কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা, হেনস্তাসহ নিপীড়নের দায়ে অভিযুক্তদের বিচার দাবিতে গতকাল দিনভর বিক্ষোভ করেছে শিক্ষার্থীরা। এদিন নানা অপরাধের অভিযোগ এনে বিভাগীয় দুই শিক্ষককে চাকরি থেকে অব্যাহতির দাবি জানান আইন ও বিচার বিভাগের শিক্ষার্থীরা।

এছাড়াও শিক্ষার্থীদের ওপর হামলায় মদদের অভিযোগে নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থীরা ছয় শিক্ষককে চাকরি থেকে অব্যাহতি ও বিচার দাবিতে বিক্ষোভ করেন। অন্যদিকে সরকার পতনের পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন প্রশাসনিক দায়িত্ব থেকে পদত্যাগের হিড়িক পড়েছে।

রোববার (১১ আগস্ট) বেলা সাড়ে ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাদদেশে মানববন্ধন করেন আইন অনুষদের শিক্ষার্থীরা। এর আগে সকাল ১০টায় তারা অনুষদের ডিন কক্ষে তালা লাগিয়ে দিয়ে সেখান থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে শহীদ মিনারে আসেন।

এসময় শিক্ষার্থীরা কোটা সংস্কার আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের হেনস্তা, শিক্ষার্থীর গায়ে হাত তোলা, ছাত্রীকে যৌন নিপীড়ন, পরিকল্পিতভাবে রেজাল্ট কমিয়ে দেওয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগ এনে অনুষদের ডিন ও বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তাপস কুমার দাস এবং সহযোগী অধ্যাপক সুপ্রভাত পালকে চাকরি থেকে অব্যাহতির দাবি জানান।

মানববন্ধনে ৫২ ব্যাচের শিক্ষার্থী আলী হাসান মুর্তজা বলেন, আন্দোলনের সময় আটক হওয়া শিক্ষার্থীদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় আইনি সুপারিশ সেল গঠন করে। তাপস কুমার সেই সেলের সদস্য। তাকে সহযোগিতার কথা জানানো হলে তিনি শিক্ষার্থীদের হিজবুত তাহরীর লোক ও দুষ্কৃতকারী বলে আখ্যায়িত করেন।

সহযোগী অধ্যাপক সুপ্রভাত পালের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থী সুহার্ত্য দৌলা অনিক বলেন, ফাইনাল পরীক্ষার সময় তাড়াহুড়ো করে ক্লাসে আসি এবং দ্বিতীয় সারির একটি বেঞ্চে বসে পরীক্ষা শুরু করি। তাড়াহুড়োয় আমার ফোনটা রাখতে মনে ছিল না। পরীক্ষার একদম শেষ পর্যায়ে আমার ফোনটা বেজে উঠলে সুপ্রভাত পাল বলেন, আমি নকল করছি। অস্বীকার করলে আমাকে সবার সামনে থাপ্পড় মারেন। আমার ফোন নেওয়ার দেড় মাস পার হলেও এখনো তিনি ফোন ফেরত দেননি।

এছাড়া মাদ্রাসা থেকে আসা শিক্ষার্থীদের প্রতি বিরূপ আচরণের অভিযোগ এনে কাওসার আহমেদ রেজাউল বলেন, যারা মাদ্রাসা থেকে এসেছি, ক্লাসে নানানভাবে তাদের হেনস্তা করেছে। তারা ক্লাসে কোনও প্রশ্ন করলে তাদের প্রশ্নের উত্তর তো দেওয়াই হতো না, বরং উল্টো‌ প্রশ্ন করে বলা হয় তুমি কি মাদ্রাসা থেকে এসেছো? দাঁড়ি—টুপি পরে আছো! মাদ্রাসা ছাত্র হলে কি আমার প্রশ্ন করার অধিকার নেই?

