকর্ম আমাদের উজ্জীবিত করে এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে শক্তি জাগায়। মূলত এটি ছাত্র জনতার সংগ্রামের বিজয়ের গল্পকে প্রতিনিধিত্ব করে। স্মরণ করিয়ে দেয় বৈষম্যহীন দেশ গঠনের কারিগর আবু সাঈদ, আদনান, রাফি, মুগ্ধসহ শহীদ বীরদের মুখ। এসবের মাঝে অনুভব করা যায় স্বাধীনতার সুখ, বাতাসে মুক্তির স্বাদ, চোখে উঁকি দেয় প্রশান্তি। সঙ্গে প্রিয় বাকৃবিকেও তার চিরচেনা অপরূপ ও মনোমুগ্ধকর যৌবনে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রয়াশও ছিল বলে জানান তারা।

এসবের পাশাপাশি নজর কাড়ছে ইসলামি ক্যালিওগ্রাফিও। বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিসার্স পরিষদের ভবনে শোভা পাচ্ছে দৃষ্টিনন্দন আরবি ক্যালিওগ্রাফি। ওই ক্যা‌লিওগ্রা‌ফি‌টি করেছেন মো. সিয়াম আহম্মেদ। তিনি বলেন, এ ধরনের চিত্রকর্ম আমাদের সংগ্রাম এবং ভয়কে জয় করার প্রতীক। এবারের আন্দোলনে আমরা বুঝিয়ে দিয়েছি স্বৈরাচারীদের এ দেশে কোনো জায়গা নেই। রাজপথে আপ‌নি বন্ধুহীন নন, যাদের আপনি দেখেন তারাই আপনার আসল সহযোদ্ধা।

মুসাদ্দিকুল ইসলাম তানভীর/এফআরএস