এদিকে কোটা সংস্কার আন্দোলনে জড়িত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনার মদদদাতা শিক্ষকদের পদত্যাগ ও শাস্তির দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। দুপুর সাড়ে ১২টায় মহুয়া মঞ্চের সামনে থেকে বিক্ষোভ মিছিল শুরু হয়। মিছিলটি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ করে নতুন প্রশাসনিক ভবনের সামনে এসে শেষ হয়।

এসময় জাবি শাখার সমন্বয়ক আব্দুর রশিদ জিতু বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে যেসব শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা-মামলার মদদ দিয়েছেন, তাদের অবিলম্বে পদত্যাগ করতে হবে। এছাড়া তাদের সবার শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

অপরদিকে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগ ও বহিরাগত সন্ত্রাসীদের হামলার ঘটনায় মদদদাতা ও হামলার পরবর্তীতে ছাত্রলীগের পক্ষে অবস্থান নেওয়া ছয় শিক্ষকের পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল করেছে নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থীরা। দুপুর দেড়টার দিকে নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের অভ্যন্তরে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করেন।

ওই বিভাগের শিক্ষার্থীরা যেসব শিক্ষকের শাস্তি দাবি করছেন তারা হলেন- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের প্রাধ্যক্ষ এবং বিভাগের অধ্যাপক ইস্রাফিল আহমেদ (রঙ্গন), অধ্যাপক এ কে এম ইউসুফ হাসান (অর্ক), অধ্যাপক আমিনুল ইসলাম (দুর্জয়), সহকারী অধ্যাপক আশরাফুল হাবীব (মাসুদ), ফাহিম মালিক (ইভান) ও মহিবুর রৌফ (শৈবাল)।

বিভাগের শিক্ষার্থী আরিফুল ইসলাম বলেন, শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার মদদদাতা এবং হামলার পরবর্তীতে যেসব শিক্ষক ছাত্রলীগের পক্ষে ছিলেন তাদের পদত্যাগ চাই। অধ্যাপক ইস্রাফিল আহমেদ হামলার আগে বঙ্গবন্ধু হলে ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদককে নিয়ে বৈঠক করে এই হামলার মদদ দিয়েছিলেন। ছাত্রলীগ যখন হামলা চালাচ্ছিল, তখন টিচার্স ক্লাবে দুজন সাংবাদিক আশ্রয় নিতে চাইলে ইস্রাফিল আহমেদ তাদেরকে আশ্রয় দেননি। এরকম খুনি শিক্ষকদের শিক্ষকতা করার কোনো নৈতিক অধিকার নেই। অবিলম্বে তাদের চাকরিচ্যুত করতে হবে।

দায়িত্ব থেকে পদত্যাগের হিড়িক

গত পাঁচ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিভিন্ন দায়িত্ব থেকে একে একে পদত্যাগ করছেন আওয়ামীপন্থি শিক্ষকরা। 

রোববার উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক মোহাম্মদ মোস্তফা ফিরোজ, শহিদ সালাম বরকত হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক সুকল্যাণ কুমার কুণ্ডু, শেখ রাসেল হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক তাজউদ্দীন শিকদার পদত্যাগ করেছেন বলে জানা গেছে। 

এর আগে গত ৫ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও শহিদ তাজউদ্দীন আহমদ হলের প্রাধ্যক্ষ পদ থেকে অধ্যাপক আলমগীর কবির, ৭ আগস্ট উপাচার্য অধ্যাপক নুরুল আলম, চুক্তিভিত্তিক রেজিস্ট্রার আবু হাসান, ফজিলতুন্নেসা হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ছায়েদুর রহমান ও ১০ আগস্ট মীর মোশাররফ হোসনে হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক সাব্বির আলম পদত্যাগ করেছেন বলে বলে জানা গেছে। 

এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শেখ হাসিনা হল, প্রীতিলতা হলসহ বেশ কয়েকটি হলের প্রাধ্যক্ষদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পদত্যাগের আল্টিমেটাম দিয়েছে স্ব স্ব হলের শিক্ষার্থীরা।

পিএইচ